আগস্ট মাস পড়ে গেল। আর বেশি দিন বাকি নেই পুজোর। এই সময়ে নাওয়া-খাওয়ার ফুরসত থাকে না মৃৎশিল্পীদের। স্টুডিওতে একের পর এক সার দিয়ে প্রতিমা দাঁড় করানো থাকে শুকানোর জন্য। একের পর এক বায়না নিয়ে নাজেহাল অবস্থা হয়। কিন্তু হতচ্ছাড়া করোনা সেই ছবি পালটা দিয়েছে এবছর। উত্তর কলকাতার কুমোরটুলি যেন থমকে গিয়েছে। এবছর করোনা-আমফান, পরপর দুই বিপর্যয়ের জেরে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে শিল্পীদের। পুজো হবে তো? আশা-আশঙ্কার দোলাচলে রয়েছে কুমোরটুলি। এখনও বায়নাই হয়নি অর্ধেক ঠাকুরের। কুমোরটুলির নামকরা শিল্পীরা এখন আশঙ্কার দিন গুনছেন।
শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে যা জানা গেল, সবাই চাইছেন প্রতিমার বায়না করুক পুজো উদ্যোক্তারা। ছোট করে হলেও যেন পুজো হয় এবার। সেই অনুযায়ী, প্রতিমার সাইজ ছোট করতেও আপত্তি নেই শিল্পীদের। করোনার কোপে আগেই শীতলা, বাসন্তী, মনসা পুজোর মতো কয়েকটা পুজোর বাজার চলে গিয়েছে শিল্পীদের। সামনে গণেশ চতুর্থী। তাও কুমোরটুলির কয়েক জন শিল্পীর বাঁধা কিছু খরিদ্দার ছাড়া এবার সেই বাজারও অনিশ্চিত। কী হবে কিছুই বুঝতে পারছেন না শিল্পীরা। যেমন শিল্পী পরিমল পাল বললেন, “উদ্যোক্তারা বায়নাটা অন্তত দিক। সবাই শুধু মুখেই বলছেন, পুজো হবে পুজো হবে। কিন্তু আসল জিনিস, প্রতিমা। সেটার কী হবে। এবার অগ্রিম দিলে তবেই সময়মতো ঠাকুর ডেলিভারি দেওয়া যাবে। আর তাও অর্ডারি নয়। আগে থেকে তৈরি ঠাকুরই নিতে হবে। বায়না ছাড়া শেষ মুহূর্তে সম্ভব নয়। কারণ পরের মাসে কী পরিস্থিতি থাকবে কেউ জানে না।”
গোদের উপর বিষফোড়ার মতো আরও একটা সমস্যা হল কারিগরদের না থাকা। অনেক শিল্পীরই কারিগররা কলকাতায় এসে কাজ করতে চাইছেন না। করোনা সংক্রমণের ভয়েই অনেকে শহরমুখো হচ্ছেন না। কারণ, অনেকেই নিজেদের জেলায় চাষবাস, দোকান দিয়ে বিকল্প জীবিকার বন্দোবস্ত করে নিচ্ছেন। দৈনিক খরচের টাকাটা উঠলেই তাঁদের চলে যাচ্ছে। আর এদিকে, কুমোরটুলির ঘিঞ্জি অঞ্চলে পর্যাপ্ত শৌচাগার নেই, স্যানিটেশনেরও ব্যবস্থা নেই সেরকম। পুরসভাও উদাসীন। সবমিলিয়ে এই কারণেই কারিগররা মুখ ফেরাচ্ছেন, এমনটাই জানিয়েছেন শিল্পী নবকুমার পাল। তিনি বলেছেন, “কারিগরদের সংখ্যা কম। এই অবস্থায় সব অর্ডার শেষ করাও সম্ভব নয়। তার উপর বায়নাও কম। প্রশাসন উদ্যোগ নিয়ে কুমোরটুলিতে করোনা সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে না। সবদিক থেকেই এখন দুশ্চিন্তা বাড়ছে।”
শিল্পীদের কথায়, কুমোরটুলিতে যেখানে ২-৩ হাজার ঠাকুর তৈরি হয় দুর্গাপুজোর সময়। সেখানে এবার এখনও পর্যন্ত ৫০০ ঠাকুরও তৈরি হবে কি না সন্দেহ। কারণ, বায়নার অভাব আর দ্বিতীয়ত জোগাড়ু-কারিগরদের অনুপস্থিতি। লকডাউনের মধ্যে কুমোরটুলির প্রায় ২ থেকে তিন হাজার কারিগরদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন শিল্পীরা। কিন্তু লকডাউন উঠতেই সেরকম কাজ হাতে না থাকায় যে যার বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। কিন্তু এখন আর কেউ কলকাতায় ফিরতে চাইছেন না। শিল্পী সৌমেন পাল জানিয়েছেন, “বায়না এখনও সেভাবে আসেনি। কিন্তু তার চেয়েও বড় চিন্তা, এবার তো নাহয় পুঁজি ভেঙে চালিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু এর প্রভাব পড়বে আগামী বছরগুলোতেও। এই করোনার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। আর তা যে কতটা মারাত্মক হবে তা ভেবেই চিন্তা হচ্ছে। তার মধ্যে অনেকেই বায়না দিয়েও পরে অর্ডার বাতিল করে দিচ্ছেন। যা আরও সমস্যার। এভাবে চললে কী করে চলবে সেটাই বুঝতে পারছি না। আর শেষমূহূর্তে সারারাত জেগে কাজ করা, মাটি-জল ঘাঁটা শরীরের জন্যও ভাল নয়। সেই একটা সমস্যাও রয়েছে।”
সবমিলিয়ে করোনার কোপে এবার পুজোর হালচিত্রটাই বদলে গিয়েছে এবছর। কিন্তু সব শিল্পীরা একটা বিষয়ে একমত, পুজো কমিটিগুলো বায়না নিয়ে এখন থেকেই উদ্যোগ না নিলে এবার কিছুই কাজ এগোবে না। কারণ, পরের মাস এবং অক্টোবরে পরিস্থিতি কীরকম থাকবে তা নিয়ে সন্দিহান সবাই। কোনওরকমে ছোট করেও পুজো করতে হলে এখন থেকেই উদ্যোগ নিতে হবে উদ্যোক্তাদের। নাহলে দুর্গাপুজো তো বটেই, প্রায় তিনশো বছরের পুরনো কুমোরটুলিতেও আশঙ্কার কালো মেঘ জমবে তা বলাই বাহুল্য।