পুরুলিয়ার পুরাকীর্তি নিয়ে ব্যাপক ক্ষেত্রসমিক্ষা নিয়ে পাঠ করতে গিয়ে আমাদের নজর কোনভাবেই পুরুলিয়া বা তত্সংলগ্ন এলাকায় জৈন তীর্থঙ্কর ও তাদের বিভিন্ন দেব – দেবী গুলি নজর এড়িয়ে যেতে পারে না । বর্তমানে এই সমস্ত জৈন পুরাকীর্তিগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চুরি হচ্ছে।কিছু মূর্তি স্থানীয় অনেক মানুষের দ্বারা তারা লৌকিক দেবদেবী তে রূপান্তরিত হয়ে রক্ষিত হচ্ছে। তবে অধিকাংশই ক্ষতিগ্রস্থের সম্মুখীন।
পুরুলিয়া অঞ্চলে এসমস্ত দেব দেবী কোথাও কাত্যায়নী রূপে ,কোথাও নীলকন্ঠবাসিনী রূপে, কোথাও বুড়োবাবা, বুদ্ধেশ্বর, ভৈরব, কালভৈরব রূপে, কোথাও নাকটিঠাকুরন , কোথাও বুদ্ধেশ্বর ইত্যাদি নামে পুজিত হচ্ছেন।
সম্ভবত নবম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দি পর্যন্ত সময় কালে এই মানভূম এলাকায় সরাক যুগের বা জৈন যুগের সূচনা ঘটেছিল । ঐতিহাসিকগণের অনুমান অনুযায়ী বর্ধমান মহাবীর পরেশনাথ পাহাড় যাওয়ার সময় এই মানভূমের উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে গিয়েছিলেন। তাই অনেকের মতে এই ভূখণ্ডটি ব্রজভূমি নামে পরিচিত ।
পরবর্তীকালে মহাবীর এর অনুগামীরা এই অঞ্চলে বিভিন্ন দেব দেউল নির্মাণের বৃহৎ কর্মযজ্ঞ শুরু করেন। এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তৎকালীন জৈন ব্যবসায়ীগন। এই সমস্ত জৈন ব্যবসায়ীরা তাম্রআকরিক , তৈলবীজ প্রভৃতি রপ্তানিকারী ব্যবসায়ী ছিলেন।পুরুলিয়ার সেকালের বিখ্যাত নদী বন্দর ছিল তৈলকম্প বা তেলকুপি । তৈলকম্পের রাজা ছিলেন রুদ্রশিখর। তিনি এই সমস্ত জৈন ব্যবসায়িদের প্রভূত সহযোগিতা করতেন । এসমস্ত ব্যবসায়ীরা “মানবাজারের” নিকটস্থ দুটি তাম্রখনি “তামাজুড়ি “এবং “তামাখুন” থেকে তাম্র আকরিক সংগ্রহ করে ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি ও মহিষের গাড়িতে সড়কপথে বন্দরে নিয়ে আসতেন । সেখান থেকে
নৌকা বাহিত হয়ে সেইসব আকরিক ও সংগ্রহীত তৈলবীজ তাম্রলিপ্ত বন্দরে।
এসব জৈন ব্যবসায়ীরা তাদের এই ব্যবসায়ীক পথ ধরে অজস্র জৈন দেব দেউল নির্মাণ করেছিলেন। তাছাড়া জৈন ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি এখানে গ্রামাঞ্চলের জনগোষ্ঠী জৈন মার্গের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। প্রায় প্রতিটি গ্রামে বিভিন্ন জৈন দেবালয় স্থাপিত হয়েছিল । পরবর্তীকালে শঙ্করাচার্যের প্রভাবে যখন সারা ভারতে পুনশ্চ সনাতন ধর্ম বিস্তার লাভ করল তখন মানভূমে তার প্রভাব পরল।
এছাড়া জৈন ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় ভাটা পড়ার জন্য তারা ব্যবসার খাতিরে অন্যত্র স্থানান্তরিত হলেন। স্বাভাবিক ভাবে তাদের প্রতিষ্ঠিত জৈন দেবালয় গুলো হল পরিত্যক্ত। এই সমস্ত দেব দেউল এর নিযুক্ত পূজারীসম্প্রদায়ের তথা সেবায়তদের ব্যয় ভার বহন করার আর কোনো পথ খোলা থাকল না। ফলত , সব দেব দেউল গুলি পরিত্যক্ত হল।
পরে কালের গতিতে, যুদ্ধ বিগ্রহ, বৈদেশিক আক্রমনের ফলে সৌন্দর্যমন্ডিত দেব দেউলগুলি ক্রমশ ক্ষয় হতে থাকে। বর্তমানে মূর্তি পাচারকারীরা দেশ বিদেশে সেগুলো পাচার করে মুনাফা অর্জন করতে থাকে। ক্রমশ দেউল গুলি মূর্তি শূন্য হয়ে পড়ে। যে সমস্ত দেব দেউল এর মূর্তি অবশিষ্ট ছিল সেই সমস্ত মূর্তিগুলোকে গ্রামের মানুষেরা নিজের মত চিন্তা ভাবনা করে নানান দেব দেবীর নাম দিয়ে প্রাচীন দেউলে, গ্রামথানে, মুক্ত আকাশের নিচে স্থাপন করে পূজা করতে শুরু করেন। তাতে করে সেই মুর্তিগুলি রক্ষিত হয়েছে । কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ মূর্তি অরক্ষিত। পুরুলিয়া জেলার অঞ্চলে যেসমস্ত গ্রামে জৈন তীর্থঙ্কর বা দেবদেবীর পূজা হয় তার মধ্যে আমি পূর্বেই ইরগুনাথের , নাকটিঠাকরুন, নীলকন্ঠ বাসিনীর কথা উল্লেখ করেছিলাম । আজ আম কথা বলব কালভৈরব , ভৈরবনাথ অনাড়া বানেশ্বর এবং বুদ্ধেশ্বরের কথা ।
অতীতের বিখ্যাত জৈন তীর্থক্ষেত্র ছিল পাকবিড়া। যা আজ অবহেলিত হয়ে পড়ে রয়েছে । শত শত মূর্তি আজও মুক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। প্রতিনিয়ত হচ্ছে চুরি । ২০১৪ সালের প্রথম দিকে দুটো জৈন মূর্তি হঠাৎই সেখান থেকে চুরি যায় ।স্থানীয় প্রশাসন এ ব্যাপারে নির্বিকার হয়ে থাকে । এখানকার সাড়ে সাত ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট কৃষ্ণবর্ণ জৈন তীর্থঙ্কর এর মূর্তিটি হল সারা দেশের সম্পদ ।বর্তমানে ইনি পূজিত হচ্ছেন কালভৈরব নামে । পাকবিড়া গ্রামের রায় পদবীধারী ব্যক্তিরা এখানে নিত্য পূজা করেন । শ্রাবণ মাসে এখানে জল ঢালার ধুম পড়ে যায়। স্থানীয় মানুষ সন্তান ও সুখ শান্তি কামনায় কাল ভৈরব এর কাছে মানত করেন।
সারা চৈত্র বৈশাখ মাস জুড়ে আজও মানভূমের গ্রামগঞ্জে ভক্ত দের কন্ঠে “তেলকুপির ভৈরবনাথ হে , অড়াণার বানেশ্বর হে ” ধ্বনিত হয় । এই তেলকুপির ভৈরবনাথ হলেন জৈন প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভনাথ । এনার লাঞ্চন চিন্হ হলো বৃষ বা ষাঁড়। মানভূমের প্রায় সব গ্রামে বা গ্রামের মাঠে পড়ে থাকা ভগ্ন ঋষভের মূর্তি গুলো ভৈরব ,কালভৈরব, মহাভৈরব নামে পুজো হচ্ছে। এখানকার বর্তমানে যে ঋষভনাথের মূর্তি চোখে পড়ে সেটি সম্পূর্ণ ভগ্ন। মস্তক অংশটি বিলুপ্ত। অতীতে এটি তেলকুপির ভৈরবথানে দেউলের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত ছিল। ১৯৫৭ সালে ডি.ভি.সির জলধারে তেলকুপির সলিল সমাধি ঘটল। দেউল ও বহুমূর্তি জলের তলায় চাপা পড়ে । স্থানীয় গুরুডি গ্রামের মানুষ ঋষভনাথের মূর্তি সহ আরো বেশকিছু মূর্তি সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করে গ্রামে নিয়ে আসেন এবং মন্দির স্থাপন করেন। বর্তমানে শিবলিঙ্গের মন্দিরের অভ্যন্তরে এবং বাইরে ঋষভনাথ অবস্থান করছেন। বর্তমানে সিমেন্টের মুখ তৈরী করে ঋষভনাথের ভগ্ন মস্তকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতি বৎসর এখানে বারুনীতে অর্থাৎ জৈষ্ঠ মাসের ১২ দিনের দিন মেলা বসে এবং তিনদিন সেই মেলা চলে। এখানে প্রায় প্রতিটি তিথিতে নিয়মিত শৈব মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে পূজা হয়।
পুরুলিয়ার মানুষের কাছে বিশেষত গাজন সন্ন্যাসীদের নিকট জাগ্রত দেবতা হলেন “অড়াণার বানেশ্বর” । মন্দিরের অভ্যন্তরে যে প্রাচীন শিবলিঙ্গ রয়েছে সেটি জৈন শিবলিঙ্গ। যাকে বলা হয় বাণলিঙ্গ। প্রাচীন জৈন দেউল আজ আর টিকে নেই। সিমেন্ট ও মার্বেলের আস্তরণে প্রাচীন অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে গিয়ে ,হারিয়ে গেছে। তবে মন্দিরের গঠনশৈলী এবং অতি বৃহৎ পুষ্করিণী প্রমাণ করে জৈন প্রভাবকে প্রমান করে। সারা শ্রাবণ মাস জুড়ে এখানে হাজার হাজার ভক্তের ভিড় হয় ।এখানে নিত্য পূজা হয় । এছাড়া এখানে কোন জৈন মূর্তি চোখে পড়ে না। সম্ভবত স্থানান্তরিত হয়েছে।
পুঞ্চা থানার পাকবিড়ার মতো বুধপুরও প্রাচীন জৈন প্রত্নস্থল। ধ্বংসস্তূপ থেকে অনুমান করা যায় অতীতে এখানে সাতটি জৈন দেউল ছিল। বর্তমানে একটি দেউলও পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় নেই। প্রত্নস্থল গুলি লক্ষ্য করলে দুটি গণেশ মূর্তি, একটি ভগ্নদেব মূর্তি এবং একাধিক বীর স্তম্ভ দেখতে পাওয়া যায়। প্রত্নস্থলে পড়ে থাকা প্রস্তরখন্ডগুলো দিয়ে বর্তমানে নির্মিত হয়েছে ” বুদ্ধেশ্বর ” শিবের মন্দির। অভ্যন্তরে রয়েছে একটি ক্ষয়ে যাওয়া স্তম্ভ আকৃতির শিবলিঙ্গ ।এখানে নিত্যপূজা হয়। সারা শ্রাবণ মাসে শিবের মাথায় জল ঢালার জন্য ভিড় হয় এখানে । চৈত্রসংক্রান্তিতে গাজনের বিরাট মেলা বসে । এখানকার কিছু জৈন মূর্তি স্থানান্তরিত করা হয়েছে মানবাজারের পাথর মহড়ায়।
সাঁওতালডি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশে ভোজুডি। এখানে থেকে পায়ে হাটা দূরে অবস্থান করছে “ভৈরব- স্থান”। এটিও একটি প্রাচীন জৈন প্রত্নস্থল । একটি পাকা মন্দির নির্মাণ করে তার ভিতরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চার ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট জৈন তীর্থঙ্কর ঋষভনাথের মূর্তি।
উক্ত মূর্তির নির্মাণ শৈলী পুরুলিয়ার পাকবিড়া তেলকুপির অনুরূপ। সিন্দুর, চন্দন, ধুপ, দীপ , বিল্বপত্র, শঙ্খ ধ্বনি ও নানাবিধ পূজার উপকরণ এর মাধ্যমে তিনি মানুষের নিকট নিয়মিত পূজিত হন।এই স্থানকে দেখলেই প্রত্নস্থল বলে মনে হবে। চতুর্দিকে ছড়িয়ে রয়েছে দেউলের নানা আকৃতির পাথর। একাধিক ছোট ছোট প্রস্তর মূর্তি। পাশেই একটি সুন্দর ঝরনা। নিচের থেকে শীতল জল বুদবুদ আকারে বেরিয়ে আসছে। সেই জলেই তৈরি হয়েছে জলাধার। সেখানে ভক্তরা স্নান করছেন। পূজার জল নিচ্ছেন। জলাধারের নিকট প্রায় দেড় ফুট উচ্চতার একটি কালীমূর্তি অবস্থান করছে । প্রসঙ্গত বলে রাখি জৈন মার্গে কালীপূজা হয়। এই প্রত্ন স্থলে প্রাপ্ত কালীকে বামা কালী বলে অভিহিত করা হয়। মন্দির প্রাঙ্গণে উপনয়,ন বিবাহ প্রকৃতি নানান সামাজিক কাজ অনুষ্ঠিত হয় । বিভিন্ন মানুষ মনস্কামনা পূরণের উদ্দেশ্যে বহু মানত করেন প্রতিদিন । অনেকে ফল লাভও করেন ।
উপরোক্ত গ্রাম গুলি ছাড়াও পুরুলিয়ার অজস্র গ্রামে যেমন – ক্রোশজুরি , দেউলি, লহরা, পাঁরুদা , ধাধকি, বীরগ্রাম , হেরবনা ইত্যাদিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অজস্র জৈন দেবদেবীর ভগ্ন ও পূর্ণাঙ্গ মূর্তি। যুগ যুগ ধরে মানুষ নিজেদের মতো করে তাঁদের আরাধনা করছেন। বছরের বিভিন্ন সময়ে পূজা পাঠ করে আসছেন। জৈন মার্গ, শিল্প স্থাপত্যের অন্তিম অস্তিত্বটুকু এইভাবে জেলার গ্রামে গ্রামে সঞ্চিত , রক্ষিত হয়ে রয়েছে । সংরক্ষিত হয়ে রয়েছে স্মৃতি। মন্ত্র, শঙ্খ ধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে আজও জৈন প্রত্নস্থল গুলি।
পুরুলিয়ার এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে নজর পড়বে না একটিও জৈন নিদর্শন ।এই ভাবেই বেঁচে বর্তে আছে মানভূমের নিদর্শনগুলো , সম্পূর্ণ আঞ্চলিক বাতাবরনের মধ্য দিয়ে ।যা হয়তো আরো কয়েক যুগ টিকে থাকবে । আসুন আমরা এই প্রত্নগুলিকে যেভাবে হোক বাঁচানোর চেষ্টা করি । এগুলি আমাদের দেশের সম্পত্তি , ঐতিহ্য , গর্ব। এগুলো রক্ষা করলে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বুকে গড়ে উঠবে মন্দির ও প্রত্নকেন্দ্রীক পর্যটন শিল্প। মানুষ উপকৃত হবে , দেশ উপকৃত হবে। দেশের সম্পত্তি কে বাঁচানো আমাদের অধিকারের মধ্যে পড়ে । যদি পারি , তাহলর শুধু কয়েক যুগ কেন , যুগ থেকে যুগান্তরে এগুলি আমাদের ঐতিহ্য কে বহন করবে।
দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ পুরুলিয়ার লৌকিক দেবদেবীর প্রাসঙ্গিকতা , জৈন মূর্তির লৌকিক দেবদেবীতে রূপান্তর এবং পূর্ব পুরুষ পূজা : সুভাষ রায়