প্রথমেই জানিয়ে রাখি, কলকাতা পৌরসভার প্রায় ৬০ টি ওয়ার্ডে এগিয়ে বিজেপি। তৃণমূল নিজের দখলে থাকা ৫০ টি ওয়ার্ডে পিছিয়ে। খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধানসভা ভবানীপুরের ৮ টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৬ টিতেই এগিয়ে বিজেপি। আপনাদের মনে হয়তো তাহলে প্রশ্ন জাগবে কলকাতায় বিজেপি হারল কেন? অনেকে বলছিলেন বিদ্যাসাগর ইস্যু নিয়ে তৃণমূল যে বাঙালিয়ানার ভাবাবেগে উস্কানি দিয়েছিল, তাতেই কি সাফল্য এসেছে?

উত্তরঃ নাহ! তবে? সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক একতরফাভাবে ঘাসফুলের প্রতীকটি বেছে নিয়েছেন। যেমনঃ দক্ষিণ কলকাতার কথায় প্রথমে আসি। এখানকার ভবানীপুর বিধানসভাই ধরুন, এখানে বিজেপি ৬৩, ৭০, ৭১, ৭২, ৭৩ এবং ৭৪ নং ওয়ার্ডে যা লীড পেয়েছিল, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ৮২ নং ওয়ার্ডে তার থেকে বেশি লীড নিয়ে নেয় তৃণমূল। একই ভাবে বালিগঞ্জ বিধানসভার অন্তর্গত ৮৫ নং ওয়ার্ড, মেয়র পারিষদ দেবাশীষ কুমারের ওয়ার্ডে পিছিয়ে পড়ে তৃণমূল। বালিগঞ্জ বিধানসভার অন্যান্য ওয়ার্ডেও তৃণমূল-বিজেপি সমানে সমানে টক্কর হয়! কিন্তু সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ৬০ এবং ৬১ নং ওয়ার্ড থেকে তৃণমূল ২৭ হাজার লীড নিয়ে বিজেপির যাবতীয় লীড ধুয়ে দেয়। সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের তেমন প্রভাব না থাকার সুবাদে একমাত্র রাসবিহারী বিধানসভায় লীড পায় বিজেপি।

কসবায় বিজেপির সমস্ত লড়াই ধ্বংস করে দেয় একটা ওয়ার্ড, ওয়ার্ড নং ৬৬। কসবার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই ওয়ার্ড থেকে ৪০ হাজার ভোটের লিড পেয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী মালা রায়। অপরদিকে বেহালার বাঙালি হিন্দু ভোট বিজেপি-তৃণমূল-সিপিএমের মধ্যে ভাগ হয়েছে। কাজেই কসবা, বালিগঞ্জ এবং পোর্টের সংখ্যালঘু ভোটই এযাত্রায় দক্ষিণ কলকাতায় তৃণমূলকে জয়ী বানিয়ে দিলো।

দক্ষিণের মতো বিজেপির চোরা স্রোত এ বার ভাসিয়ে দিয়েছে উত্তর কলকাতায় তৃণমূলের গোটা কুড়ি ওয়ার্ডকেও। ওই কেন্দ্রের তৃণমূল দলের প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় সওয়া লক্ষের বেশি ভোটে জিতলেও সেখানকার শ্যামপুকুর ও জোড়াসাঁকো বিধানসভা এলাকায় এগিয়ে গিয়েছে বিজেপি। মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্রে মাত্র ৮৬০ ভোটে ‘লিড’ পেয়েছে তৃণমূল। সংখ্যালঘু ওয়ার্ড বলে পরিচিত ৫৪ নম্বরে ১৯ হাজার, ৬২ নম্বরে বিজেপির থেকে ১৫ হাজারেরও বেশি ভোটে এগিয়ে রয়েছে শাসক দল।

উত্তর কলকাতার ৬০টি ওয়ার্ডের মধ্যে তৃণমূলের দখলে থাকা ৬, ১৩, ১৮, ২০, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ৩১, ৩৮, ৪০, ৪১ ৪২, ৪৪, ৪৭, ৫০, ৫১, ৫২, ৫৫ এবং ৫৮ নম্বরে পিছিয়ে তৃণমূল। পুরসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে ওই সব ওয়ার্ডে তারা জিতেছিল ১০০০ থেকে ১৫ হাজার পর্যন্ত ভোটে। ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, জোড়াসাঁকোর বিধায়ক স্মিতা বক্সী এ বার নিজের ওয়ার্ডে পিছিয়ে পড়েছেন চার হাজারের বেশি ভোটে। ৫৮ নম্বরে ৫০০ ভোটে পিছিয়ে পড়েছেন ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা মেয়র-পারিষদ স্বপন সমাদ্দার।

এতদসত্ত্বেও ওই লোকসভা কেন্দ্রেও তৃণমূলের জয়ের পিছনে রয়েছে এন্টালি, বেলেঘাটা, চৌরঙ্গি বিধানসভা এলাকার সংখ্যালঘু ওয়ার্ড। উদাহরণ দিচ্ছি, যেমনঃ ওয়ার্ড নং ৪৪, চৌরঙ্গী বিধানসভা। এই ওয়ার্ডে একা তৃণমূল ১৬ হাজার মতো লীড নিয়ে নেয়। ঠিক একইভাবে এন্টালি বিধানসভার ৫৪ নং ওয়ার্ড থেকে তৃণমূল ১৫ হাজার লীড নেয়! একইভাবে বেলেঘাটার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ২৮ নং ওয়ার্ড থেকে তৃণমূল সাড়ে ১৮ হাজারের লীড নেয়।

তাই সমস্ত হিসেব বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কলকাতা শহরজুড়ে সংখ্যালঘু ভোটের মেরুকরণের ওপর ভিত্তি করেই এই জোড়া জয় এসেছে তৃণমূলের।

অঙ্কন দত্ত। (মতামত ব্যক্তিগত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.