তিনি এই সমাজেরই মানুষ। যে সমাজে রাজনৈতিক ময়দান জেতার তাগিদে ভেদাভেদের উস্কানির অভিযোগ ওঠে। তিনি সেই সমাজেরই অংশ যেখানে সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু এমন বিভিন্ন ভাবে সমাজকে ভাগ করে চলে ভোটের রাজনীতি। কিন্তু তিনি এইসব ভোট ঘোঁট রাজনীতির ময়দান থেকে অনেক দূরে। ব্যস্ত থাকেন পুরনোকে বাঁচাতে। ব্যস্ত থাকেন হাজার হাজার বছরের পুরনো ইতিহাসকে বাঁচানোর লক্ষ্যে। তিনি আসাদ উজ জামান।
কলকাতা থেকে অদূরে উত্তর ২৪ পরগণার হাদিপুরের বাসিন্দা ২৫০০ বছরেরও বেশি পুরনো সভ্যতার ইতিউতি পড়ে থাকা টুকরো দিয়ে একটি ১০ফুট বাই ১২ফুট ঘরে মেঝের ওপরেই সাজিয়ে তুলেছেন তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহালয়, নাম- ‘হাদীপুর প্রত্ন মিউজিয়াম’। মধ্যবয়স্ক আসাদ উজ জামান কিছুটা লাজুক প্রকৃতির। নিজের সম্পর্কে উদাসীন থেকেও তাঁর প্রত্ন সামগ্রী সংগ্রহের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ। বলছেন “ভালো লাগে তাই সংগ্রহ করি। আর কিছু চাই না।”
দীর্ঘ ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আপন সংগৃহীত সামগ্রী সংগ্রহ করে চলেছেন। সেগুলির প্রত্যেকটিরই বয়স ১০০০এর বেশি। সংগ্রহ থেকেই কিছু কিছু জিনিস দান প্রদান করেছেন বেহালার রাজ্য প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষনের মিউজিয়ামে। এছাড়া স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যখন যে বা যাঁরা চন্দ্রকেতুগড় আসেন তাদের জন্য অবারিত দ্বারে উপস্থিত থাকেন আসাদ উহ জামান। সঙ্গে নিয়ে কয়েক হাজার প্রত্ন সামগ্রীর ডালি নিয়ে।
তিনি বলেন , “আমার কাছে ৪ হাজারের বেশি কালেকশন রয়েছে। যে যখন আসে দেখিয়ে দি।” এও জানালেন, “মাস তিনেকের মধ্যে বাড়িতেই তৈরি হয়ে যাবে সংগ্রহশালা। তবে এসব সামলানোর খরচ অনেক।” আসাদ উদ জামান বলেন , “আমি তো নিজে যা করার করছি , বাকি কাজের জন্য একটু অর্থের প্রয়োজন। যদি কেউ এগিয়ে এসে সাহায্য করে তাহলে ভালো হয়।”
ওই একই অঞ্চলে প্রতন্তাত্বিক বিযে মানুষটির নাম স্বাভাবিকভাবেই সামনে চলে আসে দিলীপ কুমার মৈতের নাম। হাশয়। সম্প্রতি ইহলোক ত্যাগ করেছেন। তবে রাজ্য সরকারের পর্যটন দফতরের আর্থিক সহায়তা ও সংসদ শ্রীমতি কাকলি ঘোষ দস্তিদারের উদ্যোগে এই অঞ্চলে মিউজিয়াম গড়ে তোলেন, যা নাম চন্দ্রকেতুগড় সংগ্রহশালা। দিলীপবাবুর প্রায় ৫০ বছরেরও অধিক সম্য ধরে সংগৃহিত প্রত্ন সামগ্রী নিয়েই প্রথমে প্রত্নসামগ্রী সংগ্রহ করে নিজের বাড়িতে গড়ে তুলেছিলেন ওনার ব্যক্তিগত মিউজিয়াম। একই পথে এগোচ্ছেন আসাদ উদ জমান। একইসঙ্গে দিলীপবাবুর লেখা “চন্দ্রকেতুগড়” এবং “ইতিহাসে দেগঙ্গা”- বই দুটি সর্বসাধারণের পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক মহলেও খুবই সমাদৃত হয়ে আসছে দীর্ধদিন ধরেই।
কলকাতা থেকে এই স্থানের দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটার। কলকাতার কাছে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার অন্তর্গত বেড়াচাঁপা, দেওলিয়া, হাদিপুর, শানপুর, ঝিকিরা প্রভৃতি গ্রামগুলিকে কতগুলি উঁচু ঢিবি ঘিরে রেখেছে। প্রায় ৩ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলকে ঘিরে রাখা এই ঢিবি গুলো একত্রে কোথাও যেন একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত দুর্গ বা গড়ের ইঙ্গিত দিয়েছে। এই স্থানটিই চন্দ্রকেতুগড়, যার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন। চন্দ্রকেতুগড় গঙ্গারিডি সভ্যতা, মৌর্য্যযুগ, কুষানযুগ, গুপ্তযুগ, পাল-সেন যুগের বিভিন্ন ঐতিহ্য বহন করে আসছে।অনুমান করা হয় চন্দ্রকেতুগড় সেই রাজত্বেরই অংশ যে অঞ্চলকে টলেমি সর্বপ্রথম গঙ্গারিডী বলে বর্ণনা করেছিলেন।
প্রত্নতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ দাবী করেন, চন্দ্রকেতুগড় একটি প্রধান নগরী ও বিদ্যাধরীর তীরে একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী বন্দর ছিল এবং এই বন্দরের মাধ্যমে গ্রীস ও রোমের সঙ্গে বাণিজ্যিক আদান প্রদান চলত। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎক্ষননের সূত্রে জানা যায় যে চন্দ্রকেতুগড়ে প্রাক-মৌর্য যুগ থেকে গুপ্ত যুগ পর্যন্ত, এমনকি পাল যুগ পর্যন্ত আগাগোড়া ধারাবাহিক বসতি ছিল, অর্থাৎ খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে খ্রীষ্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত অথবা তারও বেশী সময় জুড়ে এই সভ্যতার কালানুক্রম।