১৯০২ সালের ৪ জুলাই, তাঁর মহাপ্রয়াণের দিন স্বামীজি অত্যন্ত সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়েছিলেন। বেলুড় মঠের প্রার্থনা গৃহে তিন ঘণ্টা ধ্যান করেন তিনি। এরপর ছাত্রদের শুক্লা-যজুর্বেদ, সংস্কৃত ব্যকরণ ও দর্শনশাস্ত্র শেখান। পরে স্বামী প্রেমানন্দের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করেন তিনি, আলোচনা করেন রামকৃষ্ণ মঠের ভবিষ্যত্ নিয়ে। সেদিন বেলুড়ঘাটে জেলের নৌকো ভিড়েছিল। নৌকো ভর্তি গঙ্গার ইলিশ মহোত্সাহে কিনিয়েছেন বিবেকানন্দ। সবার সঙ্গে বসে দুপুরে খেয়েছেন ইলিশের নানা পদ। সন্ধে ৭টা নাগাদ নিজের ঘরে চলে যান তিনি। বলে যান, এখন কেউ যেন তাঁকে বিরক্ত না করে। ঘরে গিয়ে ধ্যানে বসেন তিনি। ধ্যান করতে করতেই রাত ৯টা ১০ মিনিটে আনন্দলোকে যাত্রা করেন বিবেকানন্দ।
স্বামীজির শেষ জীবনে, যখন তাঁর শরীর ক্রমশই ভেঙে পড়ছে, নিবেদিতা ছায়ায় মতো তাঁর অনুগামী। ১৮৯৮ সালে স্বামীজি-সঙ্গের কথা মর্মস্পর্শী ভাষায় ধরা আছে নিবেদিতার ‘স্বামীজির সহিত হিমালয়ে’ গ্রন্থে। ওই বছরই স্বামীজির শেষবারের মতো হিমালয়ে যাওয়া। শৈবতীর্থ অমরনাথে শিবের কাছে স্বামীজি ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়েছিলেন। গুহা থেকে বেরিয়ে প্রিয় শিষ্যাকেই তিনি প্রথম সে কথা জানান। স্বামীজির মর্ত্যজীবনের এই পরম প্রার্থনাটির কথা জেনে বিস্মিত হন নিবেদিতা। আরও বিস্মিত হন স্বামীজি যখন বলেন, তাঁর এ বার হিমালয়ে আসার অন্যতম উদ্দেশ্য শিবসুন্দরের কাছেই নিবেদিতাকে উৎসর্গ করা তাঁর জীবনব্রত উদ্যাপনের জন্য। আমরা জানি, হিমালয় তীর্থে সেই দুটি প্রার্থনাই পূরণ হয়েছিল বিবেকানন্দ ও তাঁর মানসকন্যা নিবেদিতার জীবনে।
১৯০২ সালের ৪ জুলাই স্বামীজির সেই প্রথম ইচ্ছাপূরণের দিনটি এল। সে দিন শুক্রবার। বেলুড় মঠে সন্ধ্যায় মন্দিরের প্রার্থনার সময় স্বামীজি তাঁর নিজের ঘরে ধ্যানাসনে বসে রাত ৯টায় শান্তভাবে মহাসমাধি লাভ করেন। সেই অনিন্দ্যসুন্দর দিব্যকান্তি মুখমণ্ডল দেখে প্রথমে কেউ বুঝতেই পারেননি যে, এ স্বামীজির অমৃতধামযাত্রা তথা দু’বছর আগে হিমালয়তীর্থ অমরনাথধামে তুষারলিঙ্গ মহাদেবের কাছে গিয়ে তাঁর ইচ্ছামৃত্যু প্রার্থনার ‘প্র্যাক্টিক্যাল ডিমনস্ট্রেশন’।
কিন্তু বিবেকানন্দের কাছে জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য হলেও তাঁর জীবনব্রত উদ্যাপনের জন্য যাঁদের রেখে গেলেন, এর পর তাঁদের কী হবে বা হল? এ বার সে কথাই।
পরদিন ৫ জুলাই, শনিবার। তখন ভগিনী নিবেদিতার ঠিকানা ১৬ নন্বর বাগবাজার লেন। সকাল ৯টা নাগাদ বেলুড় মঠ থেকে একটা ছোট চিঠি পান স্বামী সারদানন্দজি স্বাক্ষরিত নিম্নলিখিত বয়ানে-‘-‘মাই ডিয়ার নিবেদিতা, দ্য এন্ড হ্যাজ কাম, স্বামীজি হ্যাজ স্লেপ্ট লাস্ট নাইট অ্যাট নাইন ও’ক্লক। নেভার টু রাইজ এগেন সারদানন্দ’’।
চিঠির অক্ষরগুলি যেন চোখের সামনে কাঁপছে নিবেদিতার, সঙ্গে শরীরটাও। ঘরে উপস্থিত নিবেদিতার সেবিকাও কেঁদে উঠলেন। মাত্র দু’দিন আগেই তো নিবেদিতা বেলুড় মঠে গিয়েছিলেন স্বামীজিরই নিমন্ত্রণে। স্বামীজি তাঁদের খাইয়েছিলেন পরম যত্নে এবং আহার শেষে স্বামীজি অতিথিদের হাতে জল ঢেলে দিয়েছিলেন হাত ধোওয়ার জন্য। নিবেদিতা সঙ্কুচিত হয়েছিলেন। স্বামীজি বলেছিলেন, “যিশু তো শিষ্যদের পা ধুইয়ে দিয়েছিলেন।” কিন্তু সে তো শেষের দিনে। তখন নিবেদিতা ভাবতেও পারেননি, তাঁর গুরুর ক্ষেত্রেও এই কথাটা আক্ষরিক অর্থেই মিলে যাবে।
স্বামীজি কিন্তু অমরনাথে নিবেদিতাকে আভাস দিয়েই রেখেছিলেন, মহাদেব-কৃপায় তিনি ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়েছেন। যার নিহিত অর্থ হল, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত না হলে তাঁর দেহত্যাগ হবে না। স্বামীজির মহাসমাধির পূর্ব পর্যন্ত আনুপূর্বিক সব কথা শুনে নিবেদিতার সে-সব কথাই মনে পড়ছিল। এক দিকে নিবেদিতার শোকস্তব্ধ উদ্গত নয়নের অশ্রুধারা, আর এক দিকে এই সব স্মৃতি। নিবেদিতা আর কালবিলম্ব না করেই বেলুড় থেকে আসা পত্রবাহকের সঙ্গেই রওনা হলেন বেলুড় মঠ অভিমুখে।
ইতিমধ্যে স্বামীজির প্রয়াণের খবর ছড়িয়ে গিয়েছে সারা শহরে। সবাই ছুটছে সেই বেলুড়ের দিকে। বেলুড় মঠে পৌঁছেই নিবেদিতা সোজা উঠে গেলেন দোতলায় স্বামীজির ঘরের দিকে। ঘরে তখন বেশি লোকজন নেই। স্বামীজির দেহটি মেঝেতে শায়িত হলুদ রঙের ফুলমালা আচ্ছাদিত হয়ে। মানসকন্যা স্বামীজির শিয়রের কাছে বসে পড়েন। নয়নে অবিরল অশ্রুধারা, মুখে কোনও কথা নেই। আবেগ-আকুল কম্পিত হাতে তুলে নেন গতপ্রাণ স্বামীজির মাথাটি। এখন আর তিনি কন্যা নন, তিনি মাতা! স্বামীজির তাঁর প্রতি আশীর্বচনের সার্থক রূপ একাধারে তিনি সেবিকা ও মাতা। যেন মায়ের মতোই প্রিয়বিচ্ছেদ-বেদনায় কাতর হয়ে সেই অনিন্দ্যসুন্দর শিবরূপী গুরুর সেবা করতে থাকেন ছোট একটি পাখা হাতে।
এর পর সেই মহাযাত্রার পালা। একে একে সন্ন্যাসী-ভাইরা এসে স্বামীজির দেহটি নীচে নামিয়ে আনেন। আরতি ও প্রণাম-শেষে পা দু’টি অলক্তরাগে রঞ্জিত করেন ও মস্তক অবলুণ্ঠিত করে প্রণাম করেন। গুরুভাইরা শ্রীপাদপদ্মের ছাপ নেন। নিবেদিতাও অশ্রুসিক্ত নয়নে পা দুটি ধুয়ে একটি পরিষ্কার রেশমি রুমালে তাঁর গুরুর পদচিহ্ন গ্রহণ করেন। সন্ন্যাসী ও সমবেত জনতার সঙ্গে নিবেদিতাও চলেন পায়ে পায়ে সেই গতপ্রাণ বিজয়ী বীরের দেহটি নিয়ে মিছিলের সঙ্গে সঙ্গে। স্বামীজির শেষকৃত্য সমাপনের নির্দিষ্ট স্থানে, যে স্থান বিবেকানন্দ নিজেই চিহ্নিত করেছিলেন মহাপ্রয়াণের কিছু দিন আগে, তাঁর প্রিয় বেলগাছের কাছে অপেক্ষাকৃত ঢালু জায়গায়।
দেহটি নামানো হলে নিবেদিতা সেই গাছেরই একটু দূরে এসে বসে পড়েন। চিতাগ্নি প্রজ্বলিত করেন প্রথমে নিবেদিতা ও পরে একে একে গুরুভাই ও অন্যান্য সন্ন্যাসী-ভাইয়েরা।
প্রজ্বলিত চিতাগ্নির সামনে বিবেকানন্দের প্রিয় ‘জি.সি’ অর্থাৎ নাট্যকার ও মহাকবি গিরিশচন্দ্রের বিলাপ, “নরেন, তুমি তো ঠাকুরের ছেলে, ঠাকুরের কোলে গিয়ে উঠলে। আর আমি বুড়ো মানুষ, কোথায় তোমার আগে যাব, তা না হয়ে আজ আমাকে দেখতে হচ্ছে তোমার এই দৃশ্য। !” এ কথা শোনামাত্র নিবেদিতা শোক চেপে রাখতে না পেরে দাঁড়িয়ে উঠে স্বামীজির প্রজ্বলিত চিতাগ্নির পাশে প্রদক্ষিণ করতে লাগলেন। এ দৃশ্যে বিচলিত স্বামী ব্রহ্মানন্দজি স্বামীজির শিষ্য নিশ্চলানন্দকে নিবেদিতাকে চিতাগ্নির কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে সান্ত্বনা দিতে বলেন। সেই অনুযায়ী নিশ্চলানন্দ রোরুদ্যমানা নিবেদিতাকে সেখান থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে, নানা সান্ত্বনাবাক্যে ভোলাতে লাগলেন।
সারা অঙ্গ চন্দনচর্চিত মনুষ্যদেহে তাঁর শিবরূপী গুরুর ধূপধুনো-গুগগুল সুবাসিত চিতাগ্নি তথা হোমাগ্নি নিবেদিতার অনর্গল নয়নধারায় বুঝি নির্বাপিত করতে চান। সেই হৃদয় হাহাকার করা মুহূর্তে সহসা গুরুর এক অলৌকিক স্নেহস্পর্শ নিবেদিতাকে চমকিত করে।
চিতাগ্নি থেকে একখণ্ড গেরুয়া বস্ত্র হাওয়ায় উড়ে এসে নিবেদিতার কোলে গিয়ে পড়ে। পরম মমতায় ও যত্নে নিবেদিতা তা গুরুর আশীর্বাদ ভেবে মাথায় ঠেকান। সেই পবিত্র স্পর্শ যেন শোকস্তব্ধ হৃদয়ে সান্ত্বনা ও শক্তি জোগায়। তবু অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠেন“পরের জন্য নিজেকে যিনি বিলিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁকেও কেন ছেড়ে দিতে হয় আমাদের? হে ভগবান, কেন?”