মোহিত রায়
এ বছর (২০২১) মার্চের শেষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশ সফরে গেলেন। মূল অনুষ্ঠান ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির অর্ধ শতবর্ষ উদযাপন। নরেন্দ্র মোদী পৌঁছনোর আগেই বাংলাদেশের পুরাতন শ্রীহট্ট জেলার সুনামগঞ্জ এলাকার শল্লা গ্রামে ইসলামী মৌলবাদীরা হিন্দুদের উপর আক্রমণ চালায়, কয়েকশ বাড়ীঘর ভাঙচুর লুটপাট করে। হিন্দুরা আক্রমণের খবর পেয়ে আগেই পালিয়ে যাওয়ায় হতাহতের খবর পাওয়া যায় নি। এরপর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশে আগমনের বিরোধিতা করে ইসলামী মৌলবাদীর হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা ধ্বংসাত্মক আন্দোলন শুরু করলে চট্টগ্রামে বেশ কয়েকজন পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। এর ফলে বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের উপর আক্রমণ শুরু হয়েছে।
এসবের বিস্তৃত বিবরণে গিয়ে কোন লাভ নেই, উৎসাহী পাঠক চেষ্টা করলেই ইন্টারনেটে সব খবর পেয়ে যাবেন। আর এসব হটাত ঘটে যাওয়া কোন নতুন ঘটনাও নয়। এরকম আক্রমণ চলছেই। দুর্গা পূজার আগে পরে অনেক জায়গায় মূর্তি ভাঙা হবে, ফেসবুকে মন্তব্যের অজুহাতে হিন্দুদের ঘরবাড়ী জ্বালানো হবে, নিয়মিত হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ বা জোর করে বিয়ে করা হবে, মন্দির ভাঙা হবে। বাংলাদেশে যে সরকারই থাকুক না তারা কিছু করবে না। এটা চলবে, বাংলাদেশের হিন্দুদের অন্য কোন ভবিষ্যৎ নেই। কেনই বা বাংলাদেশের হিন্দুদের কোন ভবিষ্যৎ থাকবে? বাংলাদেশে হিন্দুরা এখন মাত্র ৮ শতাংশ, হিন্দুদের কোন জঙ্গী সন্ত্রাসবাদী দল নেই। সুতরাং ইসলামের কর্তব্য অনুযায়ী ইসলামী মৌলবাদীরা তাদের আক্রমণ চালানোইটা স্বাভাবিক ঘটনা। বাংলাদেশের হিন্দুদের একমাত্র ভরসা পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা। দেখা যাক তারা কি করছে?
নিজেদের জন্য প্রশ্নমালা
১) সংবাদমাধ্যম – এই যে এতসব ঘটনা বাংলা দেশে ঘটেই চলেছে পশ্চিমবঙ্গের প্রধান তিনটি বাংলা সংবাদপত্রে তার কোন বিবরণ কি প্রকাশিত হয়? কোন পত্রিকায় এসব নিয়ে সম্পাদকীর লেখা হয়? হয় না। বরং বাংলাদেশ যে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ দেশ তা নিয়ে সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় নিবন্ধ ছাপা হয়। সুতরাং বাংলাদেশ সরকার ও ইসলামী মৌলবাদীরা জানে হিন্দুদের উপর অত্যাচার নিয়ে কেউ কিছু বলবে না।
২) রাজনৈতিক দল – পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক দলগুলি কি বাংলাদেশের হিন্দুদের নিয়ে ভাবে? না। পশ্চিমবঙ্গের কোন রাজনৈতিক দলে বাংলাদেশ নিয়ে কোন সাংগঠনিক প্রকোষ্ঠ নেই। কোন রাজনৈতিক দলের বাংলাদেশের হিন্দুদের নিয়ে কোন ভাবনা নেই। এইসব অত্যাচার হলে কোন রাজনৈতিক দল বড় কোন বিক্ষোভ জমায়েত করে না। বাংলাদেশ হাই কমিশনের সামনে বিক্ষোভ, ডেপুটেশন কদাচিৎ হয়। এককথায় বাংলাদেশের হিন্দুরা যেহেতু ভোটার নয় তাঁদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু ফেলবারও কোন দল প্রয়োজন মনে করে না। হিন্দু উদ্বাস্তুদের নিয়ে যেটুকু হৈচৈ হয় তা কেবলমাত্র তাদের ভোটের জন্য, কেন তাঁরা উদ্বাস্তু হলেন তা নিয়ে কারো মাথাব্যাথা থাকে না। সুতরাং বাংলাদেশ সরকার ও ইসলামী মৌলবাদীরা জানে হিন্দুদের উপর অত্যাচার নিয়ে কোন রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হবে না।
৩) হিন্দু ধর্মীয় সংগঠন – পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু ধর্মীয় সংগঠনগুলি কি বাংলাদেশের হিন্দুদের নিয়ে ভাবে? না। কোনদিন শুনেছেন রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম, ইসকন, লোকনাথ-অনুকূল-বালক ইত্যাদির সন্ন্যাসী ও ভক্তরা বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে পদযাত্রা করছে, জনসাধারণের কাছে এসে তাদের বক্তব্য জানাচ্ছে, খোল করতাল নিয়ে বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে সংকীর্তন করছে? এরা হিন্দুদের, উদ্বাস্তুদের টাকায় বিরাট প্রাসাদ বানিয়েছে, একধরণের ধর্মীয় ব্যবসা চালাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের উপর আক্রমণ হলে এরা কিছু বলে না এমনকি ত্রাণ পর্যন্ত নিয়ে যায় না। এদের প্রায় সবার বাংলাদেশে শাখা আছে ফলে ব্যবসায়িক কারণেও এরা কিছু বলবে না। এমনকি সরাসরি ইসলামী অত্যাচারে উদ্বাস্তু হওয়া মতুয়া সম্প্রদায়ের ধ্রমীয় নেতৃত্ব জাতপাতের খেলায় মত্ত থাকেন কিন্তু বাংলাদেশে নিজেদের ভাইবোনেদের উপর আক্রমণ হলে ডঙ্কা নিশান নিয়ে পথে নামতে দেখা যায় না। সুতরাং বাংলাদেশ সরকার ও ইসলামী মৌলবাদীরা জানে হিন্দুদের উপর অত্যাচার নিয়ে কোন ধর্মীয় প্রতিক্রিয়া হবে না।
৪) হিন্দুত্ববাদী সংগঠন – পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি কি বাংলাদেশের হিন্দুদের নিয়ে ভাবে? ভাবে কিন্তু তেমন কিছু করে না বা করে উঠতে পারে না। এরা লেখালেখি, সেমিনার করেন কিন্তু পথে নামেন কদাচিৎ যদিও এদের প্রচারপত্রে লক্ষ লক্ষ সদস্য, শাখা, কার্যক্রমের বিবৃতি থাকে। সুতরাং বাংলাদেশ সরকার ও ইসলামী মৌলবাদীরা জানে হিন্দুদের উপর অত্যাচার নিয়ে কোন পথে নেমে কোন প্রতিক্রিয়া হবে না।
৫) রাজ্য সরকার – পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার কি বাংলাদেশের হিন্দুদের নিয়ে ভাবে? এখন পর্যন্ত কোন সরকার ভাবে নি, আগামীদিনে ভাববে কিনা তা বলার সময় আসে নি। সুতরাং বাংলাদেশ সরকার ও ইসলামী মৌলবাদীরা জানে হিন্দুদের উপর অত্যাচার নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোন প্রতিক্রিয়া হবে না।
৬) কেন্দ্রীয় সরকার – কেন্দ্রীয় সরকার কি বাংলাদেশের হিন্দুদের নিয়ে ভাবে? সেরকম কিছু ভাবে বলে মনে হয় না। কেন্দ্রীয় সরকারের না ভাবার মূল কারণ হল পশ্চিমবঙ্গে যখন কোন রাজনৈতিক দলের এ নিয়ে মাথাব্যাথা নেই, কোন জন আন্দোলন নেই, ফলে তারা আগবাড়িয়ে মাথাঘামাতে যাবে কেন? সুতরাং বাংলাদেশ সরকার ও ইসলামী মৌলবাদীরা জানে হিন্দুদের উপর অত্যাচার নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কোন প্রতিক্রিয়া হবে না।
বাংলাদেশ সরকার ও ইসলামী মৌলবাদীরা জানে হিন্দুদের উপর অত্যাচার নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের কোন মাথাব্যাথা নেই। এইসব নিবন্ধ লেখা হবে, ফেসবুক ইউটিউবে হৈ চৈ হবে, ওয়েবিনার হবে, ব্যস। সুতরাং বাংলাদেশের হিন্দুদের আপাতত কোন ভবিষ্যৎ নেই।