দক্ষিণ কলকাতায় আলিপুরে ভবানী ভবন দেখেছেন নিশ্চয়ই ? না দেখলেও কাগজে পড়েছেন। মাঝে মাঝেই শোনা যায় কোন VIP কে ডেকে পাঠানো হয়েছে ওই বাড়িতে যা কিনা এখন রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশের সদর দফতর । কিন্তু কে এই ভবানী যার নামে বাড়িটির নামকরণ ?
সন ১৯৩২….. বাঙালি বিপ্লবীদের কাছে একরকম নাকানিচুবানি খেয়ে ব্রিটিশ সরকার গভর্নর করে নিয়ে এলো স্যার জন অ্যান্ডারসনকে। এই সেই স্কটিশ সাহেব যিনি বিভাজনের নীতি অবলম্বন করে আয়ারল্যান্ডের সিনফিন আন্দোলন দমন করতে পেরেছিলেন।
শাসকরূপে অ্যান্ডারসনকে কাছে পেয়ে বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্স, ইউরোপিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, স্টেটসম্যান, ইংলিশম্যান সহ সরকারের ধামাধরা কাগজ ও সংস্থা গুলোর সে কী আস্ফালন!
সরকারি তথ্য বলছে, ওই ইংরেজ শাসকের নামে আলিপুরে অ্যান্ডারসন হাউস গড়ে তুলেছিল ব্রিটিশেরা, পরবর্তী কালে যা পরিণত হয় রাজ্য পুলিশের সদর দপ্তরে।
ফিরে যাই সেই সময়ে….গভর্নর সাহেব প্রথমেই গাঁয়ে গাঁয়ে তৈরি করলেন ‘ভিলেজ গার্ড বাহিনী’। অর্থাৎ এখন থেকে তারাই হলো গাঁয়ের মাতব্বর। এদের কাজ বিপ্লবীদের দিকে একটু ভালো করে নজর রাখা। সন্দেহজনক কিছু দেখলেই ধরিয়ে দেওয়া আর সরকার বাহাদুরের কাছ থেকে পুরস্কার নেওয়া।
এনার আমলেই দার্জিলিংকে গ্রীষ্মকালীন রাজধানীতে পরিণত করা হয়। তিনি তখন সেখানে। দলের নির্দেশে তাকে শিক্ষা দিতে এগিয়ে এলেন ঢাকার বি ভি শাখার বিপ্লবীরা। ঢাকা থেকে কলকাতা হয়ে দার্জিলিং অভিমুখে রওয়ানা হলেন উজ্জ্বলা মজুমদার ও মনোরঞ্জন ব্যানার্জি। মূল দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের হাতে তৈরি রবি ব্যানার্জি আর ভবানী ভট্টাচার্য কে। প্রথমে চেষ্টা করা হল ফ্লাওয়ার শো একজিবিশনে। কিন্তু ঠিক সুবিধে হল না, সুযোগের অপেক্ষায় রইলেন তাঁরা।
৮ই মে, ১৯৩৪ সালে লেবং-এর ঘোড়দৌড়ের মাঠ। অ্যান্ডারসন এসেছেন বিজয়ীদলকে পুরস্কার বিতরণ করতে। যথাসময়ে ভবানী ভট্টাচার্য আর রবি ব্যানার্জি দর্শকের টিকিট কেটে ঢুকলেন মাঠের ভিতরে। তাঁদের আসন গ্রহণ করতে দেখেই মনোরঞ্জন ব্যানার্জি আর উজ্জ্বলা মজুমদার ফিরে গেলেন শিলিগুড়ি স্টেশনের দিকে।
গভর্নরের আসনের ঠিক ডান পাশে দর্শকদের স্থান মাঝখানে একটু নীচু দেওয়াল। দর্শকদের মধ্যে বেশরভাগই শ্বেতাঙ্গ ও দেশীয় রাজা মহারাজার দল। আর রয়েছে অজস্র পুলিশ এবং সাদা পোশাকে গুপ্তচর।
ঘোড়াদৌড়ের পালা শেষ। এবার পুরস্কার বিতরণের পালা। লাট সাহেব উঠে দাঁড়ালেন আসন ছেড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ভবানী ভট্টাচার্যও উঠে দাঁড়ালেন । দূরত্ব অনেকটা ছিল এবং তাঁর চারপাশে ছিল পুলিশ, গুপ্তচর, সাহেব আর মেমসাহেবের দল। এগোতে গেলেই তারা সন্দেহ করবে। সুতরাং তিনি লক্ষ্য স্থির করলেন ওইখান থেকেই। গর্জে উঠল ভবানীর রিভলভার কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল চিৎকার চেঁচামিচি। গভর্নরের দেহরক্ষী তখনই পরপর গুলিবর্ষণ করলো ভবানীকে লক্ষ্য করে। ঢলে পড়লেন উনি গুরুতর আহত হয়ে। সঙ্গে সঙ্গে রবির রিভলভার শুরু করল আগুন ঝরাতে। গুলিতে বিদ্ধ হয়ে পড়ে গেলেন গভর্নরের স্টেনো মিস থর্টন এবং এক শ্বেতাঙ্গ সার্জেন্ট। আচমকা রবির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল দেহরক্ষীর দল। ততক্ষণে ওর রিভলবারের গুলিও শেষ। ধরা পড়লো রবি এবং গুরুতর আহত ভবানী। অচৈতন্য ভবানীকে হাসপাতালে পাঠানো হল। হাসপাতালে জ্ঞান ফিরতে ভবানী বলে উঠলেন, ‘ইজ অ্যান্ডারসন স্টিল অ্যালাইভ?’
স্পেশাল ট্রাইবুনালে মামলা শুরু হয়। বিচারে ভবানী, মনোরঞ্জন ও রবির ফাঁসির হুকুম হয়, উজ্জ্বলার সাজা হয় বিশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। হাইকোর্টের আপিলের রায়ে ভবানী ভট্টাচার্যের ফাঁসির হুকুম বহাল রইল। মনোরঞ্জন ব্যানার্জি ও রবি ব্যানার্জির ২০ বছর এবং উজ্জ্বলা মজুমদারের ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়।
১৯৩৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি, রাজশাহি সেন্ট্রাল জেল। ফাঁসির মঞ্চে জীবনের গান গেয়ে যাবার তালিকায় আরও একটি নাম যোগ হলো………. বরিশালের ভবানী ভট্টাচার্য্য । বয়স হয়েছিল মাত্র একুশ।
তাঁরই সম্মানে ১৯৬৯ সালে অ্যান্ডারসন হাউসের নাম বদলে হয়েছে আজকের ভবানী ভবন।
সংকলনে – স্বপন সেন
তথ্যসূত্র : আমি সুভাষ বলছি