পুজো এখন এক লক্ষ কোটি টাকা কিংবা তার থেকেও বেশি অঙ্কের ব্যবসা। এমনটা সব ধর্মেই হয়। মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ যে বিভিন্ন সময় উৎসব করেন তারও একটা বাজার আছে। রোজার সময় সন্ধেবেলা জিভে জল আনা খাবারের গন্ধ বিনা পয়সায় শোঁকা যেতেই পারে, কিন্তু কিনে খেতে গেলে পয়সা লাগবেই। ফলে ব্যবসা সেখানে অবধারিত।
বছরের কিছু বিশেষ দিনে মক্কা মদিনা যাওয়ার বিষয়টিতেও অর্থনীতি জড়িয়ে আছে অনেকটা। খ্রিস্টানদের কাছে বড়দিন মানে তো বিশ্বজোড়া বিশাল উৎসব। ইউরোপ কিংবা আমেরিকায় কেনাকাটা বেড়ে যায় সাংঘাতিক মাত্রায়। অর্থনীতিতে তার সুফল বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। ফলে আমাদের রাজ্যে দুর্গাপুজো নিয়ে যে হইচই তাতে অবাক হওয়ার খুব কারণ নেই। আপাতত সে পুজো শেষ, কিন্তু রেশ রয়ে গেছে সর্বত্র।
তবে কিছু বিষয় বদলেছে, যে-কথায় আমরা একে একে আসব। তার মধ্যে প্রথম হল পুজো শেষের বিষণ্ণতা। আশির দশকে যাঁরা কিশোর কিংবা যুবক ছিলেন তাঁদের মনে থাকবেই একাদশীর দিনটার কথা। ফাঁকা পুজো প্যান্ডেল। এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে পিতৃপরিচয়হীন ফুলের টুকরো, কাত হয়ে বিশ্রাম নেওয়া ঘট, তার মুখ থেকে গড়িয়ে পড়া গঙ্গাজল, ভিজে ধুলোর কাদা আর ধুনোমাখা পোড়া নারকোলের খোল। মা তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে কৈলাসে ফিরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা, মফস্সল শহর, কিংবা গ্রামবাংলার প্রতিটি হিন্দু বাঙালির বুকটা একেবারে খালি হয়ে যেত। শেষ শরতের আবছা বিকেলে ঝুপ করে সন্ধে নামত এই বাংলায়।
লক্ষীপুজোও হবে একই মণ্ডপে, তার আগে কেউ থানইটের উপর একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে দিতেন। একটু দূরে সদ্য গোঁফ ওঠা ছেলেদের আড্ডায় উচ্ছ্বলতার অভাব প্রত্যক্ষ করা যেত প্রতি মুহূর্তে। পুজো শেষের সেই বিষণ্ণতা একেবারে হারিয়ে ফেলেছে বাংলার শহর আর শহরতলি। হয়তো-বা কলকাতা থেকে বহু দূরের কোনও এক গ্রামে এখনও পুজো শেষের অন্য গন্ধ ভেসে বেড়ায়। কিন্তু, গত কয়েক দশকে বদলে যাওয়া এই বাংলায় পুজোর সনাতন সংস্কৃতি হারিয়ে গেছে একেবারেই।
এই আলোচনায় অবশ্যই বলতে হয় পুজো উদ্বোধনের কথা। রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের ফিতে কাটার চোটে পুজো আসার সঠিক সময়টাই গুলিয়ে গিয়েছে শহর থেকে শহরতলিতে। কলকাতার বিভিন্ন পুজোমণ্ডপে এই সহস্রাব্দের শুরুতেও প্রতিমা আনা হতো পঞ্চমীর দিন। খুব তাড়াতাড়ি হলে চতুর্থী। দায়িত্ব নিয়ে ঢাকা থাকত প্রতিটি প্রতিমার মুখ। অনেক সময় সেই তালিকায় ইঁদুর, প্যাঁচা, হাঁস, ময়ূরও মুখ লুকোত। বোধনের আগে যথেষ্ট ভক্তিসহকারে উন্মোচিত হতো সেই আবরণ। বড় নেতা নেত্রী থাকতেন না, কিন্তু অনেক বেশি আদর করে ডাকা হতো এই বাংলার ঘরের মেয়ে আর তাঁর ছানাপোনাদের। মায়ের পিছনের দিকে মাথার উপর প্যান্ডেলের সঙ্গে আটকে ঝোলানো থাকত কাঁচে বাঁধানো শিবের ছবি।
এখন শিবের কথা ভুলেই যাচ্ছেন অনেকে, কোথাও-বা আকাশছোঁয়া প্রতিমার চালচিত্রে যেখানে সেখানে শিব এবং সঙ্গে অন্যান্য অনেক দেবদেবীর কোলাজ। হিন্দু বাঙালির জিজ্ঞেস করার জোরটুকুও চলে গেছে যে হচ্ছেটা কী? দেবীপক্ষ দূরে থাক, মহালয়ার আগেই হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে মাকে! সঙ্গে অসহায় তাঁর দুই ছেলে, দুই মেয়ে। কৈলাসের অমাবস্যা ভুলে হ্যালোজেনের তীব্রতায় গোটা পরিবারের চোখে এবার মহালয়ায় কালো চশমা লাগাতে হবে।
অন্যকোনও ধর্মে এভাবে বিব্রত হতে হয় না আরাধ্যা দেবীকে। কখনও দেখেছেন কি যে মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন এই সমস্ত ধর্মের মানুষ তাদের নির্দিষ্ট আরাধনার সময়ের সাতদিন আগে থেকে হইচই শুরু করেছেন পুরোদমে? ধর্ম সমাজকে ধারণ করে, ধরে রাখে তার সংস্কৃতি, তার আচার। দেবতাকে ভয় পেতে হবে এমনটা আধুনিক বিশ্বে না-হওয়াই ভালো। কিন্তু তা বলে নিজেদের দেবতাকে হেলাফেলা করাটাও ভালো কথা নয়।
হিন্দুদের আরাধনার ক্ষেত্রেও নিয়ম বিশেষ বদলায়নি অন্য রাজ্যে। দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন উৎসব, মুম্বইয়ের গণেশ চতুর্থী ইত্যাদিতে জাঁকজমক হয়তো আগের থেকে বেড়েছে অনেক, কিন্তু অকারণে দিন বেড়ে যায়নি পুজোর। দেবতাকে অস্বীকার করে আরাধনার তিথি ক্যালেন্ডারে আঘাত করে নি যখন তখন।
ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি থাকে সবসময়েই। ধর্মকে হাতিয়ার করেই বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক সন্ত্রাসবাদী হানাদারির। চলছে দেশে দেশে যুদ্ধ। ভারতের জায়গায় জায়গায় হিন্দু ধর্মের আরাধনায় রাজনীতিবিদদের শক্তিপ্রদর্শন কোনও নতুন কথা নয়। ধর্মের নামে মানুষের উপর অত্যাচারে ভারতের অন্যান্য রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের থেকে পিছিয়ে নেই মোটেই। কিন্তু সেখানে পুজোর নিয়মকানুনটুকু অন্তত নিষ্ঠার সঙ্গে পালিত হয় বলেই খবর।
অন্যদিকে, হিন্দু বাঙালি উদারনীতিতে বিশ্বাসী, এবং প্রগতিশীল। তাই তো আমরা দেখেছি, আমেরিকা বা ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় প্রবাসী বাঙালিরা পুজো করছেন দিন বদলে দিয়ে, সপ্তাহান্তে, তিথি নক্ষত্র না-মেনে। তাঁরা নিজেরাই ঠিক করেছেন যে বিদেশে নিয়ম নাস্তি। সে তো না-হয় মেনে নেওয়া গেল কাজের প্রয়োজনে, প্রগতিশীলতার যুক্তিতে, প্রবাসী বাঙালির বাধ্যবাধকতায়।
কিন্তু কলকাতায় পুজোর হপ্তাখানেক আগে থেকে রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের একাংশের মণ্ডপে মণ্ডপে হানাদারির উদ্দেশ্য কী? বিজয়া দশমীর পরেও তিন চারদিন ধরে ভাসানের প্রস্তুতি—এসব করে লাভটা কী হচ্ছে? রাজ্য সরকারের যুক্তি, এর ফলে উৎসাহিত হবেন পর্যটকেরা। কিন্তু সেরকম কোন পরিসংখ্যান কি খুঁজে পাওয়া গেছে? কলকাতায় আসার ট্রেনে বা বিমানে পুজোর মুখে যাঁরা ঘরে ফেরেন তাঁদের বেশিরভাগই হিন্দু বাঙালি। পুজোর পর তাঁরাই আবার কাজের জায়গায় ফিরে যান। অন্যদিকে ভ্রমণ-প্রিয় বাঙালিই বাইরে ঘুরতে যান এই সময়, তাঁরাই আবার ঘরে ফেরেন পুজো শেষে। অর্থাৎ পুজো পরিক্রমায় অন্য দেশ বা অন্য রাজ্য থেকে প্রচুর মানুষ এই রাজ্যে সম্পদ বিতরণ করে যাচ্ছেন এরকম কোন খবর আছে কি?
কেন্দ্রীয় সরকারের ট্রিলিয়ন ডলার বাজেটের সঙ্গে লড়তে চাওয়া এরাজ্যের শারদীয়া লক্ষ কোটি টাকার অর্থনীতির গল্প তাই বাঙালির পকেট কেটেই। তার একটা অংশ এই উৎসবের মরশুমে নিম্নবিত্ত বাঙালির কাছেও পৌঁছচ্ছে—আধা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেটুকুই এরাজ্যের মঙ্গল।
রাজ্য-রাজনীতির আলোচনায় বারবার এসেছে কর্মদিবস নষ্টের কথা। এদিকে পুজোর সময় দিন অপচয়ের ছড়াছড়ি। বাম রাজত্বে সিপিএম বাকি সমস্ত বিষয়ে দখলদারি বজায় রাখলেও, দুর্গাপুজোটা কংগ্রেস নেতাদের জন্যে ছেড়ে রেখেছিল। তারাই এখন তৃণমূলে। বামেদের অল্প কিছু পুজো কাঁপানো নেতাও সঠিক বিবর্তনে তৃণমূলে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তবে ২০১১-র আগে পুজো পরিচালনায় দক্ষ নেতানেত্রীদের তৃণমূলে আশ্রয় নিতে সময় লেগেছে অনেকটা। এই বিবর্তনের গতি ছিল ধীর। গত কয়েকবছরে এই রাজ্যে পুজো বিশেষজ্ঞ রাজনীতিবিদরা চটজলদি পা বাড়াচ্ছেন শাসক বা বিরোধী দলের দিকে। পুজোর মঞ্চে তড়িৎ গতিতে এগিয়ে চলেছে দলবদল। রামনবমী কিংবা গণেশপুজোর অতিবিজ্ঞাপন তো পুরোটাই যেন এক লড়াই।
সেই পথেই সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের শারদীয় উৎসবও অনেকটা দখল হয়ে যাচ্ছে। আসলে প্রগতিশীলতার প্রেক্ষাপটে উদারনীতিতে বিশ্বাসী বাঙালি হিন্দু আপস করেছে তার সনাতন ধর্মাচরণের সঙ্গে। এর একটা কারণ বামফ্রন্টের তিন দশকাধিক রাজত্ব। আর সেই পথেই ঢুকে পড়েছেন কৌশলী রাজনীতির কারবারিরা। তাঁরা পুজোকে বদলে দিচ্ছেন নিজেদের মতো করে। প্রতিযোগিতামূলক ধর্মাচরণে শারদীয় উৎসব যেন অনেকটাই রাজনীতির পণ্য। অর্থাৎ পুজোয় যে ব্যবসা তা শুধু অর্থনীতির নয়, রাজনীতিরও।
তবে মা আছেন। সামনের বছর মহালয়ার সময় থেকে পুজোর উদ্বোধন রুখে দিলেন তিনিই। ২০২০-তে মহালয়ার দিন ১৭সেপ্টেম্বর। দুটি অমাবস্যার কারণে আগামী বছর আশ্বিন মল মাস। পুজো তাই পিছিয়ে কার্তিকে, অক্টোবরের ২২ তারিখ ষষ্ঠী। এমনটাই বলছে গুপ্তপ্রেস এবং বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত। এমন ঘটনা এর আগে ঘটেছে ১৯৮২ সালে, বামফ্রন্ট সরকার দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার বছরে।
যা বোঝা যাচ্ছে, রাজনীতির আগ্রাসন রুখতে পারেন একমাত্র আমাদের আরাধ্য দেবীই। এবারের বিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছায় তাই রাজনীতির হাত থেকে নিজেদের সনাতন ধর্মকে বাঁচিয়ে রাখার স্লোগান তুলুক জাত্যভিমান হারিয়ে ফেলা হিন্দু বাঙালি। তবে, অন্যদিকটা ভাবলে গা শিউরে উঠছে। পরের বছর রাজনীতির দড়ি টানাটানিতে মহালয়া থেকে শুরু হয়ে মায়ের পুজো দেড় মাস ধরে চলবে না তো?
শুভময় মৈত্র
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত)