রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রথম শিক্ষা বাঙ্গালার ইতিহাস’(১২৮১) বইটির সমালোচনা সূত্রে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন,’সাহেবেরা যদি পাখী মারিতে যান,তাহারও ইতিহাস লিখিত হইয়াছে, মাওরি জাতির ইতিহাসও আছে, কিন্তু যে দেশে গৌড়, তাম্রলিপ্ত, সপ্তগ্রামাদি নগর ছিল, যেখানে নৈষধচরিত, গীতগোবিন্দ লিখিত হইয়াছে, যে দেশ উদয়নাচাৰ্য্য, রঘুনাথ শিরোমণি ও চৈতন্যদেবের জন্মভূমি, সে দেশের ইতিহাস নাই। মার্শমান, স্টুয়ার্ট প্রভৃতি প্রণীত পুস্তকগুলিকে আমরা সাধ করিয়া ইতিহাস বলি : সে কেবল সাধ-পূরণ মাত্র।’
বঙ্কিমচন্দ্রের এই আক্ষেপ খুব সঙ্গত ছিল, কারণ মানুষ আবহমান তাকিয়ে থাকে ইতিহাসের দিকে এবং সে ইতিহাস টুকরো টুকরো আঞ্চলিক ইতিহাসের সংযুক্ত ও সামগ্রিক রূপ। তবে বাংলার ইতিহাস চর্চার বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিরন্তর আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার প্রবাহে সে আক্ষেপের ওপর যে কিছুটা আশার আলো বিচ্ছুরিত করছে যে কথা আজ নির্দ্বিধায় বলা যায়। এ প্রবাহ ক্রমবর্ধমানও। বিপ্লব ঘোষ সম্পাদিত গবেষণামূলক প্রবন্ধ সংকলন ’শতদীপ’ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এতে ২০ টি অনুসন্ধান-মূলক প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। যার ১৫টিতে বিশেষ বিষয় ভিত্তিক আঞ্চলিক ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন প্রাবন্ধিকরা। এগুলির মধ্যে ডঃ সুলজ বালার ‘নদীয়া জেলার তাঁত শিল্পের ইতিহাস’, প্রবীর আচার্যের ‘শ্রী বাটীর টেরাকোটা মন্দির’, সুকুমার রুজের ‘বাগটিকরা টেরাকোটা মন্দির’, রামকৃষ্ণ দাসের ‘বীরভূম- কীর্ণাহারের অতীত ঐতিহ্য’, শঙ্করী ঢালীর ‘লৌহ ইস্পাত শিল্প ও দুর্গাপুর’, সৌরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ‘লুপ্তপ্রায় ইসলামবাজারের গালাশিল্প, দু’চার কথা’– মূলত রাঢ় অঞ্চলের ইতিহাসকে তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে প্রবীর আচার্য ও সুকুমার রুজের দুটি প্রবন্ধে শ্রীবাটি ও বাগটিকরার মন্দির দুটির টেরিকোটার সূক্ষ্ম কারুকাজ নিয়ে আলোচনা প্রশংসার দাবি রাখে। ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে তৈরি শ্রীবাটির মন্দিরের ভৌগোলিক অবস্থান থেকে শুরু করে মন্দির গাত্রের পিড়ের কাজের বর্ণনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আবার সৌরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ইসলামবাজারের গালা শিল্প’ প্রবন্ধে, এই শিল্পের ক্রম ক্ষীণায়ুর কথা ও তাকে বাঁচানোর রাবীন্দ্রিক প্রচেষ্টার কথা সুস্পষ্ট করে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
সম্পাদক বিপ্লব ঘোষ সমগ্র বাংলার আঞ্চলিক ইতিহাস ও চালচিত্রের আভাস দিতে চেয়েছেন এই সংকলনের মাধ্যমে। তাই তাঁর নির্বাচনে রাঢ়ভূমিকে কেন্দ্র করে প্রবন্ধ যেমন আছে তেমনি আছে উত্তর-দক্ষিণের বাংলার ইতিহাসকে স্পর্শ করেছে এমন কিছু লেখা। তার মধ্যে সম্পাদকের লেখা ‘ইছাপুর-গোবরডাঙা-খাঁটুরা অঞ্চলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও আঞ্চলিক ইতিহাস’ সংক্ষিপ্তাকারে গোবরডাঙার ইতিহাসকে তুলে ধরার চেষ্টা। এছাড়াও রয়েছে সম্রাট ঘোষের প্রবন্ধে ভাটপাড়ার অতীত ঐতিহ্যের কিছু আভাস, শুভাশিস রায়ের প্রবন্ধে দমদম ক্যান্টনমেন্টের টুকরো ইতিহাস কিংবা কিরণ্ময় জানার প্রবন্ধে হলদিয়া বন্দর নগরী গড়ে ওঠার উদ্দেশ্য নিয়ে দু’চার কথা এবং চিত্রভানু বিশ্বাসের চব্বিশ পরগণা জেলার শিল্প কথা। সাগ্নিক চক্রবর্তী,ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায় এবং দেবব্রত চাকীর প্রবন্ধগুলি নিয়ে উত্তরবঙ্গের ইতিহাসের সংযুক্তিকরণ কেউ করতেই পারেন।
জ্ঞান চর্চার ধারক ও বাহক হিসাবে পুঁথির অবদান অনস্বীকার্য। ডঃ জগৎপতি সরকার ‘পৃথিবীর সেকাল একাল’ প্রবন্ধে পুঁথি সংগ্রহ ও পুঁথিচর্চার প্রতি পাঠককে আকর্ষণের প্রয়াস স্পষ্ট। এছাড়াও সৌরভ সরকারের প্রবন্ধ ‘ঔপনিবেশিক বাংলায় শিক্ষার উন্নতিকল্পে ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকা’ ও সৌমদেব মাইতির ‘৪২ -এর আগস্ট আন্দোলনে তমলুকে মহিলাদের ওপর ব্রিটিশ পুলিশদের অত্যাচার’- প্রবন্ধ দুটি বেশ অনুসন্ধান মূলক ও তথ্যসমৃদ্ধ। তবে প্রাবন্ধিক গৌরগোপাল পাল আলাদাভাবে প্রশংসনীয় এ কারণে যে, তিনি একটি অনালোকিত বিষয়কে উপস্থাপিত করেছেন।
বিশ্বকোষ প্রবর্তক রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায় এ প্রজন্মের পাঠকের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত।তাঁর এই প্রবন্ধ রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসা জাগাবে অনেক পাঠক ও নব প্রজন্মের প্রাবন্ধিকের মনে। বস্তুত বিপ্লব ঘোষের এই সংকলন সামগ্রিকভাবে বাংলার ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে যাঁরা নিবেদিতপ্রাণ, তাঁদের উৎসাহিত করবে–সন্দেহ নেই।
শতদীপ (প্রথম খণ্ড)
সংকলন ও সম্পাদনা : বিপ্লব ঘোষ
দীপান্বিতা প্রকাশনী , ইছাপুর, গাইঘাটা, উত্তর ২৪ পরগনা।
মূল্য ২০০ টাকা।