প্রথম পর্ব
দেবতার বর
কত জন্ম কত জন্মান্তর
অব্যক্ত ভাগ্যের রাতে
লিখেছে আকাশ-পাতে
এ দেখার আশ্বাস-অক্ষর।
অস্তিত্বের পারে পারে
এ দেখার বারতারে
বহিয়াছি রক্তের প্রবাহে।
সেই দেবতার গ্রাম, সেই মন্দিরের গ্রাম মলুটী । সেখানে অবস্থান করেন তারা মায়ের ভোগিনী মা মৌলীক্ষা । তারাপীঠের মত প্রচারিত না হলেও এই মৌলীক্ষা দেবীর মন্দিরে একাধিক সাধক তন্ত্র সাধনা করে গেছেন ।আক্ষরিক অর্থে মৌলীক্ষা মায়ের স্থানও সিদ্ধ পীঠ। শুধু এখানে তান্ত্রিকগনই তন্ত্র সাধনা করেন নি, এখানে বহুদিন ধরে প্রচলিত হয়েছে শুদ্ধ হোমাগ্নি। মন্দির অলিন্দে সিদ্ধাসন করে অনেক সাধক মহাবিদ্যা জপ করে গেছেন। মলুটীতে আগত সাধকদের স্রোত ধারায় ,বিশিষ্ট সাধক বামদেব তারাপীঠে সিদ্ধি লাভ করবার অনেক পূর্বেই এখানে এসেছিলেন ও সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। সেই পরম সাধক বামাখ্যাপার স্মৃতি ধন্য মলুটী গাঁ কেবল রক্তাভ দেবী পান্ডারা বা মা মৌলীক্ষা এবং সাধক শ্রেষ্ঠ বামাখ্যাপার জন্যই বিখ্যাত নয়, মলুটী সমানভাবে বিখ্যাত তার মন্দিররাজির জন্যেও। মন্দিরগুলির অনেকগুলিই রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে দৌড়ঝাঁপ করার মতো উদ্যমী লোকের অভাব , যোগাযোগের সমস্যা এবং সার্বিকভাবে আর্থিক সংগতির অভাবের কারণে বিগত শতাব্দীর চারের দশক থেকেই মলুটী লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়। আবার ৭০ এর দশক থেকে মানুষের সিদ্ধপীঠ মলুটীর প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। মলুটীকে নতুন করে পরিচয় করানোর ক্ষেত্রে সমরেশ বসু বা কালকূটের রচিত #কোথায়_পাব_তারে উপন্যাসটির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত উক্ত উপন্যাসটিতে যদিও তন্ত্র সাধনা নিয়ে অনেক অতিরঞ্জিত কথা উল্লিখিত হয়েছে তবুও ওইসময়ের জন্য উপন্যাসটি মলুটীর জন্য উল্লেখ্য ছিল। এছাড়াও মলুটীর সাধারণ মানুষের উদ্যোগও মন্দিরের গ্রাম মলুটীর ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে পুনঃ সমৃদ্ধকরণ করতে সাহায্য করেছে।
মন্দিরের গ্রাম মলুটীতে ১০৮ টি মন্দির আছে । আছে বলে আমার ভুল হবে । এর মধ্যে ৭২ টি মন্দির এখনও অক্ষত আছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাকিগুলি মহাকালের নিয়মের স্বীকার হয়েছে। আরো ৯ টি মন্দির কছে যা খুব প্রাচীন নয়। সব মিলিয়ে মলুটীর বর্তমান মন্দিরের সংখ্যা ৮১ টি। মলুটীর রাজবংশ : নানকার রাজবংশ ১৭১৯ থেকে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দ , প্রায় দেড়শো বছর ধরে একের পর এক অপূর্ব কারুকার্যময় মন্দির গড়ে তোলেন। সেসব মন্দিরের অলঙ্করণ সত্যই বিস্ময়কর।
১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে রাজনগরের সঙ্গে নানকার রাজ্যের প্রবল যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে নানকার রাজ্যের রাজধানী ডামরা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায় । এর প্রায় নয় বছর পর নানকার রাজারা মলুটীতে তাঁদের নতুন রাজধানী নিৰ্মাণ শুরু করেন। নানকার রাজবংশ মলুটীতে এসে চার তরফে ভাগ হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত গিয়ে তা দাঁড়ায় ছয় তরফে। নানকার রাজবংশ ধর্মপ্রাণ ছিলেন । তাই মন্দির নির্মাণে এই সকল শরিকরা কোনো অংশেই পিছিয়ে থাকেন নি। একটা সময়ের পর মন্দির নিৰ্মাণ নিয়ে তাঁদের মধ্যে প্রায় প্রতিযোগিতা সূচিত হয়। যার ফলে ১৫০ বছরের মধ্যে ১০৮ টি মন্দির নির্মিত হয়।
এই কারনেই হয়ত মলুটীর আদিকালী এবং দুর্গাপুজো পরবর্তী পর্যায় চার তরফ মিলিয়ে মোট আটটি পুজোয় ভাগ হয়েছিল। অনুমান এধরনের প্রতিযোগিতা র কয়েকটি কারন ছিল । প্রথমত, সনাতনী নানকার ভীষণই ধর্মপ্রাণ ছিলেন। দ্বিতীয়ত , বৈভব প্রদর্শন। তৃতীয়ত , নানকার রাজবংশের পাকাগৃহ নির্মাণে বাধা ছিল ,তাই দেবদেউল নিৰ্মাণ করে সে সাধপুরণের চেষ্টা করতেন। চতুর্থত, শরিকি বিবাদ । তখন শরিকি পরিবারের নানা লোকজনের নামে মন্দির উৎসর্গ করা হত। এবার এক শরিকের এক বৌয়ের নামে মন্দির উৎসর্গ হলে নানা বিবাদাদির কারণে অন্য পরিবারের বউ সেখানে পুজো দিতে যেত না। ফলে, তার জন্য নতুন করে মন্দির নির্মিত হত।এভাবেও অনেক মন্দিরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। একই গ্রামে এত মন্দির বোধয় হয় না। বীরভূমের গণপুরে মন্দিরের সংখ্যা ৪৮ টি।
ভারতের ধ্রুপদী মন্দির শৈলী গুলি হল : নাগর, বেসর এবং দ্রাবিড়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে মলুটীর মন্দিরগুলি সেই ঘরানার মধ্যে পড়ে না। গঠনগত দিকে থেকে মল্লভূম বা উড়িষ্যার প্রভাব থাকলেও তেমন ব্যাপক উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। মল্লভূম বিখ্যাত রত্ন মন্দিরের জন্য ,কিন্তু তার একটিও মলুটীতে নেই। যেসব মন্দির কালের নিয়মে ধ্বংস হয়েছে সেগুলির মধ্যে রেখদেউল বা রত্নদেউল ছিল কিনা বলা একেবারেই সম্ভব নয়। তবে বর্তমানে মলুটীতে যেসব মন্দির আছে , তার মধ্যে রেখদেউল আছে মাত্র একটি। তবে , সেই দেউলটিও উড়িষ্যার মন্দির শৈলীর ব্যাকরণকে মেনে তৈরি হয় নি। তাই সেভাবে দেখলে মলুটীর মন্দির মিশ্রপ্রকৃতির। অনেকে বলেন , এখানের মন্দির শৈলীতে মল্লভূম এবং উড়িষ্যার প্রভাব আছে, তবে সে প্রভাব কিনা কেবল মলুটী নয় বঙ্গের অনেক জেলার মন্দিরের আছে। আবার অনেকে মনে করেন মলুটীর মন্দিরের নিজস্ব ধারা , ব্যাকরণ আছে। কিন্তু সে ধারণাও ঠিক নয়। কারণ ,এই একই ধরনের গঠনশৈলী ও অলঙ্করণের মন্দির সারা বঙ্গ জুড়েই দেখা যায়।
অবশ্য এমনটি হবার কথা ছিল। কারণ বঙ্গের যেকোনো বড় , মাঝারি বা ছোটরাজার পক্ষেই মন্দির তৈরির সূত্রধরদের দীর্ঘসময় রেখে ভরণপোষণ করে সম্ভব ছিল না বা তার হয়ত তেমন প্রয়োজনও ছিল না। এসব সূত্রধররা নানা ধরনের মন্দিরের নকশা নিয়ে নানা স্থানে ঘুরে বেড়াতেন। রাজা ,জমিদার বা ধনী ব্যক্তিরা সেগুলি নিজের সাধ ও সাধ্য অনুযায়ী নকশা পছন্দ করে মন্দির নিৰ্মাণ করাতেন। পৃষ্ঠপোষকের ইচ্ছা ও সাধ্যানুসারে সেইসব নকশায় যোগ বিয়োগ ঘটত। মলুটীর মন্দিরগুলোও এভাবে গড়ে উঠেছিল। তবে এগুলোকে মলুটীর নিজস্ব শিল্পশৈলী না বলে বাংলার নিজস্ব শৈলী বলা যুক্তি সংগত।
মলুটীতে পাঁচ ধরনের মন্দির দেখা যায় :
১. চালা বা চারচালা
২. রেখ বা শিখর
৩. মঞ্চ
৪. দোচালা বা একবাংলা
৫. দালান বা সমতল ছাদ
মলুটীর ৭২ টি প্রাচীন মন্দিরের মধ্যে চালা শৈলী বা চারচালা মন্দিরের সংখ্যা হল ৫৭ টি। মঞ্চ শৈলীর মন্দিরের সংখ্যা ১ টি। দোচালা বা এক বাংলা মন্দিরের সংখ্যা ১ । রেখদেউল মন্দিরের সংখ্যা ১ টি। বাকি যে ১২ টি মন্দির আছে তা দালান বা সমতল ছাদ বিশিষ্ট।
গ্রাম বাংলায় এক সময় সব থেকে অধিক খড়ের চালের মন্দির দেখা যেত। এগুলো চারচালা বিশিষ্ট হত। পরে খড়ের চাল টিনের চালে পরিণত হয়, তবে সে অনেক পরে মানে প্রায় আধুনিক যুগের কথা। তো, চারকোণা মঞ্চের উপর গড়ে ওঠা এককক্ষ বিশিষ্ট চারচালা মন্দির গুলো সেই গ্রাম বাংলার খড়ের চালের মন্দিরের ন্যায় গড়ে উঠেছে।
সাধারণত চারচালা মন্দির গুলি একদুয়ারি হয়। তবে ,কোথাও কোথাও এই ধরনের মন্দিরগুলো ত্রিখিলান যুক্তও হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মন্দিরের ভিত্তিভূমি হয় বর্গাকার। সেই ভিত্তিভূমির উপর গড়ে ওঠা মঞ্চের থেকে দেওয়ালগুলো খাঁড়া ভাবে উপরের দিকে উঠে যায়। তারপর থেকে ত্রিভুজ আকারের চারিটি চাল, যার নিচের বহিঃরেখাটি ধনুকের মতো বাঁকানো হয়। চারটি চালের পার্শ্বরেখা গুলি নমনীয়ভাবে বাঁকা হতে হতে মন্দির শীর্ষে গিয়ে মেলে। মন্দির শিখরদেশ সাধারণত হয় গোলাকার। এই মন্দিরগুলোর ভিত্তিভূমি ছোট হয়। সাধারণত এমন ধরনের মন্দিরে শিবলিঙ্গ স্থাপন করা হয়। এগুলো নিরাভরণ বা অলঙ্কৃত দুইধরনেরই হয়। অলঙ্কৃত হলে সাধারণত সামনের দিকে হয়।
মলুটীতে যে ৫৭ টি চালা মন্দির দেখা যায়, তার কিছু যেমন ছোট বা মাঝারি উচ্চতার হয় ,তেমন কিছু যথেষ্ট উচ্চ মন্দির দেখা যায়। এগুলোর উচ্চতা ১৫ থেকে ৬০ ফুট পর্যন্ত হয়।
কোথাও ছোট মঞ্চের উপর একটি মন্দির ,কোথাও বা একটু বড় মঞ্চের উপর একাধিক মন্দিরের অবস্থান দেখা যায়। বড় চালামন্দিরগুলোর মঞ্চের উপর দরজার সঙ্গে একফালি আঢাকা অলিন্দ এবং চারিদিকে প্রদক্ষিণ পথ থাকে। প্রসঙ্গত, অলিন্দ প্রদক্ষিণ পথের দ্বিগুন প্রশস্ত হয়। কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে অলিন্দে উঠতে হয়। ছোট মন্দির গুলোর অলিন্দ বা প্রদক্ষিণ পথ কিছুই থাকে না। মঞ্চগুলোও অনেক নিচু হয়। যদি দু কি এক ধাপ সিঁড়ি থাকে তা বর্গাকার ভিত্তির সামনে থেকে সরাসরি মন্দিরের দরজায় উঠে আসে। মলুটীর চালা মন্দিরগুলোর প্রবেশপথ বেশ ছোট হয়, বড়জোড় ফুট পাঁচেক উচ্চ এবং দু আড়াই ফুট প্রস্থ।
৫৭ টি চালামন্দিরের মধ্যে ৩০ টির সামনে দিকে টেরাকোটা অথবা ফুল পাথরের কারুকার্য দেখা যায়। এরমধ্যে ৭ টি মন্দিরের অলঙ্করণ প্রায় অক্ষত, ১৮ টি আংশিকভাবে অলঙ্কৃত । বাকি ৫ টি মধ্যে তিনটি মন্দিরের অনেক ফলক চুরি হয়ে গেছে ।অন্য দুটি মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংসপ্রায়।
#ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১) মলুটির টেরাকোটার মন্দির
২) মন্দিরময় মলুটী