১৮৮৬ সালের ৭ ই জানুয়ারি; তখনও নরেন্দ্রনাথ (Narendranath) স্বামী বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda) হয়ে ওঠেন নি। কল্পতরু দিবস অতিবাহিত হয়ে গেছে (১৮৮৬ সালের ১ লা জানুয়ারি); শ্রীরামকৃষ্ণ তখন খুব অসুস্থ। তাঁকে নরেন্দ্রনাথ (Narendranath) বলছেন, এখন থেকে তাকে প্রত্যহ বলে দিতে হবে সেদিন সাধন ভজন কীভাবে করবেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সেদিন তাঁর আদরের নরেনকে নিজের কুলদেবতা রামের ইষ্টমন্ত্র দিলেন। নরেনের শ্রীরাম ভজনা এইভাবে শুরু হল। শ্রীম (মাস্টারমশাই)-র দিনলিপি উদ্ধৃত করে স্বামী প্রভানন্দ লিখেছেন সেই কথা। ১৩ ই জানুয়ারি শ্রীম দেখছেন, নরেন্দ্রনাথ পাগলের মতো রামনাম গাইছেন; অবশেষে ১৬ ই জানুয়ারি নরেনকে শ্রীরাম সন্ন্যাসীবেশে দর্শন দিলেন। আর ১৯ শে জানুয়ারি নরেন্দ্রনাথসহ নিরঞ্জন প্রমুখ সেই সন্ন্যাসী-রূপী রামের মতো রামাইৎ সাধুর বেশ ধারণ করলেন। নরেনের গেরুয়াবেশে মা ভুবনেশ্বরী যারপরনাই চিন্তিত হলেন। নরেন যে সপার্ষদ সন্ন্যাসী হতে চান এবং তা ক্ষত্রিয় রামের সন্ন্যাস-বেশী রূপে তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর আদরের নরেনকে শক্তিমান পুরুষ, ধর্মযোদ্ধা, ন্যায়-পরায়ণ হয়ে ওঠার জন্যই কী রামনামে আবিষ্ট করলেন না!
পিতৃসত্য পালনের জন্য শ্রীরাম বনবাসী হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর ক্ষাত্রধর্ম অক্ষুণ্ণই ছিল। বনবাস-জীবনে কখনও অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ রাখেন নি রাম, যখনই প্রয়োজন হয়েছে অস্ত্র চালাতে দ্বিধা বোধ করেন নি। তাছাড়া বীরপুরুষ শ্রীরামচন্দ্র (Sri Ramchandra)কেনই বা অস্ত্র পরিত্যাগ করবেন! এ যে ক্ষাত্রধর্ম!
শ্রীরামের এই অনন্য রূপের মধ্যেই রয়েছে চিরন্তন ভারতবর্ষের চিন্তন; শৌর্যশালী অথচ তাপসমালী রাম। ভারতবর্ষের তপোবনে ভারতীয় সভ্যতার অনন্য উপাচার আর নগর-রাজধানীতে বিক্রমশালী প্রজারঞ্জন রাজা — এ দুয়ের এক অমিত মেলবন্ধন হল শ্রীরামচন্দ্রের (Sri Ramchandra) মধ্যে। স্বামী বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda) যে বীর সন্ন্যাসী হয়ে উঠেছেন তা হয়তো এই রঘুবীরেরই সাধনায়। গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর প্রিয় শিষ্যকে কুলের ইষ্টনাম দিয়ে সেই সাধনার ধারাকে পরিপুষ্ট করেছেন, বাঙ্গলাতে শ্রীরাম সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করে দিয়ে গেছেন। বাঙ্গলার ধর্মীয় সংস্কৃতিতে শ্রীরামচন্দ্রকে পূজন-আরাধন যে প্রচলিত ছিল তা কবি কৃত্তিবাসের ‘শ্রীরাম পাঁচালী‘-ই অমোচ্য প্রমাণ।
স্বামীজির হনুমান ভক্তি
হনুমানের প্রতি স্বামীজির অগাধ ভক্তি ছিল। সন্ন্যাসী হবার পরেও মাঝেমাঝে মহাবীরের কথাপ্রসঙ্গে মাতোয়ারা হয়ে উঠতেন এবং অনেক সময় মঠে শ্রীমহাবীরের একটি প্রস্তরমূর্তি রাখবার সঙ্কল্প করতেন।
ছেলেবেলায় তাঁর রামায়ণ-গান শুনবার বড় ঝোঁক ছিল।… একদিন রামায়ণ -গানে শুনলেন — হনুমান কলাবাগানে থাকে। অমনি এমন বিশ্বাস হল যে, সে রাত্রে রামায়ণ -গান শুনে ঘরে আর না ফিরে বাড়ির কাছে কোন এক বাগানে কলাগাছতলায় অনেক রাত্রি পর্যন্ত হনুমানের দর্শনের আশা করে অতিবাহিত করেছিলেন।
কল্যাণ চক্রবর্তী