মহাসম্মেলনে যোগদানকারী দর্শক ও শ্রোতারা, বুঝে বা না বুঝেই এমন এক মুহূর্তের সাক্ষী ছিলেন যে-মুহূর্তে আন্তঃধর্ম ও ভাবাদর্শ এবং শিক্ষার ও বিপরীতধর্মী আদর্শেরও পারস্পরিক ভাববিনিময়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
‘আমেরিকাবাসী ভগিনী ও ভ্রাতৃগণ’ – এই কয়েকটি শব্দবন্ধ দিয়েই স্বামী বিবেকানন্দ ইতিহাস সৃষ্টি করলেন।
স্বামীজী বলেছিলেন, “তোমাদের উষ্ণ আন্তরিক অভ্যর্থনার প্রত্যুত্তর দিতে উঠে আমার হৃদয় অবর্ণনীয় আনন্দে পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। আমরা যে কেবল সর্বজনীন সহিষ্ণুতায় বিশ্বাসী তা-ই নয়,উপরন্তু সব ধর্মকেই আমরা সত্য বলে বিশ্বাস করি।”
এই প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য উদ্ধৃত করাই যায় :
“…যে জাতি পৃথিবীর সব ধর্মের ও সব জাতির নিপীড়িত ও আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে সেই জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে আমি নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি।”
“জরথুস্ট্রের অনুগামী মহান পারসিক জাতির অবশিষ্টাংশকে যে-ধর্ম আশ্রয় দিয়েছেন, এবং এখনও পালন করছেন তার অন্তর্ভুক্ত বলে আমি গর্ববোধ করি।”
৬৫১ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানরা যখন পারস্যের সাসানীয়ান সাম্রাজ্য জয় করে তরবারির সাহায্যে সমগ্র দেশবাসীকে ধর্মান্তরিত করার প্রচেষ্টা করছিল সে-সময় একদল জরথুস্ট্রের অনুগামী ভারতে পালিয়ে এসেছিল আশ্রয়প্রার্থী হয়ে। পারস্য দেশ থেকে এসেছিল বলে তাদের পারসি বলা হত। এই শরণার্থীরা সনজনে অবতরণ করেছিল ( এখন গুজরাটের ভালসাদ জেলায়)। সনজনের রাজার কাছে তাদের নিয়ে যাওয়া হলে, তাঁর কাছে তারা আশ্রয় প্রার্থনা করল।
ভাষাগত ব্যবধান থাকার জন্য ইশারায় ভাবের আদান-প্রদান চলছিল। রাজা তাদের কাছে এক গ্লাস ভর্তি দুধ পাঠিয়ে দিয়ে বোঝাতে চাইলেন যে তাঁর রাজ্যে আর কোন স্থান অবশিষ্ট নেই।
পারসিরা সেই দুধে চিনি মিশিয়ে বলতে চাইল, তারা চিনির মতােই দুধে মিশে যাবে এবং রাজ্যকে মধুর করে তুলবে।
আজ অবধি তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে চলেছে।
রামকৃষ্ণ মিশনের ত্রয়োদশ অধ্যক্ষ স্বামী রঙ্গনাথানন্দজী মহারাজ এই আদান-প্রদান সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন : “এই ভাবেই একটি সভ্য জাতি অপর একটি সভ্য জাতিকে অভ্যর্থনা জানায়।”
নিপীড়িতের আশ্রয়দাতা রূপে ভারতের ভূমিকা এখানেই শেষ নয়, এই আধুনিক যুগেও সে-ধারা অব্যাহত।
পোল্যান্ডের যে-শরণার্থীদের রাশিয়া ‘গুলাগে’ (বাধ্যতামূল শ্রমশিবির) নির্বাসনে পাঠিয়েছিল, তারা সেই অমানুষিক অত্যাচারের স্থান থেকে পালিয়ে *১৯৪২ সালে ভারতে অস্থায়ী শিবিরে আশ্রয় পায়।
ভারতের তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক তাদের আশ্রয় দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু ভারতের কয়েকটি স্বায়ত্তশাসিত দেশীয় রাজ্য সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন।
সর্বপ্রথম এগিয়ে এলেন নবনগরের মহারাজা জামসাহেব।
শিশুদের দুর্দশার কাহিনী শুনে। তিনি তৎক্ষনাৎ পাঁচশো শিশুকে আশ্রয় দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
শীঘ্রই সেই সংখ্যা এক হাজার হল, এবং তিনি তাঁর নিজের সমুদ্রতীরবর্তী গ্রীষ্মাবাসে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।
শিশুরা যখন সেখানে এল তিনি তাদের স্বাগত জানিয়ে প্রথমেই বললেন যে তিনি তাদের ‘বাপু’—পিতা।
যুদ্ধ শেষ হলে তিনি ওই শিশুদের দত্তক নিলেন যাতে তাদের মস্কো-শাসিত পোল্যান্ডে জোর করে পাঠানো না হয়। কারণ এদের যারা প্রথমে সাইবেরিয়াতে নির্বাসন দিয়েছিল সেই শাসনতন্ত্রই কমিউনিস্ট পোল্যান্ড শাসন করেছিল।
এরপর কোলহাপুরের দেশীয় রাজা শরণার্থীদের জন্য একটি স্থান নির্দিষ্ট করে দেন। তিনি ‘বালিবাদে’ (Valivade) অঞ্চলে পাঁচ হাজার মানুষ—প্রধানত মহিলা ও শিশুদের থাকার মতো বাসস্থান নির্মাণ করে দিয়েছিলেন।
পােল্যান্ড থেকে আগত এই শরণার্থী বালকদের মধ্যে একজন আজ পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী।
জামনগরের মহারাজার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এখনও তাঁরা ভারতে আসেন।
আজও ওই দেশে তাঁদের ‘বাপুজী’র নামে রাস্তা ও স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়।
১৯৫৯ সালে ৩ চতুর্দশ দলাই লামা ও তাঁর শাসনতন্ত্রের আধিকারিকরা তিব্বত থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয়প্রার্থী হয়ে এসেছিলেন।
১৯৫৯ ও ১৯৬০ সালের মধ্যে আশি হাজার তিব্বতী ভারতবর্ষে চলে আসেন।
২০০৩ সালে ভারতবর্ষের ভূতপূর্ব রাষ্ট্রপতি প্রয়াত এ পি জে আবদুল কালাম অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াং-এ একটি চারশাে বছরের প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ পরিদর্শনকালে স্থানটির বর্ণনাতীত প্রশান্তিপূর্ণ পরিমণ্ডলের রহস্যটি মঠাধ্যক্ষের কাছে জানতে চান। উত্তর এড়িয়ে মঠাধ্যক্ষ প্রথমে কালামকে বলেন, “আপনি তাে ভারতের রাষ্ট্রপতি, আপনি তো সবই জানেন।”
ড. কালাম অত্যন্ত পীড়াপীড়ি করলে অধ্যক্ষ মঠের আবাসিক তিনশাে জন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে ডেকে বুদ্ধের বিশাল মূর্তির চারপাশে বসালেন এবং মানসিক ঐক্য সম্বন্ধে উপদেশ দিলেন। তিনি বলেছিলেন, “ভারতবর্ষের তিন হাজার বছরের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে এদেশ সর্বদা শান্তির পক্ষে থেকেছে। এ দেশ শান্তির জন্য কাজ করেছে, শান্তির জন্য প্রার্থনা করেছে এবং শান্তির জন্যই বাঁচে।”
কালামকে মঠের একশাে দশ বছর বয়স্ক প্রাচীনতম সন্ন্যাসী বলেছিলেন, এই দেশ ঈশ্বরের প্রিয়। এদেশ কখনও আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করেনি এবং সেই কারণেই তার বিনাশ হবে না।
অন্যত্র স্বামীজী ঘোষণা করেছেন, “আমরা হিন্দুরা কেবলমাত্র সহ্য করি না, আমরা নিজেদের সব ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করি; আমরা মুসলমানের মসজিদে প্রার্থনা করি, জরথুস্ট্রের অনুগামীদের সঙ্গে অগ্নির সামনে উপাসনা করি এবং খ্রিস্টানদের ক্রুশের সম্মুখে নতজানু হই। আমরা জানি যে সব ধর্ম—নিম্নতম স্তরের প্রেতসিদ্ধি থেকে সর্বোচ্চ স্তরের একেশ্বরবাদী ধর্ম-সবই সমভাবে মানবাত্মার অনন্ত অসীমকে উপলব্ধি করার প্রচেষ্টাকে ব্যক্ত করে।”
বলা যেতে পারে আমরা এইসব কুসুম চয়ন করে, প্রেমের ডোরে বন্ধন করে তাদের দিয়ে একটি অনবদ্য পূজার অর্ঘ্য রচনা করি। একমাত্র ভারতের ইতিহাসেই বিশ্ব এরকম অপূর্ব নিদর্শন দেখাতে পারে।