দ্বিতীয় পর্ব
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে লেখা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা নিয়ে লেখা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিজ্ঞাপন দিয়ে লেখা ও সংবাদ এর সংখ্যা কম নয় । বিজ্ঞাপনের রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আমি এই প্রবন্ধে পূর্ব পর্ব থেকে আলোচনা করলেও ,প্রকৃত অর্থে শুধু বিজ্ঞাপন নিয়ে আলোচনা না করে বিজ্ঞাপনকে ব্যাপক অর্থে প্রয়োগ করছি। এখানে আলোচনার জন্য শুধু বিজ্ঞাপন গুলিক গ্রহণ করিনি গ্রহণ করেছি সংবাদ-এর অংশগুলিকে ।যেগুলি সংবাদ প্রচারিত হয়ে বিজ্ঞাপনের কাজ করেছে। আমাদের কবি রবীন্দ্রনাথ আমাদের দেশকে রাতারাতি বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন । এহেন আন্তর্জাতিক ব্যক্তির নিকট দেশ বাসীর চাহিদা ছিল অপরিসীম । বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান প্রতিদিনই বিভিন্ন দাবি নিয়ে কবির নিকট উপস্থিত হতেন। বিজ্ঞাপনদাতারাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। অনেকে আবার কোন কোন বিষয় কোভিদ অভিমত জেনে নিয়ে তাকেই বিজ্ঞাপন বা প্রচারে ব্যবহার করতেন।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন :
সংবাদপত্রে দোকানদারেরা যেরূপে বড়ো বড়ো অক্ষরে বিজ্ঞাপন দেয়, যে ব্যক্তি নিজেকে সমাজের চক্ষে সেইরূপ বড়ো অক্ষরে বিজ্ঞাপন দেয়, সংসারের হাটে বিক্রেয় পুতুলের মতো সর্বাঙ্গে রঙচঙ মাখাইয়া দাঁড়াইয়া থাকে, ‘আমি’ বলিয়া দুটো অক্ষরের নামাবলী গায়ে দিয়া রাস্তার চৌমাথায় দাঁড়াইতে পারে, সেই ব্যক্তি নির্লজ্জ । সে ব্যক্তি তাহার ক্ষুদ্র পেখমটি প্রাণপণে ছড়াইতে থাকে, যাহাতে করিয়া জগতের আর সমস্ত দ্রব্য তাহার পেখমের আড়ালে পড়িয়া যায় ও দায়ে পড়িয়া লোকের চক্ষু তাহার উপরে পড়ে। ( লজ্জাভূষণ’ প্রবন্ধ )
বিভিন্ন নথি ও তৎকালীন সংবাদপত্র ঘেঁটে জানা যায়—১৮৮৯ থেকে মৃত্যুর বছর পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৪১ সাল পর্যন্ত ছোট-বড়, পরিচিত-অপরিচিত বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ অংশ নিয়েছেন। তেল-সাবান, ক্রিম থেকে শুরু করে পাগলের মহৌষধ পর্যন্ত বিচিত্র বিজ্ঞাপনে তাঁর উপস্থিতি দেখা যায়। কখনো মডেল, কখনো তাঁর প্রশংসাবাক্য শোভা পেয়েছে বিজ্ঞাপনপত্রে।
মোটা দাগে এইসব বিজ্ঞাপনকে দুটো ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। একটি পণ্যের পরিচিতি, অন্যটি কোনো বিশেষ পণ্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সার্টিফিকেট; যেখানে কবিগুরুর মুখ দিয়ে ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যটি যে সেরা তাই বলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের প্রথমোক্ত ধারার বিজ্ঞাপনগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে আধুনিক বিজ্ঞাপনের অনেক আকর্ষক কলাকৌশল। অল্প কথায় পণ্যের একটি ট্যাগ লাইন হিশেবে এইসব কাজ বিস্ময়ের উদ্রেক করে। এমনি একটি বিজ্ঞাপন—সুলেখা কালি। বন্ধুস্থানীয় হেমেন্দ্রমোহন বোসের পীড়াপীড়িতে কবি লিখেছিলেন, ‘সুলেখা কালি। এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।’
এরম কিছু বিজ্ঞাপনের কথা প্রথম পর্বে বলেছি। বলেছি মহাজাতি সদন থেকে রবীন্দ্রনাথের দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার ইতিহাস। আজ এই দ্বিতীয় পর্বে পুনরায় আরো কিছু স্বদেশী দ্রব্যে রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞাপনের কথা বলব :
১৯৩৪ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারি পত্রিকা পাঠ করে জানতে পারা ১৯৩৪ সালে , “হিন্দুস্থান কো-অপারেটিভ ইন্স্যুরেন্স সোসাইটির” রজতরঞ্জন উৎসব উপলক্ষে যে সভা হয়েছিল সেই সভার সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই অনুষ্ঠানের জন্য রবীন্দ্রনাথ আগেই একটি শুভেচ্ছাবার্তা প্রস্তুত করেছিলেন। সেই শুভেচ্ছাবার্তা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ তাঁদের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করেন । বিশ্বভারতীর পত্রিকার একাধিক সংখ্যায় ওই প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন আমরা দেখতে পাই। সেই বিজ্ঞাপনের কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করলাম :
” লক্ষ্মীর অন্তরের কথাটি হচ্ছে করলেন কল্যাণ, সেই কল্যাণ দ্বারা ধন শ্ৰীলাভ করে। কুবেরের অন্তরের কথাটি হচ্ছে সংগ্রহ, সেই সংগ্রহের দ্বারা ধন বহুত্ব লাভ করে।”
হিন্দুস্থানের রজত রঞ্জন উৎসব / উপলক্ষে কবির প্রেরিত বার্তা/
‘ যে প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনা বাঙালীর,যার প্রতিষ্ঠা হয় বাঙালীর হাতে, আজও পর্যন্ত যার কার্য পরিচালনা করছেন বাঙালী, তার পঁচিশ বৎসরব্যাপী কর্ম সাফল্যের বাঙালী হয়ে আমিও গৌরব অনুভব করছি। ‘ – রবীন্দ্রনাথ “
কবির প্রেরিত এই শুভেচ্ছা বার্তায় কোন তারিখ ছিল না । ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ২৫ শে ফেব্রুয়ারি উক্ত রজতরঞ্জন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কাজেই রবীন্দ্রনাথ তার আগে কোন একদিনে এই বার্তাটি পাঠিয়েছিলেন। কবির প্রেরিত শুভেচ্ছা বার্তায় প্রতিষ্ঠানের “আর্থিক পরিচয়” , “নতুন বীমা “, “চলতি বীমা”, “বীমা তহবিল”, “দাবিশোধ” ইত্যাদি খাতে টাকা অংকে হিসাব দেখানো হয়েছিল।
কবির মৃত্যুর পরদিন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কবির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে অমৃতবাজার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। সেই বিজ্ঞাপনের কিছু অংশ উল্লেখ করলাম:
” RABINDRANATH TAGORE IS DEAD/ Long live Rabindranath / The Hindustan offers its worshipful homage to the departed great poet.
It deeply mourns his loss who was its Founder President and under whose inspiring guidance it has its birth is one of his own rooms as Jorashako.
Hindusthan Co-operative Insurance Society Ltd.Calcutta.”১৩৪০ বঙ্গাব্দের ফাল্গুনের বঙ্গশ্রী পত্রিকায় ” দি ভারত ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের ” পক্ষ থেকে একটি বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়েছিল । তার কিছু অংশ উল্লেখ করলাম :
” পৃষ্ঠপোষক -বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরচেয়ারম্যান – শেঠ রামকৃষ্ণ ডালমিয়াভাইসচেয়ারম্যান – বাবু দুর্গাপ্রসাদ খৈতান এম . এ., বি.এল.
১৯৩৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী নিয়ে Unites Press – এর সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল । প্রকৃতপক্ষে তা কবির আশীর্বাণীকে উপলক্ষ করে ইউনাইটেড প্রেসের বিজ্ঞাপন। সংবাদের শিরোনাম ছিল :
ইউনাইটেড প্রেসের সাফল্য / বিশিষ্ট ব্যক্তিদের শুভাকাঙ্খা/ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের আশীর্বানী। ১ লা সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ তারিখে লিখিত আশীর্বানীতে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন :
ইউনাইটেড প্রেস অফ ইন্ডিয়া সংবাদপত্র সমূহের বিশ্বস্ত সংবাদ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানরূপে দেশের বিশেষ সেবা করিতেছে। মাত্র এক বছরের মধ্যে ইহার অনেক উন্নতি হইয়াছে। ইহার ম্যানেজিং ডিরেক্টর শ্রীযুক্ত বিধুভূষণ সেনগুপ্ত ও তাঁহার সহকর্মীদের সংগঠন শক্তির পরিচায়ক। আমি তাহাদের সকলকে অভিনন্দিত করিতেছি।
যুক্তিসংগত ভাবেই ইউনাইটেড প্রেসের পক্ষ থেকে এই বার্তাকে তাঁরা বিজ্ঞাপন রূপে ব্যবহার করে ধন্য হয়েছিলেন।
অবশ্য রবি ঠাকুর খাদ্য রসিকও ছিলেন । তাই খাদ্য বস্তুর বিজ্ঞাপন তিনি স্বউদ্যোগে দেবেন না তা কি কখনো হয় ? তেমনি এক উদাহরণ হল পাটনার পিন্টুর হোটেল । সেই প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের ওপর আলোকপাত করি ।
১৯৩৬ সালের মার্চের মাঝামাঝি শান্তিনিকেতনের একদল ছাত্র সহ রবীন্দ্রনাথ উত্তর ভারত পরিভ্রমণে যান। এর কারণ হলো কিছুদিন পূর্বে কলকাতায় সাফল্যের সঙ্গে চিত্রাঙ্গদার অভিনয়।
– ” ইহার পর বিশ্বভারতীর কর্তৃপক্ষ স্থির করিলেন যে, উত্তর ভারতের প্রধান প্রধান নগরে এই অভিনয় দেখানো হইবে ; শান্তিনিকেতনের কলাচর্চার আদর্শ প্রচার ও বিশ্বভারতীর শূন্য তহবিল আংশিকভাবে পূর্ণ করা এই সফরের উদ্দেশ্য । “
এই সফরের অঙ্গরূপে ১৬ মার্চ রবীন্দ্রনাথ সদলে পাটনায় পদার্পণ করেন । দুদিন পাটনায় রবীন্দ্র সংবর্ধনা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান হল । আঠারোই মার্চ রাতে কবি সদরে পাটনা ত্যাগ করে এলাহাবাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। বিশ্ববন্দিত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যখন পাটনায় ছিলেন তখন তাকে খাদ্য সরবরাহের দায়িত্বে ছিল পার্টনার পিন্টু হোটেল। এই হোটেল কর্তৃপক্ষ কবির পছন্দ মতো খাদ্য সরবরাহ করে কবিগুরুর প্রশংসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন । কবি এঁদের খাবার খেয়ে তৃপ্তিলাভ করেছিলেন। পাটনা ত্যাগের প্রাক্কালে কবি এই হোটেল কর্তৃপক্ষকে শংসাপত্র দিয়ে গিয়েছিলেন । তা তাঁরা তাঁদের হোটেলের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করেছিলেন । কবি তাঁর লেটার হেড প্যাডে লিখেছিলেন :
During my visit with a group to my students to Patna , the Catering was in the charge of Pinto Hotel and I want to express my great satisfaction of the excellent service they rendered . I have myself sad the opportunity to taste their food , which is clean , whole some and good I wish the managment all success.
কবিপ্রদত্ত শংসাপত্রটি প্রকাশ করার পর হোটেল কতৃপক্ষ বিজ্ঞাপনে আরো লিখেছিলেন : ” your visit to Patna will undoubtebly be pleasant if you close to story at /Pintu Hotel/ The Premier Indian Hotel – Patna , C.T. 629.”
১৯০৮ সালে পাবনায় প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গের ঘি এবং খাদ্য সম্পর্কে বলেছিলেন : “……তাহারপর যা খাইয়া শরীর বল পায় ও ব্যাধিকে ঠেকাইয়া রাখিতে পারে তাহার কি অবস্থা। ঘি দূষিত , দুধ দুর্মূল্য , মৎস্য দুর্লভ এবং তৈল বিষাক্ত। “
সভাপতি রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাষণে ঘি সম্পর্কে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন। এই অভিমত প্রকাশের প্রায় ৩০ বছর পর বঙ্গের #শ্রীঘৃত সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা প্রদান করেছিলেন। ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের ১ লা বৈশাখ তারিখে কবি প্রদত্ত শংসাপত্র কর্তৃপক্ষ বহুবার তাদের বিজ্ঞাপনে প্রচার করেছিলেন। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দেরপ্রবাসী পত্রিকাতেও বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞাপনের শিরোনাম ছিল – ” শ্রীঘৃত সম্বন্ধে কবিগুরুর বাণী”।বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা ছিল :
“বাংলাদেশের ঘৃতের বিকারের সঙ্গে সঙ্গেই যকৃতের বিকার দূর্নিবার হয়ে উঠেছে । শ্ৰীঘৃত এই দুঃখ দূর করে বাঙালীকে জীবন ধারণে সহায়তা করুক এই কামনা করি । “
প্রবাসী পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় এই বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হয়েছিল।
“বিশ্বভারতী পত্রিকা” একাধিক সংখ্যায় ” The Bengal Autotype Co.”- র একটি বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়। ১৯৩৭ সালের ১৮ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথ এই কোম্পানিকে একটি শংসাপত্র প্রদান করেছিলেন।এটি তাঁরা দীর্ঘদিন তাঁদের প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন রূপে প্রচার করেছিলেন । বিজ্ঞাপনের প্রথমে তাঁরা রবীন্দ্রনাথের শংসা পত্র থেকেউদ্ধৃতি দিতেন। পরের অংশে তাঁদের সংস্থা দ্বারা প্রকাশিত একটি রবীন্দ্রনাথের ছবির বিজ্ঞাপন দিতেন। বেঙ্গল অটোটাইপ তাঁদের বিজ্ঞাপনে কবির যে শংসাপত্রটি উল্লেখ করেছিলেন তাতে কবি লিকেছিলেন। করেছিলেন তাতে কবি লিখেছিলেন :
I can say with out exaggeration that both in quality of work and in promptness of execution the Bengal Autotype has given great satisfaction.
Rabindranath Tagor , 18 April , 1937.
রবীন্দ্রনাথের ছবির যে বিজ্ঞাপনটা দিতেন তাতে তাঁরা লিখতেন – ” A wonder full picture of the Poet”… তাঁরা আরও জানিয়েছিলেন ছবিটি হেমেন মজুমদারের আঁকা। প্রতি ছবির দাম ১ টাকা এবং ডাক মাশুল আট আনা।
প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা ২১৩ কর্নওয়ালিস স্ট্রিট, কলকাতা।
১৯৩৭ ই ৬ ই জুন The Advance পত্রিকা ক্লাইড পাখার বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি ইংরেজিতে হলেও কবির মন্তব্য এবং স্বাক্ষর বাংলাতেই দিয়েছিলেন। সেই বিজ্ঞাপন থেকে কিছু প্রাসঙ্গিক অংশ উল্লেখ করলাম :
ক্লাইড / এই স্বদেশী পাখা ব্যবহার করিয়া আমি আনন্দ লাভ করিলাম। ইহা সর্বাংশে উৎকৃষ্ট । এই স্বদেশী অধ্যবসায়ের সফলতা কামনা করি । /০৫-০৪-৩৭ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৯৩৮ সালের ২৯ শে মার্চের আগে কোন একদিন The Indian Manufacturerts Ltd- র পক্ষ থেকে ম্যানেজিং ডিরেক্টর রবীন্দ্রনাথকে এক প্যাকেট লবণ পাঠিয়েছিলেন । রবীন্দ্রনাথ সেই স্বদেশী লবণ ব্যবহার করে বড় খুশি হয়ে ২৯ শে মার্চ তাঁকে পত্র দিয়েছিলেন । প্রতিষ্ঠান সেই পত্র তাদের বিজ্ঞাপনে প্রচার করেছিলেন । রবীন্দ্রনাথ কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর কে লিখেছিলেন :
I thank you for your kindness in sending me a packet of your fine swadeshi salt which I have used and found to be good . I hope will meet with concouragement and support from our countrymen in every direction.
১৯৩৩ সালের ৩ জানুয়ারির তারিখের The Advance থেকে জানা যায় ১৯৩২ সালের ৩১ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেশোরাম পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। ওইদিন পত্রিকায় একটি ছবিতে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ বেঙ্গল স্টোরসের দ্বার উদঘাটন করছেন।কর্তৃপক্ষ এই ছবিটিকে বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করেছেন। সেই দোকানটির সম্বন্ধে কবির অভিমতও প্রচার করেছিলেন। দোকানটি সম্বন্ধেই কবির অভিমত প্রচার করে বিজ্ঞাপন লেখা হয়েছিল:
We have long been feeling the urgent need of having such an Emporium where our indigenous products of varied kind from different provinces cloud be collected in one place displayed properly sale . – said Rabindranath Tagore.
এই বেঙ্গল স্টোরসের পক্ষ থেকে ১৯৩৩ সালে পুজোর আগে যে বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়েছিল তাতে কেশোরাম কটন মিলের কাপড় সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের অভিমত উদ্ধৃত হয়েছিল। এই জাতীয় একটি বিজ্ঞাপন “বঙ্গবাণী ” পত্রিকায় ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৩৩ তারিখে পাওয়া যায়। সেখানে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন : ” কেশোরাম কটন মিলের তৈরি জিনিসপত্র দেখে আমি খুশি হয়েছি। রং এবং পাড়ের বৈচিত্র্যে শাড়িগুলি মনোরম , মিহি জমি, ঠাস বুনট ও টেঁকসই , কেশোরামের লং ক্লথ টুইল তোয়ালে ইত্যাদিও সৈষ্ঠোবে ও পরিপাট্যে বাজারে যেসব জিনিস পাওয়া যায় তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ । আমাদেরই একটি মিলে এমন কাপড় প্রস্তুত হচ্ছে দেখে আমি আনন্দ ও গর্ব অনুভব করছি। “
১৯৩৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখের অমৃতবাজার পত্রিকা পাঠ করে জানা যায় ১৬ ই ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ লাহাদের পেনের কারখানা পরিদর্শন করেন এবং পেন্সিলের কারখানার উদ্বোধন করেন। সংবাদে আরও বলা হয়েছিল যে , দর্শকদের জন্য নির্ধারিত খাতায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর মতামত লিপিবদ্ধ করে এসেছিলেন। সংবাদ পাঠ করে আরো জানা যায় তিনি ফাউন্টেন পেনের বাংলা তরজমা #ঝরনা_কলম করেছিলেন –
…..In visitors’ Book designated the fountain pen as Jharna Kalam and said that this was the most suitable experience in Bengali for those pens.
রবীন্দ্রনাথ তাদের কারখানায় গিয়েছিলেন বাংলার চৌঠা ফাল্গুন ১৩৪০ বঙ্গাব্দ । বাংলা তারিখ দিয়ে তিনি মন্তব্য লিখে বাংলায় স্বাক্ষর করেছিলেন ।সেদিন দর্শকদের জন্য রাখা নির্ধারিত খাতায় রবীন্দ্রনাথ বাংলায় লিখেছিলেন :
” অদ্য এই ভারতী পেন কারখানায় মন আনন্দিত ও আশান্বিত হলো । ভারতী সাধনার সমস্ত উপকরণ আজ তার সেবায় উৎসর্গ করতে পারল এতে আমাদের ভাবী সম্পদের সূচনা করেছিল। একান্ত মনে এই উদ্যোগের সফলতা কামনা করি। “
এরপরে রবীন্দ্রনাথ বাংলা তারিখ দিয়ে বাংলায় স্বাক্ষর করেছিলেন । তারপর আবার লিখেছিলেন : ফাউনটেনপেন শব্দের বাংলা নামকরণ করা গেল #ঝরনা_কলম।
১৯৪১ সালের একুশে জুন বিশাখাপত্তনমে সিন্ধিয়াদের জাহাজ নির্মাণ কারখানার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ প্রথম । প্রথম ভারতীয়দের পক্ষ থেকে এই জাহাজ নির্মাণ কারখানার উদ্যোগকে সমর্থন করার জন্য সিন্ধিয়াদের পক্ষ থেকে বিশিষ্ট ভারতীয়দের কাছে আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা বার্তা প্রার্থনা করেছিলেন । কবির বার্তাটি সংবাদরূপে প্রচারিত হলেও তাদের পক্ষে বিজ্ঞাপনের কাজ করে। বার্তাটি ইংরেজিতে দিয়েছিল অমৃতবাজার এবং তার বাংলা অনুবাদ দেয় আনন্দবাজার পত্রিকা। সেই বার্তা ছিল:
” সিন্ধিয়া কোম্পানি নূতন প্রচেষ্টার সংবাদ শুনিয়া আমি অতিশয় আনন্দিত হইয়াছি। ভারতের নিজস্ব জাহাজ নির্মাণ কারখানা প্রতিষ্ঠা করিয়া আপনি ইহার সমৃদ্ধি ও স্বাধীনতার একটি প্রধান স্তম্ভ নির্মাণ করিবেন। এ বিষয়ে আপনি অগ্রণী হওয়ায় আমি আপনাকে অভিনন্দিত করিতেছি এবং আপনাদের প্রচেষ্টায় সাফল্য কামনা করিতেছি । আমাদের বংশধরগণ কৃতজ্ঞতা সহকারে এই ঘটনা স্মরণ করিবে। আমি আশা করি, যেদিন ভারতীয়গন নিজের জাহাজে স্বদেশের পতাকা উড়াইয়া বিভিন্ন সমুদ্র অতিক্রম করবে , সেই দিন দূরবর্তী নহে।”
কলকাতায় রাসবিহারী এভিনিউ লেক মার্কেট এর কাছে ছিল একসময় প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন ভান্ডার #জলযোগ।রবীন্দ্রনাথ এই দোকানের দই ও মিষ্টি খেয়ে খুশি হয়ে প্রশংসা করেছিলেন। দিয়েছিলেন একটি শংসাপত্র ।
#জলযোগের মিষ্টান্ন পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম। তৃপ্তি লাভ করিয়াছি । ইহার বিশেষত্ব আছে সেজন্য ইহা আদরণীয়। এই সঙ্গে দধি সেবন করিলাম তা বিশেষ প্রশংসার যোগ্য। “
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জলযোগের দইয়ের নামকরণ করেছিলেন #পয়োধি। একসময় একথা মুখে মুখে প্রচারিত হয়েছিল। এর সমর্থনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন লিখিত তথ্য সংগ্রহ না থাকলেও বলা যেতে পারে এমনধারা নামকরণ একমাত্র রবীন্দ্রনাথই করতে পারেন।
কলকাতার কাছে পানিহাটিতে ১৯৩৪ সালের ২৩ শে সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ উদ্বোধন করেন #বাসন্তী_কটন_মিল। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন #আচার্য_প্রফুল্লচন্দ্র_রায়। এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্যই সিংহল হতে প্রত্যাবর্তন করে উপস্থিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বহু গণ্যমান্য ব্যাক্তিও উপস্থিত হন। রবীন্দ্রনাথ এবং সভাপতিসহ অন্যান্য বক্তার ভাষণের পর রবীন্দ্রনাথ ” একটি ইলেকট্রিক বোতাম টিপিয়া দেন, যন্ত্রপাতি চলিতে থাকে ও মিলের কাজ আরম্ভ হয়।”
বোতাম টেপার আগে রবীন্দ্রনাথ বলেন – “এই সুজলা সুফলা বঙ্গদেশের শিল্প-বাণিজ্য একদিন যন্ত্রদৈত্যের প্রবল পেষনে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বহুকাল পরে সেই যন্ত্রদৈত্যকেই আমাদের নষ্ট শিল্পের পুনরুদ্ধারের কাজে আমরা নিযুক্ত করেছি, তার সঙ্গে আমরা একটা আপোষ করে নিয়েছি।”
রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক বাসন্তী কটন মিলের উদ্বোধনের সংবাদ প্রকাশেই মিলের পক্ষে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিজ্ঞাপন ।
রবীন্দ্রনাথ সেনোলা রেকর্ড কোম্পানি, ভোলানাথ দত্ত অ্যান্ড সন’স লিমিটেডের কাগজ এবং ডরকিনস হারমোনিয়াম কোম্পানির জন্যও বাণী লিখে বিজ্ঞাপন করেছিলেন। এমনকি ৮ ধর্মতলার অপেরা পরিচালক হরেন ঘোষের মৃত্যুর পর অর্ঘ্যবাণীও লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সে সময়ের ফটো স্টুডিও এস ঘোষের নামডাক কতখানি ছিল তা জানা যায় না। তবে এই প্রতিষ্ঠানের জন্য দু’কলম লিখে দিয়েছিলেন কবিগুরু। তিনি বলছেন—‘এস ঘোষ আমার যে দুটি ফটোগ্রাফ তুলেছেন তা অতি সুন্দর ও সুনিপুণ। দেখে আমি বিস্মিত ও সন্তুষ্ট হয়েছি। তাদের ব্যবসায়ে তারা যে যথেষ্ট সফলতা লাভ করবেন তাতে আমার সন্দেহ নেই।’
রবীন্দ্রনাথও সেই বাজার-অর্থনীতির অংশ হয়েছেন, কখনো বন্ধুজনের অনুরোধে, কখনো স্বদেশি বন্ধুদের পণ্য বিপণনের জন্য, আবার কখনও হয়তো অজ্ঞাতেও।
নিজেদের তোলা ছবির পাশে সেই প্রশংসাসূচক কথাগুলো বিজ্ঞাপনে দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। এরপরেই নিজেদের বিশেষত্ব ও ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে স্টুডিওতে আসার আমন্ত্রণ। ভাবখানা এমন—কবিগুরু যখন ছবি তুলিয়ে খুশি, আপনারা কি আর নাখোশ হবেন!
রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন শিল্প-উদ্যোক্তাদের কাছে কতটা জনপ্রিয় ছিলেন তার প্রমাণ মেলে এস সি রায় অ্যান্ড কোং-এর বিজ্ঞাপনে। কলকাতার ১৬৭/৩ কর্নওয়ালিশ রোডে নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে ওরা তৈরি করত পাগলের ওষুধ। সেই ওষুধের বিজ্ঞাপনেও রবীন্দ্রনাথের প্রত্যয়ন পত্রের সন্ধান মেলে। ডাক্তার উমেশচন্দ্র রায়ের জগদ্বিখ্যাত ‘পাগলের মহৌষধ’ শিরোনামের সেই বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে—
৭০ বৎসরের ঊর্ধ্বকাল যাবৎ লক্ষ লক্ষ দুর্দ্দান্ত পাগল ও সর্ব্বপ্রকার বায়ুগ্রস্ত রোগীর আরোগ্য করিয়াছে। মূর্চ্ছা, মৃগী, অনিদ্রা, হিষ্টিরিয়া, অক্ষুধা, স্নায়বিক দুর্ব্বলতা প্রভৃতি রোগেও ইহা আশুফলপ্রদ। প্রতি শিশি মূল্য ৫ টাকা।
বিবরণী-পুস্তিকা বিনামূল্যে পাঠাই ।“আমি ইহার উপকারিতা বহুকাল যাবৎ জ্ঞাত আছি”—রবীন্দ্রনাথ।
ভাবুন ব্যাপারখানা! রবীন্দ্রনাথের সার্টিফিকেটে পাগলের ওষুধ!রবীন্দ্রনাথের লেখা বিজ্ঞাপনগুলো প্রকাশিত হয়েছে—প্রবাসী, বসুমতি, কলকাতা মিউনিসিপাল গেজেট, ভাণ্ডার, শনিবারের চিঠি, সাধনা, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাসহ আনন্দবাজার পত্রিকা, অমৃতবাজার পত্রিকা, দি স্টেটসম্যান ও অ্যাডভান্সসহ বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে। তবে সংখ্যা অনুযায়ী আনন্দবাজার পত্রিকাতেই সবচেয়ে বেশি ছাপা হয়েছে তাঁর বিজ্ঞাপন।
রবীন্দ্রনাথ যে কত ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে আক্ষরিক অর্থে বাঙ্গালীর জীবনধারণের সহায়ক হয়ে উঠেছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেওয়া হয়নি। রবীন্দ্রনাথের গান ,রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা , রবীন্দ্রনাথের কবিতা, নাটক, রবীন্দ্র নৃত্য ধারাকে আশ্রয় করে সংস্কৃতি জগতে কত মানুষ যে নিজেদের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সঙ্গে মানুষের জীবিকার উপায় করে নিয়েছেন পত্র-পত্রিকায় তার পরিচয় পেতে অসুবিধা হয় না । তাঁর নামের স্পর্শ অনেক ক্ষেত্রে অসাধ্য সাধন করেছে। তাই ব্যবসায়ীরাও রবীন্দ্রনাথ নামের জাদুকে কাজে লাগিয়ে বাণিজ্য বিস্তারের সুযোগকে হাতছাড়া করতে চাননি। বিভূতিভূষণ গুপ্ত থেকে শুরু করে স্টার থিয়েটার প্রত্যেকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নাম জড়িয়ে আছে। তাঁর নাম লক্ষ লক্ষ মানুষের অন্নসংস্থানের কাজে লাগতো । তাই রবীন্দ্রনাথ কোনোদিন সাহায্য করতে দ্বিধাবোধ করেননি।
সমাপ্ত
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ আনন্দবাজার প্রথম খন্ড
২. বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ