জনজীবনে কত ঘটনাই ঘটে। কিন্তু তার কটাই বা মানুষ মনে রাখে? আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনা ভুলিয়ে দেয় গতকালের মর্মান্তিক ঘটনাকে। তা সত্ত্বেও এমন কিছু ঘটনা হয়, যেগুলো মানুষের স্মৃতিতে অন্যগুলোর চাইতে দীর্ঘস্থায়ী হয়। সাম্প্রতিককালে টিকিয়াপাড়ার লকডাউন বিরোধী দাঙ্গা এর অন্যতম উদাহরণ। অনেকেই আজও ভোলেননি সেই দৃশ্য, যেখানে এক লুঙ্গি পরিহিত দাঙ্গাবাজ প্রায় উড়ে এসে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের এক আধিকারিককে পেছন থেকে লাথি মারছে। কিংবা তার পরের দৃশ্যটি – যেখানে কর্তব্যরত র্যাফ জওয়ানরা দাঙ্গাবাজ জনতার হাত থেকে বাঁচতে গাড়ির ভেতর আশ্রয় নিচ্ছেন। ভিডিও ক্লিপটি এতটাই ভাইরাল হয়েছিল যে সর্বভারতীয় ইংরেজি প্রচার মাধ্যমগুলো এটি নিয়ে সংবাদ করে।
উক্ত দাঙ্গাবাজ জনতাটি একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের – বিহার-উত্তর প্রদেশ বংশোদ্ভূত উর্দুভাষী সুন্নী, যাদের সংক্ষেপে বিহারী মুসলমান বলা হয়। এই ঘটনার কয়েক মাস আগে এই সম্প্রদায়ের দাঙ্গাবাজদেরই নাগরিকত্ব আইন বিরোধী সহিংস প্রতিবাদের সামনের সারিতে দেখা গেছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদানের বিরোধিতা করে ভারতের জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে ভারতের সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করে এরা। ২০১৮ তে এই সম্প্রদায়েরই কিছু মানুষ পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসনের উপর প্রভাব বিস্তার করে একটি সম্পূর্ণরূপে বাঙালি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম দাড়িভিটের উচ্চ বিদ্যালয়ে উর্দু মাধ্যম চালু করার অপচেষ্টা করেছিল।
পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিল বাঙালি হিন্দুর হোমল্যান্ড বা বাসভূমি হিসেবে। পশ্চিমবঙ্গ শুধুমাত্র একটা ভৌগোলিক অঞ্চল নয়, পশ্চিমবঙ্গ একটি ধারণা, একটি আবেগ, একটি স্বপ্ন। পশ্চিমবঙ্গ বাঙালি হিন্দুর বেঁচে থাকার পরিসর, যেখানে তাঁরা নির্বিঘ্নে তাঁদের ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা করতে পারবে। অথচ পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্বের মৌলিক ভিত্তি এই ধারণাকে প্রতিনিয়ত লঙ্ঘন করা হচ্ছে। টিকিয়াপাড়াতে ‘বাঙালি হিন্দুর বাসভূমি’র আইনকে পদদলিত করাই হোক, বা বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে ‘বাঙালি হিন্দুর বাসভূমি’তে আগত বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব প্রদানই হোক, বা দাড়িভিটে বাঙালি হিন্দু ছাত্রছাত্রীদের ওপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়াই হোক – এই সব ঘটনাতেই বাঙালি হিন্দুর স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার পরিসরটুকু ক্রমাগত আক্রান্ত হচ্ছে। এমন নয় যে, এই জাতীয় ঘটনা কখনও আগে ঘটেনি। কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে বর্তমানে এই জাতীয় ঘটনার সংখ্যা ও তীব্রতা দুই ই বছর বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই সমস্ত ঘটনার জন্য শুধুমাত্র জনমুখী, ভোটব্যাঙ্ক সর্বস্ব তোষণ নীতিকে দায়ী করা ঠিক নয়, কারণ তাতে সমস্যার অন্য দিকটি এবং বিশেষ করে তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি উপেক্ষিতই থেকে যায়। মুসলিম লীগ যখন উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক বাসভূমির দাবি তোলে, তার নাম দেয় ‘পাকিস্তান’, আক্ষরিক অর্থে ‘পবিত্র স্থান’ বা ‘পবিত্রতার স্থান’। এই নামকরণের মধ্যেই নিহিত ছিল অনা-ইসলামি ও অমুসলমান ‘খাদ’কে অস্বীকার করা। লীগ নেতৃত্ব চেয়েছিল যে সম্পূর্ণ বাংলা ও আসাম নিয়ে এক বৃহৎ পূর্ব পাকিস্তান গড়তে। সেই উদ্দেশ্যে, ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে, পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে তারা। কিন্তু গোপাল মুখোপাধ্যায়, যুগল ঘোষ, ভানু বোস ও অন্যান্যদের সশস্ত্র প্রতিরোধ ও প্রতিশোধের তীব্রতায় সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। দেশভাগের সময় আসাম তো দূরস্থান, শ্যামাপ্রসাদ ও অন্যান্যদের আন্দোলনের ফলে সম্পূর্ণ বাংলাও পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় না, পাকিস্তানের বুক চিরে জন্ম নেয় পশ্চিমবঙ্গ।
কলকাতাবিহীন পাকিস্তানকে জিন্নাহ ‘পোকায় কাটা পাকিস্তান’ বলে মেনে নিলেও, বিহারের মুসলিম লীগ নেতৃত্ব, যাদের অনেকেই কলকাতায় বসবাস করতেন তাঁরা এই বাস্তবকে মেনে নিতে চাননি। ১৯৪৭ এর গোড়ার দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের পাকিস্তানিকরণের জন্য যে পরিমাণ অর্থ ও শ্রম তাঁরা ব্যয় করেন, তারপর এই পরিণতি তাঁদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। পশ্চিমবঙ্গকে বাঙালি হিন্দুর বাসভূমি হিসেবে মানতে অস্বীকার করে, পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী বিহারী মুসলমান নেতৃত্ব এই সময় থেকে এক অলীক জগতে বিচরণ করতে থাকেন। সেটা প্রমাণ হয় ২০১৬-তে যখন বিহারী মুসলমান বংশোদ্ভূত জনৈক শীর্ষ নেতা এক পাকিস্তানি সাংবাদিককে তাঁর বিধানসভার অন্তর্গত অঞ্চলগুলি ঘুরিয়ে দেখানোর সময় সেগুলোকে ‘মিনি পাকিস্তান’ হিসেবে পরিচয় দেন। পশ্চিমবঙ্গের পাকিস্তানিকরণের স্বপ্ন যে এখনও পূর্ণমাত্রায় জাগরূক তা পূর্বের ঘটনাগুলোতেই প্রকাশ পায়।
১৯৪৭-এর শুরুতে বাংলার পশ্চিম অঞ্চলের পাকিস্তানিকরণের জন্য মুসলিম লীগ নেতৃত্ব ঠিক কি করেছিলেন? ইতিহাসের এই বিস্মৃতপ্রায় অধ্যায়কে মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং। ২০১২-তে প্রকাশিত তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে বিহার দাঙ্গার পরবর্তী ছয় সপ্তাহ তাঁর স্বেচ্ছাসেবক কালের বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। সেই সময় মুজিব ছিলেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দীর শিষ্য। সুরাবর্দীর প্রতিভূ হয়ে পাটনায় গিয়ে বিহার এবং সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ নেতাদের মুজিব বোঝাতে সক্ষম হন যে বাংলার মুসলিম লীগ সরকার বিহারী মুসলমানদের পশ্চিমবঙ্গে পুনর্বাসনের জন্য কতখানি আন্তরিক। বিহার সরকারের একজন মুসলমান আই সি এস অফিসারের সাহায্যে মুজিব হাজারখানেক বিহারী মুসলমানের প্রথম দলটি নিয়ে আসানসোল পৌঁছান এবং প্রথম শিবিরটি স্থাপন করেন। স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্যে আসানসোল অঞ্চলে মুজিব মোট সাতটি শিবির স্থাপন করেন, যাতে ৫০,০০০-এরও বেশী বিহারী মুসলমান বসবাস করতে শুরু করেন।
মাত্র ২৬ বছর বয়সে মুজিব শুধু একজন দক্ষ নির্বাহকই ছিলেন না, পাকিস্তানের আদর্শগত দিকগুলি সম্পর্কেও আদ্যোপান্ত সড়গড় ছিলেন। কেন্দুলিয়াতে দ্বিতীয় শিবিরটি স্থাপনের সময় তিনি কেন্দুলিয়ার নাম পরিবর্তন করে হিজরতগঞ্জ রাখেন। অর্থাৎ বিহারী মুসলমানদের পশ্চিমবঙ্গে আগমনকে তিনি ৬২২-এ মহম্মদ ও তাঁর অনুচরদের মক্কা থেকে মদিনাতে হিজরতের অনুসরণ বলেই মনে করতেন। বাংলাকে তিনি মদিনা অর্থাৎ মুসলমানদের আপনভূমি বলে দেখেছিলেন, যার সাথে মুসলিম লীগের সম্পূর্ণ বাংলা নিয়ে পাকিস্তান গঠনের দাবির সাথে কোনো অসঙ্গতি ছিল না। বিহারী মুসলমান মোহাজেরদের প্রতি বাংলার মুসলমানদের উষ্ণ আতিথেয়তার প্রমাণ দেওয়ার জন্য সদা তৎপর ছিলেন মুজিব, ঠিক যেমনটি মদিনার আনসারিরা মক্কার মোহাজেরদের প্রতি দেখিয়েছিল।
স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করা পাশাপাশি, সুরাবর্দী ছাড়া মুজিব আর যার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের পাকিস্তানিকরণের পরিকল্পনার কাজটি করতেন তিনি হলেন মৌলানা রাগিব আহসান। জন্মসূত্রে বিহারের হলেও কলকাতা থেকে প্রকাশিত মুসলিম লীগ সমর্থিত পত্রিকা ‘স্টার অফ ইন্ডিয়া’-র সম্পাদক হওয়ার সুবাদে ১৯৩৬ সালে কলকাতায় চলে আসেন তিনি। সেই বছরই জিন্নাহর সাথে সাক্ষাতের পর তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন ও জিন্নাহর উপদেষ্টা হন। ১৯৪৬-এ কলকাতা থেকে গণপরিষদে নির্বাচিত হন। বিহার দাঙ্গার পরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে পাটনায় একটি পুনর্বাসন কার্যালয়ও খোলেন। বিহারী মুসলমানদের পশ্চিমবঙ্গে পুনর্বাসনের কাজ মাস তিনেক তত্ত্বাবধান করার পর তিনি জিন্নাহকে একটি চিঠি লেখেন, যা থেকে তাঁদের পরিকল্পনার কিছু ধারণা পাওয়া যায়।
চিঠির শুরুতেই রাগিব প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ব্যর্থতার জন্য তিনটি জিনিসের অভাব উল্লেখ করেন – প্রত্যক্ষ সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার মত মানুষ, অর্থ ও যানবাহন। যানবাহনের গুরুত্বকে তুলে ধরতে তিনি কোরানের আয়াত উল্লেখ করেন। এই তিনটি অভাব পূরণের জন্য বাংলার বিহারী মুসলমানদের পক্ষ থেকে তিনি দশ লক্ষ টাকা দাবি করেন। বাংলায় বিহারী মুসলমান পুনর্বাসনের ব্যাপারে জিন্নাহ প্রাথমিকভাবে ১.৫ লক্ষের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করলেও, কলকাতা ও আসানসোলে ৩.৫ লক্ষ পুনর্বাসন ইতিমধ্যেই সম্পূর্ণ হওয়ায়, তিনি লক্ষ্যমাত্রাকে বাড়িয়ে ১০ লক্ষ করার প্রস্তাব দেন। পাকিস্তান হওয়ার পর কলকাতার সম্পূর্ণ ইসলামিকরণের জন্য তিনি দুটি প্রস্তাব দেন – পাট শিল্পের জাতীয়করণ, ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের জমিতে আরও ৫ লক্ষ (বিহারী) মুসলমানের পুনর্বাসন। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আসানসোলের ইসলামিকরণের একটি পরিকল্পনা দেন তিনি।
পশ্চিমবঙ্গকে পাকিস্তানের এমনকি স্বাধীন যুক্তবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করার মরিয়া প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হওয়ার আগে অবধি পাকিস্তানিকরণের এই প্রক্রিয়া চালু ছিল। বাঙালি হিন্দুর বাসভূমি হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ গঠনের পর অবশ্য এই বেআইনি পুনর্বাসনকে বাতিল করা হয়নি। দেশভাগের পর বিহারী মুসলমানরা পূর্ববঙ্গের খুলনা, সৈয়দপুর, মিরপুর, নারায়ণগঞ্জ প্রভৃতি শহরে কলোনি গড়ে তোলে। এই বিহারী মুসলমান সম্প্রদায়ের গুন্ডা ও রাজাকাররাই যথাক্রমে ১৯৬৪ ও ১৯৭১-এর বাঙালি হিন্দু গণহত্যায় অংশগ্রহণ করে। আজ পর্যন্ত এর কোনো বিচার হয়নি। বাংলাদেশের জন্মের পর এই বিহারী মুসলমানরা ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ করে এবং ১৯৪৭ থেকে বসবাসরত বিহারী মুসলমানদের সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
বিহারী মুসলমান নেতৃত্বের পাকিস্তানিকরণের এই স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করতে হবে বাঙালি হিন্দুকেই। বাঙালি হিন্দু নেতৃত্বের পশ্চিমবঙ্গকে ‘বাঙালি হিন্দুর বাসভূমি’ হিসেবে পুনরুদ্ধার করার সময় এসেছে আজ। তাঁদের আজ গর্বের সাথে বলতে হবে বাঙালি হিন্দুরাই পশ্চিমবঙ্গের ভূমিপুত্র। পশ্চিমবঙ্গের সম্পদ ও সুযোগের উপর তাঁদের প্রথম অধিকার। অভিবাসী সম্প্রদায়রা পশ্চিমবঙ্গে কর্মসূত্রে বসবাসের জন্য অবশ্যই স্বাগত, কিন্তু ততটাই, ঠিক যতটা তাঁরা পশ্চিমবঙ্গকে ‘বাঙালি হিন্দুর বাসভূমি’ বলে সম্মান করতে প্রস্তুত। বিহারী মুসলমান সম্প্রদায় তার কোনো ব্যতিক্রম নয়।