এক বছর আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, এক মাসের মধ্যে সুন্দরবন অঞ্চলে ধাপে ধাপে ৫ কোটি ম্যানগ্রোভ গাছ লাগানো হবে। তাঁর সেই ঘোষণা আটকে আছে মুখের কথাতেই। গত বছর আমফানের তাণ্ডবে সুন্দরবনের একটা বড় অংশ বিপর্যস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। নতুন করে ওই সব এলাকায় ম্যানগ্রোভ গাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য সরকার। গত ৩ জুন মুখ্যমন্ত্রী নবান্ন থেকে বিভিন্ন জেলাশাসক, পুলিশ সুপার এবং জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে বৈঠক করেন। আমফান পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি পূরণের লক্ষ্যে রূপরেখা ঠিক করে দেন। তিনি বলেন, “সুন্দরবনে ক্ষয়ক্ষতি ভালই হয়েছে। ওই এলাকায় মাটি শক্ত করতে আরও ম্যানগ্রোভ লাগাতে হবে। নতুন করে সবুজ তৈরি করতে হবে। রাজ্যের থানাগুলোকে বলছি, কম লোক নিয়ে নিজের নিজের এলাকায় গাছ লাগাতে হবে।”
সেই ম্যানগ্রোভ আর লাগানো হয়নি। শুক্রবার সুন্দরবনে গিয়ে তিনি এ কারণে প্রকাশ্যেই ক্ষোভ জানান। ম্যানগ্রোভ লাগিয়ে কেন সুন্দরবন বাঁচানোর চেষ্টা হচ্ছে না? এর জন্য মানুষকেই দায়ী করেছেন রাজ্যের সেচ দফতরের প্রাক্তন আধিকারিক অনীশ ঘোষ। যিনি কর্মসূত্রে প্রায় দু’দশক ছিলেন সুন্দরবনে। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, “ম্যানগ্রোভ লাগানোর জায়গা কোথায়? তটে গাছ কেটে একে একে ফিশারিজ তৈরি হয়েছে। সমুদ্রের জলে ভাল মাছ চাষ হয়। হোটেল হয়েছে। সুন্দরবনের স্থায়ী উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা অনেকে বলছেন, কিন্তু সমন্বয়টা হবে কী করে?“
২০০৪ সালের শেষ ডিসেম্বরে সুনামির তাণ্ডব থেকে বেঁচে গিয়েছিল সমুদ্র লাগোয়া বেশ কিছু এলাকা। তামিলনাড়ু, আন্দামান আর শ্রীলঙ্কা উপকূলের যে অংশে ম্যানগ্রোভের ঘন জঙ্গল ছিল, সেগুলি ধ্বংস করতে পারেনি ওই প্রাকৃতিক তাণ্ডব। ম্যানগ্রোভের জঙ্গল বিপুল জলরাশিকে আটকে দিয়েছিল। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য কলকাতা শহরে ঢোকার পথে ঘূর্ণিঝড়ের সামনে পাঁচিল তুলে দাঁড়িয়েছে বরাবর। শুধু ঝড়ের গতি আটকানোই নয়, ফুলেফেঁপে ওঠা সমুদ্রের জল থেকে ভূমিক্ষয় রোধের একমাত্র প্রতিবিধান এই ম্যানগ্রোভ।
কেন এই অবস্থা? পরিবেশবিজ্ঞানী তথা অধ্যাপক শুভশ্রী ঠাকুর এই প্রতিবেদককে জানালেন, “সমুদ্রের জলস্তর বেড়ে যাওয়ার কারণ বিশ্ব উষ্ণায়ন। মেরু অঞ্চলের বরফের স্তুপ দ্রুত গলছে। যত দিন যাচ্ছে পরিমাণটা বাড়ছে। আর, ম্যানগ্রোভের জঙ্গলের ঘনত্ব কমে যাওয়াতেই প্রাকৃতিক ঝড় তেমন ভাবে প্রতিহত করতে পারছেনা এই প্রাকৃতিক দেওয়াল।এই ম্যানগ্রোভের শক্ত শিকড় মাটিকে টেনে রাখে। তাই এই গাছ যত কমে গিয়েছে মাটি ক্ষয়ে জলের তোড়ে ধুয়ে যাচ্ছে। একটু একটু করে জলের নিচে চলে যাচ্ছে সুন্দরবনের স্থলভূমি।“
নামখানার দ্বারিকনগর এলাকার বাসিন্দা বছর ষাটের শ্যামসুন্দর জানা, পেশায় প্রাইভেট টিউটর, তাঁর কথায়, ‘‘আগে দেখতাম নদীর পাড় বরাবর যতদূর চোখ যায় ততদূর গাছ । কিন্তু একের পর এক ঝড়ের তাণ্ডবে গাছের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে । অনেক সময় অসৎ মানুষজনও প্রচুর গাছ কাটছে । এলাকায় বড় গাছ কই? আমফান আর ইয়াস— দুই বিপর্যয়ে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।“ ঘূর্ণিঝড় আমফানের জেরে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল সুন্দরবনের বহু ম্যানগ্রোভ। এরপর ইয়াস। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় সরকারি তথ্য অনুযায়ী এই দুই তাণ্ডবে সব মিলিয়ে বেশ কয়েক লক্ষ বড় গাছ ভেঙে গিয়েছে। সবুজ কমতে থাকায় চিন্তিত সুন্দরবন তথা উপকূল এলাকার মানুষের একাংশ। চিন্তার ভাঁজ শহুরে পরিবেশবিজ্ঞানীদেরও।
সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ অমিতাভ আইচ জানিয়েছেন, ওখানকার বহু এলাকা অপেক্ষাকৃত উঁচু হয়ে তাতে নুনের ভাগ বেড়ে গিয়ে টাকের মতন হয়েছে। সেখানে কখনও সোয়েডা নামক এক প্রকার নোনা টক শাক ছাড়া কিছুই গজায় না। সুন্দরবনে প্রায় ৭০ প্রজাতির ম্যানগ্রোভ ও বাদাবনের প্রজাতির গাছ দেখতে পাওয়া যায় আর তার ৩৫টি হল প্রকৃত ম্যানগ্রোভ। এর মধ্যে অন্তত দুটো প্রজাতি এই লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে এ দেশের সুন্দরবন থেকে প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে, আর সে দুটি হল সুন্দরী (হেরিটিয়েরা ফোমিস) ও গোলপাতা (নিপা ফ্রুটিকানস)। অত্যাধিক ভাবে কমে গেছে সবচেয়ে ক্ষয়রোধী গর্জন (রাইজোফোরা), যা মূলত খাড়ির ধারে দেখা যায়। ধুঁধুল, পশুর (জাইলোকারপাস), এমনকি কাঁকড়া (ব্রুগয়রা), গরিয়া (ক্যানডেলিয়া ক্যানডেল)- এর মতো গাছ যথেষ্ট সংখ্যায় আর নেই।
গোটা সুন্দরবন জুরে এখন বানি (মূলত এভিসিনিয়া অফিসিনালিস বা সাদা বাইন), গেওয়া (এক্সোকেরিয়া আগালোচা), কিছুটা খর্বকায় গরান (সেরিওপস ডেকানড্রা) আর উঁচু জমিতে হেতাল (ফেলিক্স পেলুডোসা) এর মনোকালচারের মতো পরিস্থিতি প্রায়। আর কেওড়ার (সোনারেসিয়া এপিটালা) প্রজাতিগুলি রয়েছে বিচ্ছিন্ন ভাবে, এর আরেকটি প্রজাতি, ওড়া বা ম্যানগ্রোভ আপেল (সোনেরেসিয়া ক্যাসিওলারিস) পূর্ব সুন্দরবনে খুব কমে গেছে, এবং অপেক্ষাকৃত কম লবণাক্ত অংশ ও পশ্চিম সুন্দরবনেই কিছু আছে।
সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের এক দশকের মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় এই প্রতিবেদককে বলেন, “এই নির্বিচারে ম্যানগ্রোভ কাটা এবং বেআইনি চিংড়ি ও মাছ চাষের জন্য মানুষই দায়ী। প্রশাসন শক্ত হাতে ব্যবস্থা নিলে যদি কিছু হত। মুখ্যমন্ত্রী মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখভাল করার কমিটির চেয়ারম্যান করে দিয়েছেন। কিন্তু উনি নিজেই জানেন কি কত কমিটি আর টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান?“
জেলা পুলিশ ও প্রশাসন, মৎস্য, বন, সুন্দরবন উন্নয়নের মতো সংশ্লিষ্ট দফতরগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের ফাঁক গলে চলছে সুন্দরবনের ধ্বংশলীলা। ম্যানগ্রোভ গাছ নয়। গাছের একটি প্রজাতি। এরা লবণাম্বু উদ্ভিদ। অর্থাৎ, যে জমিতে নুনের ভাগ বেশি, এরা সেখানে জীবনধারণ করতে পারে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার জন্য এই জাতীয় গাছের প্রজাতির বেশ কিছু অভিযোজনগত বৈশিষ্ট্য আছে। সমুদ্রের তীরবর্তী যে সব জমি দিনের অর্ধেক সময় জোয়ারের জলে ডুবে থাকে এবং বাকি সময়ে জল নেমে যায়, সেখানেই জন্মায় ম্যানগ্রোভ। সুন্দরবনেও তেমনই হয়। কথিত যে, সুন্দরবনের নাম একটি ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ ‘সুন্দরী’ থেকে এসেছে। সুন্দরী ছাড়াও গর্জন, গেঁওয়া, বাইনের মতো লবণাম্বু উদ্ভিদ নিয়েই সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য। এই প্রজাতি মাটি থেকে অতিরিক্ত নুন শোষণ করে তা পাতায় সঞ্চয় করে রাখে। নুনের পরিমাণ সম্পৃক্ত হয়ে গেলে সেই পাতা গাছ থেকে খসে পড়ে। এই ভাবে ম্যানগ্রোভ মাটিতে নুনের ঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ করে। ম্যানগ্রোভের জঙ্গল যত ঘন থাকবে, তার প্রচণ্ড বেগের ঝড় বা প্রবল জলোচ্ছ্বাসের প্রতিরোধ ক্ষমতা তত বাড়বে।
সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যে ছড়িয়েছে অসুখ। একটি অসুখ পুরোপুরি প্রাকৃতিক। অন্যটি মানুষের তৈরি। বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা বাড়ছে। তাতে উঁচু হচ্ছে ঢেউ। জলোচ্ছাসে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। সেই ঢেউ এসে পড়েছে সুন্দরবনেও। গত ১০-১৫ বছরে ঘোড়ামাড়া দ্বীপ পুরোপুরি চলে গিয়েছে সমুদ্রবক্ষে। জম্বুদ্বীপের বড় এলাকা বিলীন। ওই দুই দ্বীপের ম্যানগ্রোভ জঙ্গল পুরোপুরি বিনষ্ট। তাই ওই এলাকা দিয়ে জোরালো বাতাস চলে আসছে দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনার লোকালয় ছাড়িয়ে কলকাতার দিকে। আমপান তার প্রমাণ। আর এ সব জানা সত্ত্বেও ম্যানগ্রোভের জঙ্গল কেটে লোকালয় তৈরির কাজ চলছে নদী সংলগ্ন কিছু অংশে। সুন্দরবনের গভীরতম এলাকার সুন্দরীর গাছের আকৃতি দেখলেই পরিষ্কার যে, গাছের ঘনত্ব কী বিপজ্জনক ভাবে কমছে। উপগ্রহে চিত্রে সুন্দরবনের মাঝখানটা দেখলে মনে হবে টাক পড়ে গিয়েছে। আসলে মাটিতে অত্যাধিক নুনের উপস্থিতি সুন্দরী গাছের অভিযোজনগত পরিবর্তন ঘটিয়েছে। গাছগুলি বেঁটে হয়ে গিয়েছে। ঝাঁকড়া হচ্ছে না। ঠেসমূলের বুনোটও জমাট হচ্ছে না। ঝড়ে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
2021-05-30