সময় ভাসে ভাটির নৌকায়
দিদৃক্ষা প্রহরে মৃত পারিজাত
বিষে কাতর চিরহরিৎ রাত-
যোজন দূরে শ্বেতদ্রাঘিমা!

টেরাকোটা গড়া শিল্পকলায়
ফ্রেমবন্দী সুখে যাদুশহর
নিমীল চোখ ধূসরতা নিয়ে
পথ হাঁটছ নিথর বুকে।

বঙ্গের নানা স্থানে সুপ্রাচীন মন্দিররাজি ব্যতীত সপ্তদশ শতক হতে সূচিত করে ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় গ্রামে গ্রামে সে সকল মন্দির নির্মিত হয়েছিল , তার সংখ্যাও যেরূপ কম নয়, সেরূপ তার সামাজিক , ঐতিহাসিক , এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বও কম নয়।কিন্তু নানা রাজনৈতিক পট পরিবর্তন বৈদেশিক আক্রমন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহাকালের অমোঘ নিয়মে সেই মন্দির গুলি অধিকাংশই আজ বিনষ্ট। এছাড়াও মারি মড়ক, দুর্ভিক্ষ, বিশেষ করে ম্যালেরিয়ার আক্রমনে এক সময় বাংলার গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হওয়ার কারনে এই সব মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাংলার বহু মন্দির আজ ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে। এক সময় বঙ্গে পাথর নির্মিত এবং বিশেষরূপে টেরাকোটার অলঙ্করণ যুক্ত করে যে স্থাপত্য ভাস্কর্যের নিদর্শন রেখে গিয়েছে তা বাংলার এক নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য হিসাবে গন্য হতে পারে।

বাংলার এই সকল মন্দির – শিল্পগুলির রূপায়ণ ও বিবর্তন ঘটেছে একটি সীমাবদ্ধ অঞ্চল জুড়ে নয়। এক একটি জনপদের বিভিন্ন ভৌগলিক অঞ্চল জুড়ে , সামাজিক ও অর্থনৈতিক ঘটনা বিন্যাসের উপর ভিত্তি করে এক একটি আঞ্চলিক সংস্কৃতির রূপায়ণ ও ক্রমে সেটি তার নিজস্ব সুষমায় দীপ্ত হয়ে উঠেছে।

বাংলার টেরাকোটা – মনোমুগ্ধকর, নিপুণ, অপরূপ , জগতখ্যাত। বাংলার টেরাকোটা বঙ্গ জীবনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতিফলনকে বিশ্বসংসারে উদ্ভাসিত করে তোলে।নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখতে পাই বাংলার টেরাকোটা শিল্পে যেমন স্থান পেয়েছে রামায়ন, মহাভারত, দেব দেবী, নানা পৌরাণিক উপাখ্যানগুলি তেমনি স্থান পেয়েছে আমাদের সাধারণ মর জীবনের বিভিন্ন সামাজিক ঘটনাও।

শ্রদ্ধেয় বিভিন্ন টেরাকোটা গবেষকরা, মন্দির টেরাকোটার পর্যায় ও সময়কাল ধরে মন্দির ও টেরাকোটার উপর বিভিন্ন তথ্য আমাদের সম্মুখে এনেছেন। এসব টেরাকোটায় আমরা যেমন গতানুগতিক এবং ধারাবাহিক ঘটনাক্রম দেখতে পাই তেমনি বহু বিচ্ছিন্ন ও ব্যতিক্রমী টেরাকোটা শিল্পশৈলীও দেখতে পাই। তাকে আমরা টেরাকোটার ভাষায় মৃত্যুর ফলক বলতে পারি অথবা পঞ্চভূতে লীন হবার একটি পদ্ধতির ফলক বলতে পারি। সেগুলো অনেকের কাছেই ভয়াবহ এবং অশুভ। কেউ দেখে শিউরে ওঠে।অথবা নাক সিঁটাকায় ঘৃণায়। কারুর কাছে সেটা হল জৈবিক নিয়ম।

হুগলী জেলা, টেরাকোটা মন্দির সৃষ্টিতে রত্নগর্ভা। বিভিন্ন যুগপর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত বহু বহু টেরাকোটা মন্দিরের ধারক এই জেলা। অসংখ্য টেরাকোটা ফলকের মধ্যে গতানুগতিক ও ধারাবাহিক ফলকগুলিকে বাদ দিলে এই হুগলী জেলার টেরাকোটা মন্দির নগরীতে বেশ কিছু ব্যতিক্রমী ফলকের সন্ধান পাওয়া যায়। এর মধ্যে বেশ কিছু ফলক আছে যা আমাদের চেতনাকে নাড়া দিয়ে যায়। অন্তত একবারের জন্য স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়াতে হয়। তারপর হয়ত চোখ সরিয়ে নিতে হয় বা শিউরে উঠতে হয়….ওঃ মাগো ….এমনও হয়?

হ্যাঁ হয়, হয়েছিল….কয়েক শতাব্দী আগে …শিল্পী করতে পেরেছিলেন সেই কাজ। শিল্প মানেই সুন্দর নয়, যিনি অসুন্দর ভয়কে সুন্দর রূপে প্রকাশিত করতে পারেন তিনিই শিল্পী। তবেই তাঁর সাধনা সার্থক।

সেই যে শাপমোচন নাট্যে রাজা মহিষীকে বলেছিলেন ,
“অসুন্দরের পরম বেদনায় সুন্দরের আহ্বান। সূর্যরশ্মি কালো মেঘের ললাটে পরায় ইন্দ্রধনু,তার লজ্জাকে সান্ত্বনা দেবার তরে। মর্তের অভিশাপে স্বর্গের করুণা যখন নামে তখনি তো সুন্দরের আবির্ভাব। প্রিয়তমে,সেই করুণাই কি তোমার হৃদয়কে কাল মধুর করে নি।”

মৃতদেহকে শকুনে বা শৃগালের খাদ্য হতে চাক্ষুষ অবলোকন করা আমাদের নিকট অতীব অতীব ভয়ঙ্কর ও পীড়াদায়ক।কিন্তু সে যতই পীড়াদায়ক , ভয়াল , অশুভ দৃশ্যই টেরাকোটা মন্দিরের বিষয়বস্তু। এমন ধরনের বেশ কিছু ফলক হুগলী জেলার কয়েকটি টেরাকোটা মন্দিরে দেখা যায়। এখনো পর্যন্ত চারিটি মন্দিরে এমন ধরনের টেরাকোটা ফলক দেখা যায় এবং ঘটনাচক্রে সব কটি হুগলী জেলায়-

১. রাজরাজেশ্বর মন্দির , কোটালপুর বা কোতলপুর
২. দামোদর মন্দির, বাহিরগড়
৩. পরিত্যক্ত মন্দির, আকনাপুর
৪.অনন্ত-বাসুদেব মন্দির, হরিপাল, ভট্টাচার্য পাড়া

এবার এক এক করে একটু সেই মন্দিরগুলি ও ফলকগুলির কিছু পরিচয় প্রদান করা যাক –

১. রাজরাজেশ্বর মন্দির : কোটালপুর বা কোতলপুর গ্রাম, হুগলী ও হাওড়া জেলার সীমান্তবর্তী ছোট গঞ্জ সীতাপুর থেকে খুব কাছেই ….থানা – জাঙ্গীপাড়া।হাওড়া জেলার জগৎবল্লভপুর বা হুগলী জেলার জাঙ্গীপাড়া থেকে খুব সহজেই এখানে পৌঁছনো যায়।এই গ্রামে পরিত্যক্ত আটচালা মন্দির আছে। প্রতিষ্ঠাতা বাকুলী পরিবার, প্রতিষ্ঠা লিপিটি আংশিক ভগ্ন। কেবলমাত্র দুইটি অঙ্ক পড়া যাচ্ছে …১৬।

শ্রী নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য রচিত ” হুগলী জেলার পুরাকীর্তি” গ্রন্থে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকাল ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দ বলে উল্লিখিত হয়েছে। অর্থাৎ সেটি ১৬১৬ শকাব্দ হতে পারে।মন্দিরটি বর্তমানে জীর্ণ ও পরিত্যক্ত। কিন্তু এটি হল হুগলী জেলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ টেরাকোটার মন্দির। অযত্নে এর মধ্যে ঝোপ ঝাড় গজিয়ে গেছে। ত্রিখিলান প্রবেশপথের ডানদিকের খিলানের নিচের দিকে একটি ফলক আছে যেখানে দেখা যায় দুটি শকুন একটি মৃতদেহ খাচ্ছে।একদম উপরে কালী ও মহিষাসুম্মর্দিনীর ফলক , তারপর রাম রাবনের যুদ্ধের ফলক , পরিশেষে মৃত্যু রূপী শকুনের ফলক। শকুন দুটির ডানদিকেরটি আংশিক ভগ্ন। কেন্দ্রীয় খিলানেও রাম রাবনের যুদ্ধ, পত্রকৃতি খিলানের নিম্নপ্রান্তের দুইদিকে দুটি শকুনের ( শকুন নাও হতে পারে। কারন ডানদিকেরটির মাথায় ঝুঁটি একদা দৃশ্যমান)অবস্থান।

২. দামোদর মন্দির: জাঙ্গীপাড়া থানা এলাকায় অবস্থিত বাহিরগড়। মূল জাঙ্গীপাড়া থেকে কিয়দ দূরে অবস্থিত। এখানেই অবস্থান করছে সিংহরায় পরিবারের প্রতিষ্ঠিত দামোদর মন্দির। প্রতিষ্ঠা কাল ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দ। এই মন্দিরটিও রাজরাজেশ্বরের সমতুল্য টেরাকোটা অলঙ্করণ যুক্ত। এই মন্দিরে দেব বিগ্রহ আছেন ও তিনি নিত্য পূজিত হন।মন্দিরটি ত্রিখিলান প্রবেশ পথযুক্ত। এই মন্দিরটি ২০০৮ সাল থেকে মন্দিরটি হেরিটেজ নির্মাণ হিসাবে ঘোষিত হয়েছে। এই মন্দিরের বাম দিকের পত্রাকৃতি খিলানের উপরের অংশের মাঝে দেখা যায় দুইটি শকুন একটি মৃত দেহ খাচ্ছে এবং তার ডানদিকে অপর দুটি শকুন অন্য একটি মৃতদেহ খাচ্ছে।উপরে যুদ্ধের ফলক।

৩. পরিত্যক্ত মন্দির : তারকেশ্বর থানা এলাকায় অবস্থিত আকনাপুর। ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে কুন্ডু পরিবার কতৃক একটি মন্দির নির্মিত হয়। মন্দিরটি আটচালা রীতি অনুসারে নির্মিত। বর্তমানে এই মন্দিরটি পরিত্যক্ত। ত্রিখিলান প্রবেশপথযুক্ত এই মন্দিরটি কেন্দ্রীয় খিলানের ডানদিকে নীচে দুটি শকুন একটি মৃতদেহ খাচ্ছে ও এর উপরে দুটি শৃগাল মৃতদেহ খাচ্ছে এমন ফলক আছে।খিলানের উপরে রাম রাবনের যুদ্ধ হচ্ছে। এখানে অতিরিক্ত প্রাপ্তি হল দুটি শৃগাল।

৪. অনন্তবাসুদেব মন্দির : হরিপালের ভট্টাচার্য পাড়ার আটচালা অনন্ত-বাসুদেব মন্দিরে নিচের বামদিকে একটি ফলক আছে। সেখানে দুটি শকুনকে কিছু একটা ছিঁড়ে খেতে দেখা যায়। ফলকটি ভগ্ন ও শ্যাওলা ধরা।কিন্তু এখানে পারিপার্শ্বিক ফলকের নিরিখে এর অবস্থান নির্নয় করা বেশ কঠিন। প্রসঙ্গত মন্দিরটি অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংস্কার করার ফলে পলেস্তারায় ফলক গুলো ঢাকা পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। খুব সামান্য কিছু হাতে গোনা ফলক দেখা যায়। তার মধ্যে এই শকুনের ফলক অন্যতম। এছাড়াও একক ভাবে বেশ কিছু শকুনের ফলক সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে নানা টেরাকোটা মন্দিরে দেখা যায়।

এবার প্রশ্ন হল এই ফলক গুলো নির্মাণের কারন কি? মন্দিরের মতো শুভ স্থানে এমন ফলক কেন? আলোচনা হোক পরের পর্বে….

ক্রমশঃ

দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ হুগলী জেলার টেরাকোটায় ব্যতিক্রমী ফলক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.