গত ১৪ই ফেব্রুয়ারি ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের পুলওয়ামায় সিআরপিএফ কনভয়ের উপর পাকিস্তানি সাহায্যপ্রাপ্ত সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি সংগঠন জয়েশ-ই-মহম্মদ আত্মঘাতী জিহাদি হামলা চালায়। এর বলি হন চল্লিশেরও বেশি সিআরপিএফ জওয়ান, এবং আহত হন আরও অনেকে। এই কাপুরুষোচিত, নারকীয় হত্যালীলা আমাদের মনে করিয়ে দেয় মহাভারতের সৌপ্তিক পর্বে কৌরব সেনাপতি অশ্বত্থামার পাণ্ডব শিবিরে গোপনে প্রবেশ এবং দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্রসহ ঘুমন্ত পাণ্ডবপক্ষীয় যোদ্ধাদের হত্যার কথা। এই ধরণের ঘটনা দেশভাগের সত্তর বছর অতিক্রান্ত হবার পরেও ভারতের ভূখণ্ডে পুনঃপুনঃ ঘটবার কারণ হ’ল সময় থাকতে ভারতবর্ষের শত্রুদের নিকেশ না করা। শান্তি, দয়া এবং ক্ষমার বাণী শুনিয়ে, বাস্তববোধ রহিত হিতাহিতজ্ঞানশূন্য উন্মত্তের মতো “যুদ্ধ নয় শান্তি চাই” স্লোগানে আকাশ বাতাস কম্পিত ক’রে মূঢ় বামমনস্ক চিন্তাধারা বহু বৎসর যাবৎ ভারতবর্ষের সামরিক শক্তিকে, বিশেষ ক’রে তার বায়ুসেনার শক্তিকে, সীমিত ক’রে রেখেছে।একদিকে এই অবিমৃষ্যকারিতা এবং অপরদিকে নির্বাচনের অঙ্কের হিসেব মাথায় রেখে তথাকথিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলিকে তুষ্ট করবার বৃথা চেষ্টার ফলস্বরূপ একের পর এক ধর্মান্ধ জিহাদি নাশকতার শিকার হয়েও ভারতে ক্ষাত্রশক্তির সদ্ব্যবহার করা হয়নি।
এই শক্তিপূজা না ক’রে, এই শক্তিকে জাগিয়ে না তুলে কেবল একতরফা শান্তির বাণী আউড়ে গেলে শত্রু যে কখনোই শান্তির পথ অবলম্বন করে না – সে কথার প্রমাণ মহাভারতেতিহাসের আখ্যানে বারংবার পাওয়া যায়। সাম, দান, দণ্ড ও ভেদ এই চার পন্থার মধ্যে থেকে দণ্ডকে বাদ দেওয়া হ’লে রাজ্যের শাসনতন্ত্র যে ভেঙে পড়ে, সে শিক্ষা ভারতের প্রাচীন আচার্যগণ বহু শতাব্দী পূর্বেই দিয়ে গিয়েছেন। পরিতাপের বিষয়, আজকের অর্বাচীন শাসক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সে শিক্ষার মর্ম গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। দেশের নিজস্ব ইতিহাস ও প্রজ্ঞা হ’তে একাধিক নবীন প্রজন্মকে বঞ্চিত ক’রে রাখবার নিট ফল হচ্ছে পুলওয়ামা হত্যালীলার মতো ঘটনা।
ক্ষমা বীরের ভূষণ –দেশভাগোত্তর খণ্ডিত ভারতবর্ষেএই আপ্তবাক্যটির চিরকাল বিকৃত ব্যাখ্যা হয়ে এসেছে। দেশভাগের পরে যাঁদের জন্ম, সেইসব প্রজন্মগুলিকে শৈশব থেকে স্কুলপাঠ্য বই আর বামপন্থী মাস্টারমশাইদের মাধ্যমে তোতাপাখির মতো ক’রে পড়ানো হয়ে এসেছে যে যিনি শত্রুকে ক্ষমা করতে পারেন, তিনিই বীর। সরলমতি ভারতীয় শিশু আজন্ম তাই শুনে শুনে আর প’ড়ে প’ড়ে এই ভুল বিশ্বাসনিজমনে বদ্ধমূল ক’রে ফেলেছে যে অন্যায়কারী দুষ্ট শত্রুকে অনন্তকাল ধ’রে একতরফা ক্ষমা করে যেতে হবে – একমাত্র তবেই সকলেতাকে ও তার জন্মভূমি দেশটিকে বাহবা দেবে, তার অহিংস ক্ষমাশীলতায় মুগ্ধ হয়ে জগতসভার শ্রেষ্ঠ আসনটি স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেবে। এই ধরণের ভুল শিক্ষা পাওয়া শিশুর মনস্তত্ত্ব কখনোই কৈশোরের গণ্ডি ছাড়িয়ে – প্রৌঢ়ত্ব তো দূরে থাক্ – এমনকী স্বাধীন চিন্তাভাবনার যৌবরাজ্যেও পদার্পণ করতে পারে না। তার চিন্তাশক্তির বিকাশ গোড়াতেই রুদ্ধ, স্তব্ধ হয়ে যায়।একমাত্র শক্তিমানকেই সকলে সম্ভ্রম করে, তার বাক্যের যথোচিত মর্যাদা দেয় – বাস্তব জগতের এই রূঢ় অথচ প্রকৃত সত্যের সঙ্গে বড় হয়ে সে নিজেকে আর খাপ খাওয়াতে পারে না, কারণ ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।
তখন এমনতর ধেড়ে শিশুদের একমাত্র গতি হয় ইডিওলজি – হয় চরম বামপন্থা নয় চরম দক্ষিণপন্থার শরণ নিয়ে নিজের নিজের প্রফেটের বাণী সম্বল করেই এদের জীবন কাটে।অথচ ঠিক সময়ে ঠিক ঠিক শিক্ষা পেলে বেচারা শিশুটি জানতে পারত যে ক্ষমা করলেই বীর হওয়া যায় না, বরং বীর হ’তে পারলে তবেই ক্ষমা করা যায়। বীরত্ব হচ্ছে ক্ষমাশীল হবার পূর্বশর্ত। এর উল্টোটা কখনোই ধোপে টেঁকে না। বীর ব্যক্তি যে সবসময় ক্ষমাশীল হবেনই এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না; কিন্তু একমাত্র বীরপুরুষই শত্রুকে ক্ষমা করবার ক্ষমতা ধরেন, সে ক্ষমার কাজ তাঁর কীর্তির সম্ভারে অলঙ্কারের ন্যায় শোভাবর্ধন ক’রে থাকে। যে দুর্বল, যে ক্লীব, তার মুখে ক্ষমার বাণী কেবল হাসির উদ্রেক করে মাত্র।যে নিজেই আপনার চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী ব্যক্তিরদয়া-ক্ষমার উপর নির্ভরশীল, সে অন্যকে ক্ষমা করবে কীভাবে?
এই সত্য মনে করিয়ে দিতেই রামায়ণ এবং মহাভারতের প্রসঙ্গ অবতারণা ক’রে দেশভাগোত্তর কালের আধুনিক হিন্দি কাব্যের শক্তিশালী কবি শ্রী রামধারী সিংহ ‘দিনকর’ বর্তমান কবিতাটির অবতারণা করেছেন। ছন্দবদ্ধ পদে ধ্বনিময়তার ঝঙ্কার তোলা তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয় যেন শ্রীমদ্ভগবদগীতায় শ্রীভগবানের অমোঘ উচ্চারণ শুনছি – যেন ভগবান বাসুদেব নরঋষির অবতার অর্জুনকে নিজ কর্তব্যকর্ম মনে করিয়ে দিচ্ছেন। তাঁর সমগ্র কাব্যকৃতির মতো এই কবিতাতেও সরল অথচ তীরের ফলার মতো সুতীক্ষ্ণ শব্দ ও পদ চয়ন শ্রোতা তথা পাঠকের বুকে এসে বেঁধে – স্থাণুর পিনাকের টঙ্কারের মতো তাঁদের বিবেককে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তোলে। দিনকরের কাব্যের সংগীতময়তা বাংলা অনুবাদে রক্ষা করবার যথাসাধ্য চেষ্টা এখানে করা গেল – মূল কবিতায় তাঁর বরাবর অজস্র সংস্কৃতগন্ধী হিন্দি শব্দের ব্যবহারের অভ্যাসটির মাধ্যমে কবি স্বয়ং একাজে সুবিধে ক’রে দিয়ে গেছেন, কেননা সেসব শব্দ তাদের দ্যোতনা-ব্যঞ্জনা সমেত বাংলার শব্দভাণ্ডারের নিজস্ব সম্পদ। এই কবিতা যত না একলা ব’সে মনে মনে নিঃশব্দে পাঠের যোগ্য, তার চেয়ে অনেক বেশি ক’রে সহৃদয় শ্রোতার সম্মুখে উচ্চারণের, আবৃত্ত হবার দাবী রাখে।
ক্ষমা, দয়া, তপঃ, ত্যাগ, মনোবল
সবেরই নিয়েছ সহায়
কিন্তু হে নর! বলো, বাঘ বা সুযোদ্ধা
কবে কোথায় মেনেছে পরাজয়?
ক্ষমাশীল হয়ে রিপুর সমুখে
তুমি বিনীত হয়েছ যতই,
দুষ্ট কৌরবগণ তোমাকে
কাপুরুষ ভেবেছে ততই।
অত্যাচার সহন করবার
কুফল এমনই হয়
কোমল হবার বিনিময়ে
মানুষের পৌরুষ পায় ক্ষয়।
ক্ষমা শোভা পায় সেই ভুজঙ্গকে
যার দশনে রয়েছে গরল;
তাকে নয়, যে নখদন্তহীন–
বিষরহিত, বিনীত, সরল।
তিনদিন ধ’রে পথ চেয়ে ব’সে
রঘুপতি সাগর তীরে
কাটালেন সিন্ধুর কাছে প্রার্থনা ও
অনুনয় বিনয় ক’রে।
উত্তরে যখন একটিও ধ্বনি
সমুদ্র হ’তে উঠল না,
উঠল তখন ধকধক জ্ব’লে
রামবাণে অধীর পৌরুষের ফণা।
সিন্ধু দেহ ধ’রে ত্রাহি-ত্রাহি রবে
এলেন রামের শরণে,
পূজে শ্রীচরণ ত্বরা ধরা দিলেন
মূঢ় দাসত্বের বন্ধনে।
সত্যি বলতে, শরেরই ভিতর
বিনয়-দীপ্তি লুকোনো থাকে,
সন্ধি-বচনও তাকেই মানায়
যে যুদ্ধজয়ের শক্তি রাখে।
সহনশীলতা, ক্ষমা, দয়া
জগতে তখনই মূল্য পায়
বলের দর্প যখন এদের
প্রেক্ষাপটে ঝক্মকায়।