২৮ তারিখ থেকে আরও কয়েকশো চাকরিপ্রার্থীর মতোই অনশনে বসেছিলেন মেদিনীপুরের শক্তিপদ মাইতি। ১৫ ফেব্রুয়ারি খবর এসেছিল, মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটেছে বাবার। বেলদার হোসেনপুর গ্রামের বাসিন্দা শক্তিপদ ফিরে গিয়েছিলেন খবর পেয়ে। ফোনে যোগাযোগ রাখতেন অনশনকারী সতীর্থদের সঙ্গে। বলতেন, “বাবা একটু ঠিক হলেই আমি ফিরব কলকাতায়। যোগ দেব অনশনে। তোমরা চালিয়ে যাও।”
শক্তিপদ ফিরেছিলেন, কিন্তু একা নয়। বাবাকে সঙ্গে নিয়ে। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় এনআরএস হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় পেশায় কৃষক, সুবল মাইতিকে। রবিবার চলে গেছেন সুবল। ছেলে চাকরি পেল কি না, দেখা হল না তাঁর। অথচ বড় আশা ছিল, ‘চাষার ছেলে’ হয়েও হাল ধরতে হবে না তাঁর আদরের ছেলেকে। শক্তিপদই পরিবারের প্রথম সাক্ষর সন্তান। তাঁর আগে পর্যন্ত সকলেই কৃষিকাজ করেছেন।
শক্তিপদ ভূগোলে স্নাতকোত্তর পাশ করেছিলেন ভাল নম্বর নিয়ে। তার পরে এসএসসি দিয়েছিলেন, স্বপ্নের পেশা শিক্ষকতায় যোগ দেবেন বলে। যে দিন পরীক্ষা পাশের খবর এল, সে দিন মোটামুটি সারা গ্রামে খবর দিয়ে এসেছিলেন সুবলবাবু। তাঁর আদরের সন্তান আর কয়েক দিনের মধ্যেই স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়াবে! এ তো স্বপ্ন!
স্বপ্ন সত্যি হওয়ার পরেও যে এভাবে চুরমার হয়ে যেতে পারে, ভাবতেও পারেননি সুবলবাবু। ‘চাষার ছেলে’ শক্তিপদর ভবিষ্যৎও এখনও অনিশ্চয়তার মুখে। ২৭ দিনের অনশন আন্দোলনের শেষেও তিনি এখনও জানতে পারেননি, তাঁর কোনও দিনও স্বপ্নের ক্লাসরুমে একঘর ছেলেমেয়েকে ভূগোল পড়ানো হবে, নাকি বাবার মতোই লাঙল নিয়ে মাঠে নামতে হবে তাঁকে।
ধর্মতলায় প্রেস ক্লাবের সামনে এসএসসি চাকরিপ্রার্থীদের যে অনশন চলছে, তারই একটি চরিত্র এই শক্তিপদ। এ রকম কয়েকশো চরিত্র তাঁদের আলাদা আলাদা লড়াই, যন্ত্রণা, অসুবিধা– সব উপেক্ষা করে এক জায়গায় হয়েছেন। তাঁদের লড়াই, যন্ত্রণা কম-বেশি আলাদা হলেও, দাবি একটাই। পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে যে ন্যায্য ও প্রাপ্য যে শিক্ষকতার চাকরি তাঁদের পাওয়ার কথা, সেটাই পেতে চান তাঁরা। আর যদি চাকরি না-ও পান, তা হলেও তার বিস্তারিত কারণ নথি-সহ জানতে চান। জানতে চান শূন্যপদ ও চাকরিপ্রার্থীর সঠিক সংখ্যা।
এই দাবিটুকু আঁকড়েই ২৭ দিন পেরোল আজ আন্দোলন তথা অনশনের! অনাহারের ২৭ দিন, অসুস্থতার ২৭ দিন, জলে ভেজা রোদে পোড়া ২৭ দিন!
আজ বেলায় যখন অনশন মঞ্চে পৌঁছে দেখা গেল, সূর্য তখন ঠিক মাথার ওপর। মিনিট দশেক ওঁদের সঙ্গে বসে কথা বলতে বলতেই বুঝলাম, রোদের তাপে মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে রীতিমতো। একটু আড়াল পেলে ভাল হতো। নিজে থেকেই বুঝে মাথার উপর ছাতা ধরলেন, এক অনশনকারী নিজেই। লজ্জা করল। কড়া রোদ্দুর মাথায় নিয়ে ২৭ দিন ধরে না খেয়ে বসে থাকা মেয়েটির ছাতার আরামটা নিতে সত্যিই লজ্জা করল। সরে গেলাম।
“এত রোদ! আপনাদের কষ্ট হচ্ছে না? কিছু টাঙানো যায় না মাথার ওপর?”
এক অনশনকারী জানালেন, টাঙালেই খুলে দিচ্ছে পুলিশ। চোখের সামনেই ঘটল এমনটা। কয়েক জন অনশনকারী মহিলাদের উপরে একটি ত্রিপল টাঙানোর জন্য গাছে দড়ি বাঁধতে গেলেন, পাশ থেকে উঠে এলেন ঘটনাস্থলে মোতায়েন থাকা পুলিশ। বাধা দিলেন। কয়েকটি ত্রিপল অবশ্য আছে ফুটপাথের ধার ঘেঁষে, কিন্তু তা অত জন অনশনকারীর জন্য মোটেই পর্যাপ্ত নয়।
ডিসি সাউথ মীরাজ খলিদকে প্রশ্ন করা হয়, এত রোদে ন্যূনতম ত্রিপলটুকু টাঙাতে না-দেওয়া কি অমানবিকতা নয়? তিনি এ বিষয়ে বলেন, “এলাকাটা সেনার অধীনে। আমরা সেনার নির্দেশ পালন করছি মাত্র। রোদে কষ্ট হয় জানি, কিন্তু এ ক্ষেত্রে অমানবিকতা বা মানবিকতার প্রশ্ন নেই। এই বিষয়টি কোনও ভাবেই আমাদের হাতে নয়। মানবিকতা মানবিকতার জায়গায়, আইন আইনের জায়গায়।” প্রশ্ন ওঠে, গোটা ধর্মতলা এলাকা জুড়ে যে ত্রিপল খাটিয়ে ফুটপাথ জুড়ে রমরম করে ব্যবসা চলছে, তা কি আদৌ আইনি? উত্তর মেলে না।
প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারতে একটু দূরের সুলভ শৌচালয়ই ভরসা। পয়সা খরচ করে আব্রুটুকু পাওয়া যায়। কিন্তু মুশকিল হয় রাতে। তখন সুলভ শৌচালয় বন্ধ। “পেছনের ওই ঝোপঝাড়ে, অন্ধকারে কাজ সারি। কী করব বলুন! উপায় কী!”– বললেন এক তরুণী। প্রাকৃতিক নিয়মেই এই ২৭ দিনে ঋতুচক্র এসেছে অনেক মহিলা অনশনকারীর। তাঁদের অবস্থা আরও দুর্বিষহ। ন্যূনতম পরিচ্ছন্নতা ছাড়াই ব্যবহার করতে হচ্ছে শৌচালয়। এই মুহূর্তে ইউরিনারি ট্র্যাক ইনফেকশনে ভুগছেন একাধিক মহিলা।
ক্লাস থ্রি-তে পড়ে সম্রাজ্ঞী বসাক। মা দীপিকা দাসের কোল ঘেঁষে বসে রয়েছে সে। দীপিকা বললেন, “মেয়েকে বাড়িতে রেখে ছিলাম। এখন ওকে দেখার কেউ নেই। তাই সঙ্গে নিয়ে এসেছি। থাকবে এখানেই।” ছোট্ট সম্রাজ্ঞী বলল, “মায়েরা সকলে চাকরি পাওয়ার জন্য এত কষ্ট করছে। আমিও চাই চাকরি পেয়ে যাক সবাই। মা কিছু খাচ্ছে না, আমার ভাল লাগছে না।”
এ দিন অনশনকারীদের সংহতি জানাতে এসেছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি পেনশনার্স সমিতি। ৬০ বছর ও তারও ওপরের চল্লিশ জন সদস্য জোর গলায় জানালেন, এ আন্দোলন তাঁদের ঘরের ছেলেমেয়েদের আন্দোলন। তাঁরা সংহতি জানাতে এবং সব রকম সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে আজ মঞ্চে হাজির হয়েছেন। বাদ যাননি ৮৪ বছরের বৃদ্ধও।
মাধ্যমিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতির তরফে ১২ সদস্যের একটি দল হাজির হন দুপুরে। তাঁদের সেক্রেটারি, বিশ্বজিৎ মিত্র চেতলার কৈলাস বিদ্যামন্দিরের প্রধান শিক্ষক। তাঁর ক্ষোভ, “সরকার কোন মুখে বলে শূন্যপদ নেই! শূন্যপদ আছে কি না, আমাদের জিজ্ঞেস করা হোক! প্রতিটা স্কুল থেকে রিপোর্ট নেওয়া হোক! আমি এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বলছি, আমার স্কুলে ১৪ জন শিক্ষকের পদ খালি। প্রাক্তন ছাত্রদের অনুরোধ করে, কিছু পয়সার বিনিময়ে আমি পড়ানোর ব্যবস্থা করি। নইলে স্কুলে তালা পড়ে যেত এত দিনে।”
বিশ্বজিৎ বাবুর অভিযোগ, সরকার সব জেনেও চোখে ঠুলি পরে রয়েছে। স্কুলে স্কুলে শিক্ষকের হাহাকার সরকারের অজানা নয়। অজানা নয়, অতিথি শিক্ষকের সংখ্যাও। তাঁর স্কুলেই এই মুহূর্তে ন’জন শিক্ষক অতিথি হিসেবে পড়ান বলে দাবি করেন তিনি। দাবি করেন, একাধিক বিষয়ে একাধিক বছর ধরে শিক্ষক নেই। বারবার শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আবেদন করেও ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। “অথচ এখানে যোগ্যতা নিয়ে রাস্তার ধারে না খেয়ে পড়ে রয়েছে এতগুলো ছেলেমেয়ে! এরা তো মাত্র কয়েকশো। আমি জোর দিয়ে বলছি, সারা রাজ্যের স্কুলগুলিতে এর কয়েক গুণ বেশি আসন ফাঁকা আছে। সততা থাকলে সরকার সেই তালিকাই প্রকাশ করুক। জানিয়ে দিক, শূন্যপদের সংখ্যা কত।”
না, সরকারের তরফে কোনও ইতিবাচক বার্তাই এসে পৌঁছয়নি এখনও। বরং শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টপাধ্যায় সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়েছেন, ‘বেআইনি’ দাবি নিয়ে এত দিন ধরে অনশন করছেন এতগুলি মানুষ। প্রশ্ন তুলেছেন, অনশনকারীরা সকলে ‘যোগ্য’ কি না।
কিন্তু এই আইন, যোগ্যতা, প্রশ্ন– সব কিছু আজ মানবিকতার মুখাপেক্ষী হয়ে রয়েছে। সকলেই বলছেন, যা-ই হোক না কেন দাবি, যেমনই হোক না কেন পরিস্থিতি। সরকার কি একটি বার সরাসরি এসে কথা বলতে পারে না? পারে না কোনও রফাসূত্র বার করতে? মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী কি একটি বার হস্তক্ষেপ করতে পারতেন না, না খেয়ে পড়ে থাকা এতগুলি ছেলে-মেয়ের সমস্যায়? উত্তর দিনাজপুর থেকে আসা এক অনশনকারীর প্রশ্ন, “একটু দূরেই তো থাকেন দিদি। এক বার আসতে পারেন না?”
প্রশ্ন আরও অনেক। প্রশ্ন, এই মুহূর্তে রাজ্যের স্কুলগুলিতে মোট শূন্যপদ কত? প্রশ্ন, এ পর্যন্ত কত জন নিয়োগ হয়েছেন এসএসসি পাশ করে? প্রশ্ন, এসএসসি উত্তীর্ণরা কেন তাঁদের প্রাপ্ত নম্বর জানতে পারবেন না?
এই সমস্ত প্রশ্ন এবং অভিযোগ নিয়েই ফের সরকারের দফতরে যাচ্ছেন অনশনকারীরা। মনীষ জৈনের নেতৃত্বে গঠন করা কমিটির কাছে তা জমা দেবেন তাঁরা। ফের অপেক্ষা করবেন, উত্তরের। আশা করবেন, ইতিবাচক কোনও পদক্ষেপের। না পেলে?
অনশন চলবে।