ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে রামায়ণের অবদান অপরিসীম। রামায়ণ একই সঙ্গে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রামকথার মৌখিক ঐতিহ্য পরিব্যাপ্ত ছিল ভিয়েতনাম, লাওস, কাম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড থেকে পার্শ্ববর্তী নেপাল, মায়ানমার এবং বাংলাদেশে। আর আঞ্চলিক স্তরে রামায়ণের কাহিনি বিধৃত রয়েছে তামিল ভাষায় কম্বনের রামায়ণে, তেলুগু রঙ্গনাথ রামায়ণে। ওড়িয়ায় পাচ্ছিসরলা দাসের ‘বিলঙ্ক রামায়ণ’, আর বলরাম দাসের ‘জগমোহন রামায়ণ’। এর আগে চতুর্দশ শতকে অসমীয় ভাষায় ‘সপ্তকাণ্ড রামায়ণ’ পঞ্চদশ শতকে, সরলা দাসের রচনাও তাই। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে পূর্বভারতে রামায়ণের চর্চা এবং প্রভাব প্রতিষ্ঠিত ছিল। যদিও রামকথার মৌখিক ঐতিহ্য সুপ্রাচীনকাল থেকে ভারতভূমিতে প্রবাহিত। প্রখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ এইচ ডি সাংকালিয়া অভিমত প্রকাশ করেছেন, রামের কাহিনি খ্রিস্টপূর্বাব্দ ২৮৫০ থেকে ১৯৫০ এই প্রায় হাজার বছরের মধ্যে দানা বেঁধেছিল। যদিও অধ্যাপক দীনেশ চন্দ্র সরকার এই কাহিনির সূচনা হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ এমনটি বলেছেন। তাহলে বলা যায়, বৃহত্তর ভারত ভূখণ্ডে বহমান একটি রামকথার ধারা আঞ্চলিক সংস্কৃতিতে আপন বৈশিষ্ট্য নিয়ে পরবর্তী সময়ে বিকশিত হয়েছিল ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তার মধ্যে। বঙ্গদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি, কৃত্তিবাসী রামায়ণ তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ। শুধু কৃত্তিবাসী নয়, বঙ্গে রামকাহিনি বারংবার পুনর্কথিত হয়েছে। রাম যে বাঙ্গালির জনজীবনে পরতে পরতে মিশে গিয়েছেন তা সবচেয়ে ভালো বোঝা যায় বঙ্গের লোকসংস্কৃতির মধ্য দিয়ে। একই সঙ্গে বলার হনুমানের প্রতি ভক্তি সন্দর্শনে বঙ্গদেশের ইতিহাস নিতান্ত অর্বাচীন নয়। বাংলাদেশের রাজশাহীর নরেন্দ্র মিউজিয়ামে রাখা সম্ভবত ১১-১২ শতকের বেলে পাথরের হনুমান মূর্তি বঙ্গদেশের বজরংবলীর উপস্থিতির পাথুরে প্রমাণ হাজির করে। দাস্য ভক্তিভাবের চরম নিদর্শন হনুমানকে বাঙ্গালির কবিতার সুললিত কাব্যে ধরেছেন এই ভাবে :
এতেক শুনিয়া তবে পবনকুমার।
কলেবর নখে চিরি করিল বিদার।।
সভামধ্যে দেখাইল বিদারিয়া বক্ষ।
অস্থিময় রামনাম লেখা লক্ষ লক্ষ।।
গোপাল হালদার লিখেছেন, ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ অন্তত চারশো বছর ধরে বাঙ্গালির আপন হয়ে উঠেছে। তার মতে, বাল্মীকিকে মেনেও, কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাঙ্গালির নিজের ঘরোয়া আদর্শকে ধরে রেখেছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণে রাম বীর হলেও বাঙ্গালি বীর, স্নেহ মমতায় গড়া এক কোমল প্রকৃতির মানুষ— এই হলো শ্রীযুক্ত হালদারের বক্তব্য। ডব্লু এল স্মিথ তার Ramayana Tradition in Eastern India গ্রন্থে লিখছেন : The original Ramayana had been diffused in eastern India where at a very early date it had evolved into a distinct Eastern or Gaudian recension.
স্পষ্টই বলা হয়েছে, পূর্ব ভারতে রামায়ণের গৌড়ীয় ধারা রয়েছে। বস্তুত, রামায়ণ কাহিনির এই লোক প্রচলিত ধারা বাঙ্গালি সংস্কৃতির মৌলিক ঐতিহ্যকে আশ্রয় করে প্রবাহিত হয়েছিল। এটি যেমন লোকসাহিত্যে প্রকাশিত হয়েছিল, তেমনি লোকশিল্প মাধ্যমেও রামায়ণ পল্লীতে পল্লীতে ছড়িয়ে পড়ে। পটুয়ারা রামায়ণের কাহিনিকে উপজীব্য করে পট আঁকতেন এবং জড়ানো পটের সেই কাহিনিকে গান সহযোগে গ্রামঞ্চলে পরিবেশন করতেন। পটুয়ারা মিশ্র ধর্মীয় সংস্কৃতির বাহক ছিলেন। হিন্দু নামকরণ, আচার এবং বিষয়বস্তু অবলম্বন করার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান রীতি-ধর্ম পালন করতে দেখা যায় এই পটুয়াদের। এটি বঙ্গদেশের একান্ত নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঘরানা। বীরভূমের পটুয়ারা সমগ্র রামায়ণের কাহিনিকে মূল চারটি খণ্ডে পরিবেশন করতেন তাদের পটচিত্রের মধ্যে দিয়ে। প্রথম খণ্ডটি দশরথের দ্বারা অন্ধমুনির পুত্রকে হত্যা করা দিয়ে শুরু হয়। দ্বিতীয় খণ্ড রামের জন্ম থেকে বিবাহ অবধি কাহিনি বিবৃত করত। তৃতীয় খণ্ডে ছিল রাবণের মৃত্যু অবধি ঘটনাবলী। আর চতুর্থ খণ্ডে থাকত সীতার বনবাস। এই জেলায় লক্ষ্মণকে নিয়ে আলাদা পট আঁকা হতো— এখানে লক্ষ্মণ অবতার। সুতরাং বলা যায় বঙ্গদেশের লৌকিক সংস্কৃতি রামকাহিনিকে নিজের মতো করে ধারণ করেছে, ব্যাখ্যা করেছে এবং প্রকাশ করেছে সাধারণীকরণের মধ্য দিয়ে।
বঙ্গপ্রদেশের গায়েনরা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে রামায়ণ গান করতেন। বয়স্ক মানুষদের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে রামায়ণের নির্বাচিত পংক্তি গায়েনরা পরিবেশন করতেন— যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল রামের বনবাস, দশরথের মৃত্যু এবং তৎপরবর্তী কৌশল্যা ও সুমিত্রার বিলাপ। আসলে বাঙ্গালি জীবনের এই সমস্ত অবশ্যম্ভাবী সংঘটনের সঙ্গে বাঙ্গালি কবি তার রামায়ণ কাহিনিকে এভাবেই সংযোজিত করেছেন— যা একান্তভাবে বাঙ্গালির আবেগকে তুলে ধরেছে। পূর্ববঙ্গের চন্দ্রাবতীর রামায়ণ, যা বঙ্গদেশের আরেক অতুলনীয় সম্পদ, এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিবাহ প্রভৃতি অনুষ্ঠানে মহিলারা চন্দ্রাবতীর রামায়ণ গাইতেন। রামায়ণে গানের এই ধারা এখনও বঙ্গে এবং বৃহত্তর বঙ্গে বিলুপ্ত হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ সংলগ্ন ঝাড়খণ্ডের জামতাড়াতেও রামায়ণ গায়করা রয়েছেন, যারা অখণ্ড বঙ্গ ও বাঙ্গালির সামনে রামায়ণ গান পরিবেশন করেন।
একথা ঠিকই কৃত্তিবাসী রামায়ণের বহু পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছে। এগুলির মধ্যে ভিন্নতা নেই এমন নয়। কিন্তু এই বিভিন্নতা রামায়ণ চর্চার ব্যাপকতার পরিচয় বহন করে একথা অনস্বীকার্য। এই রকম প্রায় দেড় হাজার পাণ্ডুলিপির কথা উল্লেখ করেছেন ডব্লু এল স্মিথ। ফলে বাঙ্গালির জীবনে রামের প্রভাব অন্তঃসলিলা ছিল দীর্ঘকাল ধরেই। যে কারণে পট ও গীতিকা ছাড়াও ছড়া-প্রবাদেও রামের এবং রামায়ণের অনুষঙ্গ বারংবার এসেছে। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
(১) রাম না হতে রামায়ণ।
(২) সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই।
(‌৩) যে যায় লঙ্কায়, সে হয় রাবণ।
(৪) রামের বাণে মরি ভালো, বাঁদরের দাঁত খিচুনি সহ্য হয় না।
(৫) লঙ্কায় রাবণ ম’লো, বেহুলা কেঁদে রাঁড় হলো। আবার,
বড়ো বড়ো বানরের বড়ো বড়ো পেট।
লঙ্কা ডিঙোতে সব মাথা করে হেঁট।।
কথন প্রবচনে রামায়ণের অনুষঙ্গ বারংবার আসছে। যেমন- ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’, ‘কালনেমির লঙ্কা ভাগ’, ‘দেবর লক্ষ্মণ’, ‘লঙ্কা বহুদূর’, ‘সীতার অগ্নিপরীক্ষা ইত্যাদি। এমনকী। ‘বানরের গলায় মুক্তার মালা’-র পেছনে কৃত্তিবাসী ললিত ছন্দের প্রেক্ষাপটটি অন্তর্লীন। থেকেছে। প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি দিই :
লক্ষ্মণ বলেন, প্রভু করি নিবেদন।
মারুতির গলে হার দিলে কি কারণ।।
সহজে বানর গণ্য পশুর মিশালে।
রত্নহার দিলে কেন বানরের গলে।।
ধর্ম, বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে রামায়ণ এবং রাম কথার প্রভাব যে অনপনেয় তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। একান্ত ভয়ের মুহূর্তেও তাই বাঙ্গালি রামকে স্মরণ করেছে। বিপত্তারণ রূপে। আমরা ছোটোবেলার এই ছড়াটির কথা কি ভুলে গেলাম?
ভূত আমার পূত, পেত্নী আমার ঝি।
রাম-লক্ষ্মণ সঙ্গে আছে, ভয়টা আমার কী।।
বঙ্গদেশের বনবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যেও রামের উপস্থিতি লক্ষণীয়। অযোধ্যা পাহাড়ে রামচন্দ্র-সীতা-লক্ষ্মণ এসেছিলেন এমন কাহিনি স্থানীয় সাঁওতাল সমাজ তাদের মৌখিক ঐতিহ্যে ধরে রেখেছে। অযোধ্যা পাহাড়ের মাথায় সুতানটান্ডির কাছে যে সীতাকুণ্ড, সাঁওতালরা বিশ্বাস করেন রামের তিরের আঘাতে এই অনিঃশেষ জলধারার সৃষ্টি। পাহাড়ের জঙ্গলে সুতোর ন্যায় গাছের বাকলে লেগে থাকা উদ্ভিদাংশকে সীতার চুল বলে গণ্য করেন এই বনবাসী সম্প্রদায়ের মানুষরা। এ ধরনের আরও বহু কাহিনি প্রচলিত রয়েছে বনবাসী সমাজের মধ্যে। তাই এমন এক ভূখণ্ডে রামের নামে জয়ধ্বনি উঠবে একথা বলাই বাহুল্য। কৃত্তিবাস তার রামায়ণে এই জয়ধ্বনি শুনিয়েছেন বাঙ্গালিকে।
বশিষ্ঠ নারদমুনি করে বেদধ্বনি।
অখিল ভুবনে শব্দ ‘রামজয়’ শুনি।।
এই ধ্বনি বাঙ্গালি শুনেছে, বুকে ধারণ করেছে সহস্র বছর ধরে। হাজার বছর আগেই বঙ্গদেশে রামের উপরস্থিতির প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। বাঙ্গালির সবচেয়ে বড়ো উৎসব দুর্গাপূজাই তো ধরে রেখেছে রামচন্দ্রের অকাল বোধনের ঐতিহ্য। রামকে বাঙ্গালির স্বীকৃতির এর চেয়ে বড়ো উদাহরণ আর কী হতে পারে! রাম ও রামায়ণ বাঙ্গালির রক্তে হিমোগ্লোবিনের মতো মিশে রয়েছে, বিচ্ছিন্ন করতে গেলে তার প্রাণপাখিটিই উড়ে যাবে।
ড. সুমহান বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.