ভক্তিরস
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বরাবরই ভক্তিবাদী। তিনি ঈশ্বরকে দেবালয়ে । মন্দিরে মসজিদে খুঁজে পাবার চেষ্টা করেননি, করেছেন অন্তর নিভৃতে। যেহেতু কৃত্তিবাসী রামায়ণ ভক্তিরস প্রধান সেহেতু কৃত্তিবাসের রামের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে তিনি বলেছেন : ‘কৃত্তিবাসের রাম ভক্তবৎসল রাম। তিনি অধম পাপী সকলকেই উদ্ধার করেন। তিনি গুহক চণ্ডালকে মিত্র বলে আলিঙ্গন করেন। বনের পশু বানরদিগকে তিনি প্রেমের দ্বারা ধন্য করেন। ভক্ত হনুমানকে ভক্তিতে আর্দ্র করিয়া তাহার জন্ম সার্থক করিয়াছেন। বিভীষণ তাহার পরম ভক্ত। রাবণও শত্রুভাবে তাহার কাছ হইতে বিনাশ পাইয়া উদ্ধার হইয়া গেল। এই রামায়ণে ভক্তির মাধ্যমেই ঈশ্বর সান্নিধ্য লাভ করতে পারে সাধারণ মানুষ। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে উপরোক্ত প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, কৃত্তিবাসের রামায়ণেও এই ভাবটি ধরা দিয়েছে। ভগবান যে শাস্ত্রজ্ঞানহীন অনাচারী বানরদেরও বন্ধু, কাঠবিড়ালির অতি সামান্যে সেবাও যে তাঁহার কাছে অগ্রাহ্য হয় না, পাপিষ্ঠ রাক্ষসকেও যে তিনি যথোচিত শাস্তির দ্বারা পরাভূত করিয়া উদ্ধার করেন, এই ভাবটিই কৃত্তিবাসে প্রবল হইয়া ভারতবর্ষে রামায়ণ কথার ধারাকে গঙ্গার শাখা ভাগীরথীর ন্যায় আর একটা বিশেষ পথে লইয়া গেছে।
কবির দুঃখ
কৃত্তিবাসের রামায়ণ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এবং হরগৌরীর মাহাত্ম্যসূচক কাব্যকবিতার চেয়ে অনেক বেশি মহৎ হলেও, রাধাকৃষ্ণ বা হর-গৌরী কথার মতো বাঙ্গালির ধর্মচেতনা ও বিশ্বাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি। উত্তর ভারতের রামভক্তিবাদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হিন্দু সমাজ তাকে প্রভাবিত করেছিল। বাঙ্গালি হৃদয়ে যে সে তুলনায় রামায়ণ সাড়া জাগাতে পারেনি তার জন্য রবীন্দ্রনাথের দুঃখ :‘বাংলাদেশের মাটিতে সেই রামায়ণ কথা হরগৌরী ও রাধাকৃষ্ণ কথার উপরে যে মাথা তুলিয়া উঠিতে পারে না তাহা আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য। রামকে যাহারা যুদ্ধক্ষেত্র ও কর্মক্ষেত্রে নরদেবতার আদর্শ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছে তাহাদের পৌরুষ, কর্তব্যনিষ্ঠা ও ধর্মপরায়ণতার আদর্শ আমাদের অপেক্ষা উচ্চতর। (লোকসাহিত্য, পৃ. ১২০)
নারায়ণের অবতার
হিন্দুরা বিশ্বাস করে রাম নারায়ণের অবতার। এই নারায়ণের প্রতিও ছিল রবীন্দ্রনাথের অপরিসীম শ্রদ্ধা। হিন্দুদের দেবতা নারায়ণের প্রতি রবীন্দ্রনাথের যে বিশেষ দুর্বলতা ছিল তা নিম্নলিখিত উদ্ধৃতিগুলো থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ও ধর্মতত্ত্বে বলে থাকে সব নরের মধ্যে। নারায়ণের আবির্ভাব আছে। (ছন্দ, ছন্দের অর্থ ১৩২৪, চৈত্র)
বন্যদ্রব্যকে এরকম পণ্যদ্রব্য করলে বনদেবতারা চুপ করে থাকেন, কিন্তু মানুষের বুদ্ধিকে কাজের খাতিরে মৌমাছির বুদ্ধি করে তুললে, নারায়ণের দরবারে হিসাব-নিকাশের দিনে জরিমানায় দেউলে হবার ভয় আছে। (কালান্তর, চরকা ১৩৩২, ভাদ্র)
যে পক্ষ অক্ষৌহিণী সেনাকেই গণনাগৌরবে বড়ো সত্য বলিয়া মনে করে তাহারা নারায়ণকেই অবজ্ঞাপূর্বক নিজের পক্ষে না লইয়া নিশ্চিন্ত থাকে। কিন্তু জয়লাভকেই যদি বাস্তবতার শেষ প্রমাণ বলিয়া জানি, তবে নারায়ণ যতই একলা হোন এবং যতই রুদ্রমূর্তি ধরিয়া আসুন, তিনিই জিতাইয়া দিবেন। (“রাজা’, ‘প্রজা’ সমস্যা, ১৩১৫, আষাঢ়)।
আশার কথা এই যে, নারায়ণকেই যদি সারথি করি তবে অক্ষৌহিণী সেনাকে ভয় করতে হবে না, লড়াই এক দিনে শেষ হবে না, কিন্তু শেষ হবেই, জিৎ হবে তার সন্দেহ নেই। (শান্তিনিকেতন, দশের ইচ্ছা, ১৩১৫ চৈত্র ৩১)
দৃষ্টাদ্ভূতং রূপমুগ্রহ তবেদং
লোকত্রয়ং প্রব্যথিত মহাত্মন্
মানুষ যখন প্রাণমন দিয়ে স্তব করতে পেরেছে :
অনন্তবীর্যামিতবিক্ৰমস্তং
সর্বং সমাপ্নোষি ততোঽসি সর্বঃ।
তুমিই অনন্তবীর্য, তুমিই অমিত বিক্রম, তুমিই সমস্তকে গ্রহণ কর, তুমিই সমস্ত। (জাভাযাত্রীর পত্র, তৃতীয় পত্র ১৩৩৪, শ্রাবণ ৩)
মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে
ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে।।
শতেক শতাব্দী ধরে নামে শিরে অসম্মান ভার,
মানুষের নারায়ণে তবুও কর না নমস্কার। (গীতাঞ্জলি ১০৮)
১৯২১, মার্চ মাসে রবীন্দ্রনাথ শিকাগো থেকে দীনবন্ধু এন্ড্রুজকে একখানি পত্র লিখেছিলেন। তাতেও প্রকাশ পেয়েছে ‘নারায়ণে’র প্রতি তার প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস :
“Our fight is a spiritual fight, it is for man. We are to emancipate man from the meshes that he himself has woven round him, these organisations of national egoism…
We, the famined ragged ragamuffins of the East, are to win freedom for all humanity. We have no word for ‘Nation’ in our language. When we borrow this word from other people it never fits us. For we are to make our league with Narayan, and our triumph will not give us anything but victory itself : victory for god’s world. Letters to a Friend, 1928, p. 128.
অর্থাৎ আমাদের লক্ষ্য মানুষের আত্মিক মুক্তি।
আমাদের অর্থাৎ প্রাচ্যদেশের দীনদরিদ্র লক্ষ্মীছাড়াদের ওপরই আজ দায়িত্ব বর্তেছে। ‘নেশন’ শব্দটা আমাদের ভাষায় নেই। এ-শব্দের কোনো ভারতীয় প্রতিশব্দই নেই। এ শব্দটি আমরা ধার করেছি অন্যদের কাছ থেকে। মূলত আমাদের আত্মসমর্পণ করতে হবে নারায়ণের কাছে। সিদ্ধিলাভ আমরা করবই এবং অসামান্য হবে এই সিদ্ধিলাভ। জয় আমাদের হবেই এবং এই জয় বিধাতারই জয়।
পরমেশ চৌধুরী
(লেখকের দম্ভী হিন্দু রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থ থেকে পুনর্মুদ্রিত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.