আশৈশব রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে, রবীন্দ্র সাহিত্যে জারিত হয়ে বড় হয়েছেন এমন বাঙালির সংখ্যা অনেক। আমাদের বাড়িতেও ‘শাপমোচন’-এর একটি ক্যাসেট ছিল, সেটি প্রায়ই বাড়িতে চালানো হত; হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠের সঙ্গে সেই প্রথম আমার পরিচয়। আমার প্রথম রবীন্দ্র সমুদ্রে অবগাহনের গান, ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’; পিলু রাগাশ্রিত একটি সঙ্গীত, যা কতিপয় হুজুগে বাঙালি গত কয়েকদিন ধরে অবোধ্য এক ঘরানায়, মোক্সা-ঘরানাতে শুনছেন। অথচ গানটি অমল-সুন্দরের বাণীতে রচিত একটি চিরকালীন প্রেমের গান; যে প্রেম শাশ্বত, অমর, অমল, যা স্বর্গ-মর্ত্যের গণ্ডিকেও নির্ভয়ে অবজ্ঞা করে। প্রথম ১০ বা ১২ বছর বয়সে আমি মঞ্চেও গেয়েছি এই গান। এমন একটি চিরন্তন গানকে যে যুক্তিতেই চুইংগামের মত কিছু অশ্রাব্য শব্দের সঙ্গে পরিবেশন করা হয়, তা রাবীন্দ্রিক ‘আমার’ কাছে অশুভ, অভূতপূর্ব ও অসঙ্গত এক অশনিসঙ্কেত। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, অধিকাংশ মানুষ এই ভাঁড়ামো শুনেও নীরব রইলেন। অতি উৎসাহী মানুষ সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ‘লাইক’-এর বন্যায় ভাসাতে সচেষ্ট হলেন এক বেসুরো অসুরকে। অনেকে অশোভনতার পক্ষে মতামত দিলেন বিস্তর; তাঁদের গায়েও লাগল না, রুচিতেও বাঁধল না!! সাবাস বাঙালি।
মজা বা ব্যঙ্গ করতে বাঙালি কোনদিনই পিছপা ছিল না, তার অনেকানেক অতীত উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু কয়েকটি কদর্য শব্দ ব্যবহার করে রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধি বলে, তাঁরই সৃষ্টিকে কদর্যভাবে বাঙালির কাছে পরিবেশন করে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন করবেন, তা এই মাটিতেও অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল। আমাদের বাবা-মা’র নামে কেউ খারাপ কথা বললে তা আমরা হেসে সহ্য করে নিই কি? নিই না। তবে এক্ষেত্রে কেন নিলাম? আজ সেই বেসুর-অসুরের কথাই বলবো। বিপুল রবীন্দ্র-প্রতিভাকে কীটের মত দংশন করে হাটে-বেচা সুরের চার-আনা আতর লাগিয়ে ‘রোদ্দুর’ হতে চাওয়া সেই রোদ্দুর রায়, দেউলিয়াপনা বাঙালির অসহ্য-রূপ! অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিলো, জানতাম। কিন্তু অমলের বিপ্রতীপ কি হয়! সেও কী রোদ্দুর হতে চায়?
আমার সোজাসাপ্টা বক্তব্য, শ্রী রায় তার নিজস্ব সৃষ্টি নিয়ে যা খুশি তাই করুন, অন্যের সৃষ্টিতে হাত কেন দেবেন? কিছু সাহিত্যপ্রেমীর মতামত অনুযায়ী, রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত ওভাররেটেড সাহিত্যিক, কোনো কিছুই তাঁকে কোনোদিন স্পর্শ করবে না, তাই এতে আমাদের বলার কিছু নেই। কিন্তু তাও যদি মেনে নেই (আমার ব্যক্তিগত মত অন্য), তবুও তাঁর সৃষ্টিকে নিয়ে এহেন কদর্য মানসিকতার প্রকাশ একেবারেই বেমানান। অযোগ্যের জনপ্রিয়তা অর্জনের এক সস্তা ও নোংরা পথ। শ্রী রায়ের নিজস্ব লেখা নিয়ে আমার কোনো বক্তব্যের ইচ্ছে নেই, তাই সেই প্রসঙ্গ তুলবো না।
আমার অনেক সংস্কৃতিমনস্ক বন্ধুদেরও দেখলাম এই বিষয়ে মজা পেতে ও লুটে নিতে! মজার কারণ হয়তো তাদের মেরুদণ্ডহীনতা। কিন্তু বাকিরা কেন আমরা প্রতিবাদ করছি না? এই কদর্যতায় মজা পাচ্ছি ও নিচ্ছি! শান্তি পাচ্ছি! যাঁদের বঙ্গসংস্কৃতির পুরোধা বলে জানি তাঁদের কতজন এর প্রতিবাদ করলেন, তার পরিসংখ্যান পাইনি এখনও। আর যে শিল্পীরা শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে, রবীন্দ্রচর্চা করে সারাজীবন কাটালেন, তাঁদের কয়জন বিরোধিতা করলেন সে খবরও নেই।
আপনারা হয়তো বলবেন, আমি রবীন্দ্র-ভক্ত, তাই আমার শিরা-উপশিরা প্রতিবাদে ফুলে উঠছে! বলবেন, কেন বাবা তোর-ই একমাত্র, এত রবীন্দ্র-কপচানি? আমিও ভেবেছিলাম মুখ ফিরিয়ে থাকব! কিন্তু এ জ্বর যে অনেক নিচে, রসাতলে প্রোথিত; এটা একটা সংস্কৃতির হত্যাযজ্ঞের আয়োজন, যখন বুঝলাম তখন আর মুখ ফিরিয়ে থাকা সম্ভব হল না। আমার যা মনে হয়েছে তা বলার চেষ্টা করছি।
কিছু জায়গায় পড়লাম, এই ধরণের পরিবেশনের মাধ্যমে গায়ক এক বিপ্লব ঘটাতে চাইছেন। কী সেই বিপ্লব? না, ছোট থেকে যা কিছু আমরা খারাপ, কুরুচিকর বলে জেনে এসেছি, তা নাকি আমাদের মনে চাপানো এক ধারণা। আবাল্য চাপানো এই মনকে, তার অবদমিত খারাপগুলোকে একত্রে খুলেমেলে দেওয়া হোক, ভালো-মন্দের ভাঙ্গাচোরা হোক এবং অন্যের সুন্দর সৃষ্টিকে অসুন্দর করা হোক। প্রশ্ন হল, বিধি কে ভাঙতে পারেন? যিনি বিধিগুলি সত্যিকারের জানেন, সেইগুলির মধ্যে চিরকাল জারিত, দীর্ঘদিন অনুশীলিত, তিনি। সেটা রবীন্দ্রনাথ, আমজাদ আলি খানকে মানায়। যাকে তাকে মানায়? পথের বেসুরো ভিখিরিকে মানায়! জ্ঞান-অজ্ঞান, ভালো-মন্দকে অস্বীকার করা ও তার ঊর্ধ্বে ওঠা শ্রীরামকৃষ্ণকে মানায়; কারণ তাঁরা স্বামী বিবেকানন্দ তৈরী করে যান। এই সস্তার পাবলিসিটিতে এই যুক্তিগুলিকে আশ্রয় করে আরও ধুনো দিচ্ছে বাঙালি আঁতেলগোষ্ঠীর অধুনাতন সংস্করণ। হে প্রিয় হাস্যরসপ্রিয় বাঙালি, জাস্ট জেনো কালের কথা, ওসব টিকবে না, মিলিয়ে নিও। নান্দনিকতা, সৌন্দর্য, সুসংস্কৃতি–এই জিনিসগুলি পৃথিবীকে, তার মানুষকে ভালো রাখে। আর কদর্যতা, নোংরামো আরও নিচের পচা-দুর্গন্ধের জলে স্নান করিয়ে দেয়। সহজ ও অমল পথে চলা যেহেতু সহজ, তাই আসুন একটু সুন্দর ও নন্দনকে প্রাধান্য দিই! ভালো আর মন্দকে বিচার করার যোগ্যতাটুকু অভ্যাস করি। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কি তুলে ধরছি আমরা? অনেক বাড়িতেই শিশু বা কিশোর মোবাইল ঘাঁটে, বাবা মায়েরা পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেন না, তারা যখন দেখবে তাদের বাবা-মা এই অশোভনে আনন্দ পাচ্ছেন, সে অসুন্দর অসুরকে যথার্থ ভাববে। এইভাবেই একটা ধীর ও ধারাবাহিক বিষ জাতির মননকে পঙ্গু করে দেবে। এটাই আমার দুশ্চিন্তা, সেটাই আমাকে ভাবাচ্ছে। সমাজে শাসন, নিয়ম, সুসংস্কৃতির প্রয়োজন অনেক বেশী, মানুষ যদি নিজের প্রবৃত্তি অনুযায়ী জীবনযাপন শুরু করে, তবে সেই আদিম যুগ তো ফিরেই পেলাম! এত এগোনোর মানেটা কী!
প্রস্তুত আলোচনা প্রসঙ্গে এক গুণী মানুষের বক্তব্যের সামান্য অংশ তুলে ধরা হল:
“আমার এক প্রিয়বন্ধুর অনুরোধে আজ রাতে রোদ্দুর রায় নামে জনৈক ইউটিউবারের গান শুনলাম। তিনি রবীন্দ্রনাথের “আমার পরাণ যাহা চায়/তুমি তাই তুমি তাই গো…” গানটি গাইছিলেন। প্রথম যে প্রতিক্রিয়া হল, “আঁতেল আঁতেল ভাব/কিন্তু আঁতলামির অভাব।” মনে হল, ওর ওইটুকুই ক্ষমতা! গান শুনতে শুনতে তার মুখ গহ্বর, জিভ, আলজিভ, (এমনকি মনে হল) খাদ্যনালীটাও তুলে দেখাচ্ছেন। দেখাচ্ছেন যখন, দেখে নিতে হল, গায়কিপনা বোঝার জন্য! কেউ যা ইচ্ছে পোশাক পরতেই পারেন, তাতে আমার কিছু যায় আসে না, কিন্তু তাঁর গান গাওয়ার অঙ্গভাষাটি অতিরঞ্জিত মনে হয়েছে।
এত সুন্দর একটি থীম প্রকাশিত হয়েছে যে গানের টেক্সটে, তা কতটা তিনি বুঝতে সক্ষম হয়েছেন, তাতে সন্দেহ থেকে যায়। এটি পূজা পর্যায়ের একটি গান। যার মূল বক্তব্য “যারে বলি ভালোবাসা/তারে বলি পূজা।” ভালোবাসা যে পাওয়ার নয়, দেওয়ার; এমন অনবদ্য থীম গানটির পরতে পরতে জড়িয়ে আছে।
কেউ হয়তো বলবেন, তিনি নিজের মত করে গাইছেন, আকুতি থেকেই গেয়েছেন। যদি হয়, Well and Good.
ছোটোবেলায় হোস্টেলে দেখেছি শীতকালে স্নানরত বালকেরা উচ্চৈঃস্বরে গান গাইতো শীত তাড়াতে। নানান গানের মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীতও চিৎকার করে গেয়ে ঠান্ডা জলের প্রথম ঘটি মাথায় দিত। তখন গানের কথাটি অপরিবর্তিত থাকলেও সুরটি অনবধানেই হয়ে উঠতো পোস্ট-মর্ডানিজম! শ্রী/জনাব রোদ্দুর রায়ের গানটি শুনেও আমার প্রথমে শূন্য ডিগ্রিতে নেমে আসা শীতলতার সঙ্গীত-মূর্তি বলে মনে হচ্ছিল।
এখন বিষয় হল, কবি বা গায়ক যা লিখবেন, যেভাবে গাইবেন, পাঠকের/শ্রোতার নিজের মত করে নেবার অধিকার আছে কিনা। আমার মনে হয়েছে, কবির একটি গভীর দর্শনকে ব্যঙ্গ করতে চেয়েছেন রোদ্দুর রায়। কোনো একটি দর্শন আমার ভালো লাগতে নাও পারে, তাই বলে প্রকাশ্যে কোনো কুৎসিত ব্যঙ্গ প্রকাশ করে তার প্রদর্শন অশোভন। যদি তিনি নিজের আকুতি থেকে গানটির গায়কি পুনর্নির্মাণ করে থাকেন, তবে ঠিক আছে; যদি না করে থাকেন তবে সেটা ঠিক করেননি। উনার অনুগামীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি, যদি সত্যিই তিনি অন্তরের তাগিদে গেয়ে থাকেন, তবে বলবো, এটা রোদ্দুর রায়ের দিব্যোন্মাদ অবস্থা; ফুলচন্দন নিয়ে উপস্থিত থাকার ক্ষেত্রে কোনো ব্যতয় যেন না ঘটে।
গায়কীর যে ধারা তিনি তৈরি করলেন তাতে গানের/কবিতার শীতলতা ভাঙলেও, সৌন্দর্যের সৌকর্যের মোমবাতি নিবিয়ে দিলেন। এখনও বিশ্বাস করি, তিনি তা করেননি। করলে খুবই অন্যায় করেছেন।
কতটা আত্মনিবেদনের কথা গানে আছে, সেটা বোঝার ক্ষমতা উনার আছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। একটা মানুষ (রবীন্দ্রনাথ) কতটা একমুখী হলে, তবে বলতে পারেন, ” তোমা ছাড়া…….কেহ নাই/কিছু নাই”, সেই যে ভরসার জায়গা, You are the last person; এটি এক গবেষণার চরম উপলব্ধি। সেই জায়গা থেকে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “তুমি যাহা চাও/তাই যেন পাও/আমি যত দুখ পাই গো।” এই প্রেমের গভীরতা, এই গভীরতা বোঝার ক্ষমতা কী রোদ্দুরের আছে? গান শুনে মনে হচ্ছে তিনি ‘ব্যাজস্তুতি’ করছেন।
এককথায় উনার পরিবেশনা একটি চুইংগামের মত! যাঁরা লাইক দিয়েছেন, তাঁদের অনেকে হয়তো চুইংগামটি চিবিয়ে গানের শেষে ফেলে দিয়েছেন। যাবার আগে চুইংগামের গ্রথন, গড়ন, গাম্ভীর্য দেখে ‘লাইক’ দিয়ে ব্যাজস্তুতির মূর্তবিগ্রহকে প্রণামী দিতে ভোলেননি।”
শ্রী আনন্দরূপ কাশ্যপ