রাজস্থান থেকে যখন কোন মাড়োয়ারি কোলকাতায় আসেন, জামকাপড় বাদ দিয়ে তাঁর কাছে মাত্র দুটি সম্বল থাকে। এক) তাঁর স্ত্রী, যে নিজে মাড়োয়ারী এবং তাঁর নিজের জাতের। দুই) তার পৈতৃক বা শ্বশুরের কাছ থেকে পাওয়া কিছু পুঁজি। ট্রেন থেকে নেমে মারওয়ারীরা প্রথমেই যাবে বড়বাজার; যেখানে তার গ্রামের বা তার শ্বশুরের গ্রামের কোন আত্মীয়ের দোকান রয়েছে। এই আত্মীয়ই তাকে কলকাতায় থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন এবং দেয় ঋণ (সুদে ঋণ)। অবশ্য এই ঋণ তাকে সেই আত্মীয় দেয় না; দেয় স্থানীয় মারওয়ারী সমাজ। এই ঋণ ছাড়া তার পক্ষে ব্যবসায় নাম সম্ভব নয় কারণ বড়বাজারের সামান্য ছোট দোকানের মূল্যও কোটিতে হয়; লাখের কোন গল্প নেই। রক্ষণশীল মাড়োয়ারিরা ধুতি পরেন, অনেকেরই কপালে বৈষ্ণব তিলক কাটা; গা থেকে দুর্গন্ধ বেরোয়, কারণ পারফিউম বিলাসিতা। এরা পড়াশুনাও খুব একটা জানেন না কিন্তু মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে নিজের চেষ্টায় বাংলা শিখে নেবে। কারণ যে এলাকার মানুষকে মাল বিক্রি করতে হবে সে এলাকার মানুষের কাছে মাল বিক্রি করতে হলে তার ভাষা শিখতে হয়। পড়াশুনা জানে না; অঙ্কে মাস্টার ডিগ্রী নেই, কিন্তু ৩৪৭ টাকা মূল্যের ১৪৯টি কাপড়ের মোট মূল্য কত তা চোখের নিমেষে ক্যালকুলেটর ছাড়া আপনাকে বলে দেবে। ৪-৫ বছরেই কলকাতায় বাড়ি বানায়, ঋণমুক্ত হয়, সমৃদ্ধি আসে, দারিদ্র্য কাটিয়ে বেরিয়ে যায় কিন্তু মনন অপরিবর্তনীয়। ব্রান্ডেড জামা কেনে না, দামী পারফিউম কেনে না; সামান্য দোকান থেকে মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করবে কিন্তু ব্যয় করেন মূলত ৩ টে জিনিসে।
১) হিন্দুধর্মের যত পূজা আচার অনুষ্ঠান আছে; গণেশ পূজা কার্তিক পূজা ইত্যাদি নানা পূজায় হাজার হাজার টাকা প্রত্যেক মাসে ব্যয় করেন।
২) সোনা। যে কোন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজে সোনার গুরুত্ব অপরিসীম।
৩) বিয়ে ও শ্রাদ্ধে; বহু বছরের সঞ্চয় শুধু বিয়ে এবং শ্রাদ্ধতে খরচ করেন কিন্তু এই খরচটা করা হয় রাজস্থানে। কোলকাতায় নয় কারণ তার জাতের সমস্ত মানুষ রাজস্থানেই রয়েছেন। এসব মানুষরা এই সময় আয় করে।
মনে রাখতে হবে, স্বজাতি বোধ কিন্তু মাগনায় আসে না, এর জন্য টাকা পয়সা খরচ করতে হয়।
বড়বাজারের বেশিরভাগ মাড়োয়ারি জানে না পার্টি পলিটিক্স কি? দৈনন্দিন খবরের কাগজটাও হয়তো পড়েন না, কোন দলকে সমর্থনও করেন না। এঁদের মধ্যে বড় দাদা গোছের কিছু মাড়োয়ারি থাকেন, যাঁরা এঁদের নেতৃত্ব দেন। এসব নেতারাই মারওয়ারী সমাজের হয়ে রাজনৈতিক দর কষাকষি করে (প্রাচীন যুগে এদের “শ্রেষ্ঠী” বলা হত, বইয়ে পাবেন) থাকেন। জি ডি বিরলা ছিলেন মারওয়ারী সমাজের জন্য এই ধরনেরই এক নেতা। এদের ঘরে বাচ্চা জন্ম নিলে বেদে উল্লেখিত ১৬ রকমের আচার পালন করে থাকেন। আত্মীয়, বন্ধুরা সন্তানের মুখ দেখতে এলে সোনা ছোঁয়ানো বাধ্যতামূলক কারণ এটাই তাঁদের রীতি। ঘরে খাওয়া হয় বাসমতি চালের ভাত, কারণ সেদ্ধ চালকে “গরীবের খাবার” বলে মনে করা হয়। যে কোন খাবারে ঘি দেওয়া এদের রীতি কারণ রান্নায় ঘি নেই তার অর্থ তুমি গরীব। একশ রকমের প্রবাদ যা পার্থক্য করে উচ্চবিত্তের সঙ্গে নিম্নবিত্তের, তাদের সন্তান সেই শিক্ষা পায়। গোটা সমাজটাই অসম্ভব যুক্তির বুননে বাঁধা, যার সুতো হল অর্থ। কোন সন্দেহ নেই যে ভারতবর্ষের ইহুদী হলেন এই মারওয়ারীরা। এঁদের ব্যবসায়িক নৈপুণ্য নিয়ে যত লেখা হয়, ততই কম।
এঁদের সঙ্গে বাঙালী সমাজের তুলনা করাটাও হাস্যকর। কত ধানে কত চাল হয়, সেটা বাঙালি ঘরের দুলালদের বোঝার ক্ষমতা নেই। বাপের আয় হয়তো মাসিক ২০০০০ টাকা। এদিকে সেই বাপের ছেলে ৩০০০ টাকার জিন্স, ২০০০ টাকার শার্ট আর ৫০০০ টাকার জুতো পরে ঘুরে বেড়ায়। আর যেখানে সেখানে যখন তখন এরিস্টটল থেকে মার্ক্স, শেক্সপিয়ার থেকে বার্নাড শ কপচে যায়। মানে, পাগলা তুই খাবি কি ঝাঁঝে মরে যাবি।
বাঙালী পুরুষরা এক সময় ব্রিটিশদের তাড়ানোর জন্য শরীরচর্চা করতেন। আর আজ? এখন বাঙালি ছেলেদের লক্ষ্য হল চট জলদি সিক্স প্যাক বানিয়ে মেয়ে পটানো। কিন্তু না জোটে মেয়ে আর না হয় সিক্স প্যাক; কারণ অনুশাসন ও অর্থ দুইয়ের অভাব। বাঙালী মেয়েরা আগেকার দিনে অত্যাচারী ইংরেজদের গায়ে বোম ছুঁড়ে মারত। আর এখন সেই বাঙালি মেয়েরা “আমরা পুরুষতন্ত্রের দ্বারা নিপীড়িত” বলে কেঁদে বেড়ায়। আগুনখেকো প্রগতিশীল নারীবাদের বাড়-বাড়ন্ত এই রাজ্যে; অথচ সবচেয়ে বেশি নারীপাচার বাংলা থেকে হয়(ইউ এন রিপোর্ট)।
নিজের আলস্যকে জাস্টিফাই করার বেশ কয়েকটা অজুহাত আছে বাঙালিদের:-
১) দরিদ্রের উন্নতি:- বিগত একশ বছর ধরে এত উন্নতি হয়েছে বাঙালিদের, যে নিজেরাই গরীব হয়ে জমি হারিয়ে বেকার হয়ে ফেউ ফেউ করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আবার, সরকার যদি গরিবদের জন্য মাথাপিছু দু কিলো করে চাল বরাদ্দ করেন; তার মধ্যে থেকে এক কিলো হাপিস করে দেব আমরাই। দরিদ্রের পাওনা মেরে, দরিদ্রের ভগবান সাজার চেষ্টা; এ কেবল বাঙালির পক্ষেই সম্ভব।
২) প্রগতিশীলতা:- বাঙালিরা নিজেদের বেকার ভাইটিকে দেখে না অথচ হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই! নারীর উন্নতির জন্য আমরা সর্বক্ষণ ভেবে চলেছি; কিন্তু তবুও বাঙালি পুরুষ ও বাঙালি নারীদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ বেড়েই চলেছে। তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এসকর্ট সার্ভিস এবং নারী পাচার। আমরা চাই দলিতের উন্নতি কিন্তু টেকনিক্যাল এডুকেশন-এর কোন ব্যবস্থা রাখব না।
৩) সাংস্কৃতিক লম্ফঝম্প:- এছাড়া আছে সংস্কৃতির হ্যাজ। অথচ আজকের বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মাটির কোন যোগ নেই। আপনি গান বা উপন্যাস বা সিনেমা দেখুন। বেশিরভাগই সুখী মধ্যবিত্তের বিরহ কাহিনী, অনন্ত ভাব। ভাবের মধ্যে ভাব, তার মধ্যে ভাব(মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়)।
বাঙালীর কিন্তু নিজস্ব ট্রাডিশনাল বৈশ্য সমাজ রয়েছে। গন্ধ-বণিক, কংসবণিক, সুবর্ণবণিক, তিলি (সাহা) ইত্যাদি। এরাও বাঙালি ব্যবসায়ী কিন্তু বাঙালিদেরকে কখনোই এদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে দেখবেন না। মাড়োয়ারির পয়সায় সরকার তৈরী করে মার্কসবাদের নামে এতদিন এদেরকে দমন করা হয়েছে। এবং এখনো হচ্ছে। আজ বাঙালি চন্দ্রশেখর ঘোষকে চেনে কারণ আনন্দবাজার তাঁকে “সেরা বাঙালীর” পুরস্কার দিয়েছে। কিন্তু সমিত ঘোষকে বাঙালি চেনে না, কারণ আনন্দবাজার এঁকে এখনো খুজে পায়নি। অসম্ভব ভণ্ডামি আর “পলিটিক্যাল কারেক্টনেসে” ভোগা একটা জাতি হল বাঙালি। যে ডাক্তাররা এই করোনা মহামারির সঙ্গে লড়াই করছে তাকে ঘর থেকে বের করে দিলে তা নিয়ে আওয়াজ তোলার ক্ষমতা নেই বাঙালিদের। এদিকে শ্রমিক কেন খেতে পাচ্ছে না তা নিয়ে গলাবাজি করে আকুল। যখন যেটা দরকারি, তখন সেই বিষয় নিয়েই কথা বলা উচিত। কিন্তু বাঙালিরা সম্পূর্ণ অন্য ধাতুতে গড়া। বাংলাতে যে সমস্যাই আসুক, “শ্রমিক-গরীব-ভাত দে-নারীবাদ” ইত্যাদির মত কয়েকটা বাঁধাধরা বিষয় ছাড়া অন্য জায়গায় নীরব। যে জীবনবোধের কোন ফল নেই সেই জীবনবোধ দিয়ে না ব্যক্তির উন্নতি হয় না জাতির উন্নতি হয়। অন্যকে দোষ দেবার আগে নিজের দিকে তাকাতে হয়।
“ভুজিয়া” বলে আপনি মারওয়ারীদের গালি দিতেই পারেন। তাতে না ভুজিয়ার যোগ্যতা কমবে, না বাঙালির যোগ্যতা বাড়বে। আর “যোগ্যতা” বস্তুটাই এমন, যে সেটা শুধু যোগ্যতা দিয়েই কাটা যায়। অন্য কিছু দিয়ে নয় সে যতই আপনার মধ্যে “আবেগ” থাকুক “মূল্যবোধ” থাকুক। ওসব দিয়ে ফাঁকা আওয়াজ ছাড়া কিছুই বের হয় না। ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ে বাংলা ভাষা বাধ্যতামূলক করার গল্প বাঙালী আগেও দেখেছে ওসবে এখন কেউ প্রভাবিত হয় না। নতুন কিছু ভাবুন, যা দিয়ে লোকদের বোকা বানাতে পারবেন। মাড়োয়ারিরা বাংলা ছেড়ে যাবে, ধরে নিলাম। কিন্তু বিকল্পটা তৈরী করতে পারবেন তো? নইলে কিছুদিন আগেই পয়সার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে আপনাদের সংগঠন তিনভাগ হল। বাঙালীর “পলিটিক্স”-এর মোক্ষ ওইখানেই। সামাজিক সমস্যার সমাধান রাজনৈতিকভাবে কখনোই সম্ভব নয়। না আগে তা হয়েছে, না আজকে হচ্ছে, না ভবিষ্যতে হবে।
চন্দন পোদ্দার