অঘ্রাণ মাস

আলু: অঘ্রাণের মাঝামাঝি পর্যন্ত আলু বসানো যায়; তবে জলদি আলুর চাষ করাই উচিত। কেউ কেউ ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি থেকে আলু লাগানো শুরু করেন। উন্নত মানের বীজআলু তৈরি করতে হলে আশ্বিনের মাঝামাঝি আলু লাগাতে হবে। সেই হিসাব ধরলে, অঘ্রাণের শুরুতে আদর্শ আলু ক্ষেতের বয়স প্রায় দেড় মাস। আলু ঠিক সময়ে বা জলদি লাগালে যেটা সুবিধা তা হল, নাবি ধ্বসার আক্রমণ থেকে আলু রেহাই পায়। কারণ নাবি ধ্বসা রোগের প্রাদুর্ভাবের পূর্বেই আলু পরিপক্বতার দিকে চলে আসে, রোগ ফসলের ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু তাই বলে খুব আগেও আলু লাগানো উচিত নয়; বর্ষায় ক্ষতি হয়।

কাজেই অঘ্রাণ মাসের শুরুতে অর্থাৎ আলু লাগানোর ৪০ দিনের মাথায় জমিতে পরিমিত মাত্রায় সার ও সেচ প্রয়োগ করতে হবে। সাধারণত লাগানোর ৪০ দিন পরে গাছে আলু ধরে, সেই সময় রাতের তাপমাত্রা থাকা উচিত ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি। এই সময় অর্থাৎ অঘ্রাণের শুরুতে ০.১ % হারে ইউরিয়া স্প্রে করলে ভালো, অঘ্রাণের মাঝামাঝি আর একবার স্প্রে দেওয়া যায়, তাতে আলুর ওজন ঠিক মতো বাড়ে।

অঘ্রাণ মাসের শুরুতে দ্বিতীয় বার মাটি ধরানোর জন্য গাছের গোড়ায় উঁচু ভেলি করে দিতে হবে, খেয়াল রাখতে হবে গাছের গোড়া যেন আলগা হয়ে না যায়, গাছের শেকড় যেন আঘাত না পায়। তারপর তৈরি নালাতে ১০ দিন অন্তর সেচ দিতে হবে। সেচের সময় নালিতে জলের গভীরতা অর্ধেক বা দুই তৃতীয়াংশের বেশি ডুবিয়ে সেচ দেওয়া চলবে না।

সেচ দিতে হবে সকালের দিকে। অঘ্রাণের প্রথমে বা মাঝামাঝি সময়ে অথবা জলদি ধ্বসা রোগ দেখা গেলে প্রতি লিটার জলে ২.৫ গ্রাম ম্যানকোজেব কিংবা ৩ গ্রাম কপার অক্সি ক্লোরাইড মিশিয়ে স্প্রে করা উচিত।

অঘ্রাণ মাস থেকেই আলুতে হালকা থেকে গাঢ় সবুজ বা ফিকে হলুদ রঙের জাবপোকা চোখে পড়ে। মাসের মাঝামাঝি এদের পূর্ণাঙ্গ পোকা কচি পাতায় ও ডাঁটায় বাড়তে থাকে। এরা এবং এদের অপূর্ণাঙ্গ পোকা পাতার ও ডাঁটার রস চুষে খায়। তাতে পাতা কুঁকড়ে যায়, ঢলে পড়ে; এরা ভাইরাস বা কূটে রোগের বাহক হিসাবেও কাজ করে। অঘ্রাণ মাস থেকেই আক্রমণ শুরু করে শ্যামাপোকা। এদেরও পূর্ণাঙ্গ ও অপূর্ণাঙ্গ দশা পাতার নিচে বসে রস চুষে খায়; তাতে পাতা হলুদ বা বাদামি হয়ে যায়। আক্রমণ বাড়লে ক্ষেতের মাঝে চাপ চাপ বাদামি হয়ে হপার বার্ণের লক্ষণ চোখে পড়ে। এই সময় আলুতে কখনও কখনও মাকড়ের আক্রমণ দেখা যায়, কখনও দেখা যায় সাদামাছি, এছাড়া কাটুই পোকা, বাঘা পোকা বা কাঁটালে পোকা, শুঁয়োপোকা ইত্যাদি। এদের জন্য যথাযথ দমন ব্যবস্থা নিতে হবে।

ভাইরাস ঘটিত রোগ প্রতিরোধ করতে বাহক পতঙ্গ দমন করতে হয়। অঘ্রাণ মাসের শুরু থেকে পক্ষ অন্তর মিথাইল ডিমেটন ২৫ ইসি ১.৫ মিলি বা ডাইমিথোয়েট ৩০ ইসি ২ মওলি বা ইমিডাক্লোপ্রিড ১৭.৮ এসএল ০.২ মিলি হারে অন্তর্বাহী কীটনাশক স্প্রে করতে হবে।

সরষে: অঘ্রাণ মাসে সরষেতে যথাসময়ে সেচ ও তার দুই-তিন দিন বাদে চাপান সার প্রয়োগ করতে হবে। যেহেতু কার্তিক মাসের প্রথমে শ্বেত সরষে এবং সারা কার্তিক জুড়ে রাই সরষে বীজ বোনা হয়, তাই দুই সপ্তাহ পর কার্তিকেরই শেষে প্রথম দফায় চাপান সার দেওয়ার সময় এসে যায়। সেক্ষেত্রে অঘ্রাণে দ্বিতীয় দফায় চাপান সার দিন (বীজ বোনার চার সপ্তাহ বাদে)। অঘ্রাণ মাসের শেষে যে সকল জমিতে ফুল ধরা শুরু হতে থাকবে তাতেও আর এক দফা চাপান সার দিন। সঠিক সময়ে বোনা সরষের জমিতে পৌষ মাসের প্রথমে দানা তৈরির সময় চতুর্থ তথা শেষ দফার চাপান সার প্রয়োগ করতে হবে।

টোরি সরষে যেহেতু আশ্বিনের শেষে কিংবা কার্তিকের প্রথমে লাগানোর রেওয়াজ এবং তা স্বল্পদিনের ফসল (৭০-৮০ দিন), তাই টোরিতে যথা নিয়মে যথা সময়ে (বীজ বোনার এক মাসের মধ্যে) কার্তিক মাসের শেষে এবং অঘ্রাণ মাসের শুরুতে এক বা দু দফায় চাপান সার দেওয়া চলবে। চাপান হিসাবে শ্বেত ও রাই সরষেতে প্রতি দফায় বিঘা প্রতি সাড়ে পাঁচ কেজি ইউরিয়া এবং আড়াই কেজি পরিমাণ মিউরিয়েট অফ পটাশ দেওয়া হয়।

অণুখাদ্যের অভাব ঘটলে জমিতে বিঘা প্রতি দেড় কেজি পরিমাণ বোরাক্স বা সোহাগা বীজ ফেলার পূর্বেই শেষ চাষের সময় জৈব সারের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া উচিত।

অর্থাৎ অঘ্রাণ মাস জুড়ে সরষেতে ডালপালা আসা, ফুল ধরা, দানা তৈরি বা দানা পুষ্টির দশায় চাপান সার দেওয়া উচিত। সেচ দেওয়ার দুই তিন বাদে ভেজা জমিতে সার প্রয়োগ করা উচিত। আর যেটা করতে হবে তা হল আগাছা দমন। বীজ বোনার ১৫-২০ দিন বাদে এবং ৩৫-৪০ দিন বাদে নিড়ানি নিয়ে আগাছা দমন করতে হবে। আগাছা দমন, তারপর সেচ, তারপর চাপান সার — এই ক্রমে ফসল পরিচর্যা করা উচিত। সেচের জলের যোগানে স্বল্পতা থাকলে বীজ বোনার পর ২৫ দিনের মাথায় প্রথম, ফুল আসার সময় দ্বিতীয় এবং দানা পুষ্টির সময় তৃতীয় সেচ দিতে হবেই।

এই সময় সরষেতে জাবপোকার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। যেহেতু অঘ্রাণের প্রথমভাগে জাবপোকার সংখ্যা কম থাকে, তাই পরিবেশবান্ধব নিম-ঘটিত কীটনাশক (অ্যাজাডিরেক্টিন ১৫০০ পিপিএম ৩ মিলি প্রতি লিটার জলে গুলিয়ে) ব্যবহার করা চলে। তবে অঘ্রাণের শেষ ভাগে বা পৌষ মাসে জাবপোকার আক্রমণ বাড়লে রাসায়নিক কীটনাশক যেমন ইমিডাক্লোপ্রিড ১৭.৮ এসএল ব্যবহার করা যায় (প্রতি ১০ লিটার জলে ৩ মিলি)। এই সময় খেয়াল রাখতে হবে সরষের ধ্বসা রোগ দমনের ব্যাপারে। অল্টারনেরিয়া জনিত এই ধ্বসা রোগ দমন করতে মেটাল্যাক্সিল ৮ শতাংশ এবং ম্যানকোজেব ৬৪ শতাংশর মিশ্রণ লিটার প্রতি জলে ২.৫ গ্রাম গুলিয়ে স্প্রে করতে হবে।

গম: গম চাষের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার নির্দেশিত সর্তকতা গ্রহণ করতে হবে; যেখানে চাষ পুরোপুরি বন্ধ করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে তা সঠিকভাবে মেনে চলুন।
অঘ্রাণের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে জলদি গমের বীজ ফেলা উচিত। তবে প্রধান ফসলের ক্ষেত্রে অঘ্রাণের মাঝামাঝি পর্যন্ত বোনা চলবে।

কার্তিকের শেষ থেকেই গমের বীজ বোনা শুরু হয়ে যায়। অঘ্রাণের মাঝামাঝি বীজ বোনা এবং ৩ সপ্তাহের মাথায় একটি সেচ দিলে গাছ ঠিকমতো বাড়ে। আঘ্রাণের শেষে বীজ বোনার দেড় মাসের মাথায় দ্বিতীয় সেচ দরকার হয়। প্রথম সেচ দেবার আগে সব আগাছা দূর করতে হবে। অঘ্রাণের শেষে আর একবার আগাছা দূর করা উচিত।

সূর্যমুখী: পশ্চিমবঙ্গে অঘ্রাণ মাস বীজ বোনার ভালো সময়, এতে ফলন বেশি পাওয়া যায়। চারা-দশায় ঠান্ডা আবহাওয়া আর ফুলেল দশায় মেঘহীন উষ্ণ আবহাওয়া সূর্যমুখীর পক্ষে উপযোগী। অম্লমাটিতে সূর্যমুখী চাষ সমস্যার। প্রাথমিক সার হিসাবে শেষ চাষের সময় একর প্রতি ইউরিয়া ৩৫ কেজি, সিঙ্গেল সুপার ফসফেট ২৫০ কেজি, মিউরিয়েট অব পটাশ ৬৫ কেজি হারে দিতে হবে; সঙ্গে জৈবসার একরে ৪ টন লাগবে।

বীজের হার (হাইব্রিডে) একরে ২ কেজি প্রয়োজন হবে, দূরত্ব দিতে হবে ৬০ x ৩০ সেমি। বীজ খুপি করে লাগালে ভালো; প্রতি খুপিতে একাধিক বীজ ফেললেও শেষপর্যন্ত একটি সবল চারা রেখে বাকীগুলি তুলে ফেলতে হবে। লাগানোর আগে বীজ শোধন করে নেওয়া উচিত। প্রতি কেজি বীজে ৩ গ্রাম থাইরাম বা ক্যাপটন মাখিয়ে ১০ ঘন্টা রেখে দিলে তা শোধিত হয়।

ছোলা: অঘ্রাণ মাস ছোলা বোনার সঠিক সময়। উন্নত জাত হল — মহামায়া -১, ২, অনুরাধা, বিদিশা, বি-৭৫, বি-৯৮ ইত্যাদি। বীজের হার বিঘায় ৮ কেজি; দূরত্ব দিতে হবে ৩০x১০ সেমি। বিঘা প্রতি ৩ : ৬: ৬ কেজি হারে নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম সার দিতে হবে; প্রয়োজনমত সেচ দিতে হবে।

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.