রাজনীতি শব্দের অভিধানিক অর্থ হচ্ছে— রাজ্য শাসনবিষয়ক নীতিশাস্ত্র। সাম, দান, ভেদ, দণ্ড এই চতুর্বিধ উপায়। এখানে রাজ্য বলতে দেশকে বোঝানো হয়েছে। রাজনীতি অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ নীতি বা রাজার আদর্শনীতি। সেজন্য রাজাকে “নরশ্রেষ্ঠ বলা হয়। যে নীতি অনুসরণ করে রাজা রাজ্য তথা দেশের প্রজাদের মঙ্গলসাধন করেন, প্রজারা যাতে সুখ-শান্তিতে থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখেন তাকে রাজনীতি বলে। এই শাসনব্যবস্থাকে ‘রাজতন্ত্র বলা হয়।
ভারতে বহু সাধক আছেন যারা তন্ত্র সাধনা করেন। তাদেরকে ‘তান্ত্রিক বলা হয়। ভারত সহ এক সময় সারাবিশ্বে রাজারাই দেশ শাসন করতেন। এক শ্রেণীর ‘ক্ষমতাবান প্রজারা’ রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করে রাজতন্ত্রকে ধ্বংস করে ‘গণতন্ত্র’ নামক এক নতুন ‘তন্ত্র’-র সাধনা করছেন। এইসব সাধকদের—‘গণতান্ত্রিক সাধক’ বলা হয়। গণতন্ত্রে প্রজারাই রাজা নির্বাচন করেন। প্রতি পাঁচ বৎসর অন্তর রাজা নির্বাচন উৎসব পালিত হয়। তান্ত্রিকদের মধ্যে কাপালিক তান্ত্রিক বলে এক শ্রেণীর তন্ত্রসাধক আছেন। যাদের ‘নরবলি’ছাড়া সাধনায় সিদ্ধিলাভ হয় না।
গণতান্ত্রিক রাজা নির্বাচনেও রক্তপাত ছাড়া রাজা নির্বাচিত হন না। নির্বাচন এলেই হিংসার আগুন চারিদিক দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। ওই আগুনে অনেকের মৃত্যু ঘটে। ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। প্রজাদের নির্বাচনে অংশ নিতে বাধা দেওয়া হয়। অনেক প্রজার ভোট অন্য কেউ দিয়ে দেয়। এগুলো হচ্ছে‘গণতন্ত্রে’ তন্ত্রসাধনার অঙ্গ। এ নাহলে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করা যায় না, ইদানীং রাজা নির্বাচনে কিছু নতুন ভাষার আমদানি করা হয়েছে, যা শুনে বোবাও প্রতিবাদ করেন। রাজা হওয়ার প্রতিযোগিতায় ক্ষমতাবান। প্রজারা অংশ নেন। তাতেই পুরানো রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। নােংরা, অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দিতে শুরু করেন। যা নয় তাই, বলে যান। কখনও বলছেন তুই দেশের জন্য কী করেছিস? তুই একটা দাঙ্গাবাজ। তোর পরমায়ু ২০১৯-ই শেষ। তোর কোমরে দড়ি বেঁধে জেলে ঢোকানো উচিত। চ্যালারা আরও এককাঠি উপরে গিয়ে বলে থাকে ‘নকুলদানা খাওয়ার। কথা, পাঁচন দিয়ে তাড়াবেন, চড়াম, চড়াম শব্দ হবে। আর এক নেতাকে বলতে শুনেছি— দলীয় কর্মীদের বলছেন যা, ভোটটা করিয়ে দে?
কলকাতার মহানাগরিক একজন মহিলা অধ্যাপিকাকে বলেছেন, কে তুমি নন্দিনী আগে তো দেখিনি।’রকের ভাষায় কথা বলা ওইসব নেতা-নেত্রীরা নিজেদের প্রগতিশীল মনে করেন। | অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। অভিনীত ‘তিন ভুবনের পারে’ ছায়াছবিতে, রকবাজ ছেলেরা ওই গান করতে করতে একজন শিক্ষিকার পেছনে হাঁটছেন। এই সংস্কৃতি নকল করছেন। মহানাগরিক। ওই মহানাগরিক পাকিস্তানি প্রতিনিধিদের গার্ডেনরীচ, খিদিরপুর এলাকা ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন। দেখিয়ে বলেছিলেন ‘মিনি পাকিস্তান। এই হলো। ওদের দেশভক্তি। এরাই দেশের সুনাগরিক?
বিরোধীরা প্রায়ই বলে থাকেন— গেরুয়া শিবির রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে। অথচ কলকাতার টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম বলেছিলেন— মোদীর দাড়ি, চুল কামিয়ে কেউ যদি মুখে কালি মেখে দেয় তাকে ১০ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে। একজন ধর্মীয় নেতার এ ধরনের বক্তব্যকে কী বলা যায় ?
আমার ৭৬ বৎসর জীবনে বহু নির্বাচন দেখেছি। অনেক নেতা-নেত্রীর ভাষণ শুনেছি। সে সময় কোনো নেতা-নেত্রীকে এত উলঙ্গ ভাবে কাউকে আক্রমণ করতে দেখিনি। নেতা-নেত্রীরা এখন সে ভাষায়। একে অপরকে গালাগাল দিচ্ছে, শালীনতা বলে কিছু নেই। নেতা-নেত্রীদের ন্যায়, নীতি, আদর্শ বলে কিছু নেই। যেন তেন প্রকারে ক্ষমতা দখল করাই হচ্ছে আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। কথায় আছে— বড়োদের আচরণ দেখেই ছোটোরা শিক্ষা লাভ করে। বর্তমান রাজনৈতিক নেতারা যেভাবে রাজনীতিতে নােংরা অশ্লীল ভাষা, অপসংস্কৃতি আমদানি করেছে, এ সব দেখে বর্তমান প্রজন্মের যুবক-যুবতী কোন ধরনের শিক্ষা লাভ করবেন? অনেকেই হয়তো এই আদর্শ হীন রাজনীতিকেই আদর্শ বলে মনে করবে। নােংরা ভাষায়, হাত, পা, নেড়ে গলার শির। ফুলিয়ে ঝগড়ার ভঙ্গিতে বক্তব্য রাখাই আদর্শ রাজনীতি? এখানে শালীনতা বলে কিছু নেই। অশালীন ভাষায় বাক্য বর্ষণই হচ্ছে আসল নেতার পরিচয়।
সব রাজনৈতিক দলের উচিত যারা ক্ষমতায় ছিল তারা বিগত পাঁচ বছর দেশের জন্য কী কী করেছেন তা তুলে ধরা। আগামী পরিকল্পনা কী তাদের তাও ভোটারদের জানানো। বর্তমানে নির্বাচন উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গে যা চলছে, তাকে কোনোমতেই সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচন বলা যায় না। গণতন্ত্রের কারবারীরা গণতন্ত্রের কবর খুঁড়ে রেখেছেন। শুধু মাটি চাপা দেওয়ার অপেক্ষায়, বিশেষ করে আমাদের পশ্চিমবঙ্গে।
অনিলচন্দ্র দেবশর্মা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.