১৮৯৫ সালের নভেম্বরের এক বিকেল, লন্ডনের ওয়েস্টএণ্ডের এক গৃহাভ্যন্তরে অভ্যাগতদের মাঝে গৈরিক পরিচ্ছদ ও কোমরবন্ধে সজ্জিত এক উজ্জ্বল ভারতীয় সন্ন্যাসী যুবক। অদ্বৈতবাদের ব্যাখ্যা করছেন — “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”-র রূপ; গীতা থেকে শ্লোক উদ্ধৃত করছেন, আর এক দিব্যাভ্যাসে মাঝেমাঝেই চীৎকার করে বলছে, ‘শিব! শিব!’ যেন এক দিব্য শিশু, বয়স তেত্রিশ! অবলোকন করছেন আটাশ বছরের এক আইরিশ যুবতী।
তার আড়াই বছর বাদের এক ২৫ শে মার্চ, ১৮৯৮; বেলুড় মঠের ঠাকুরঘর। মার্গারেট এসছেন স্বামীজির ডাকে। আজ দীক্ষা, তিনি ভারতবর্ষের কাছে নিবেদিত (the dedicated one) হবেন। স্বামীজি তাঁকে প্রথমে শিবপূজা করালেন। সম্ভবত সন্ন্যাসী হিসাবে শৈবধর্মের ভাবসমূহের দ্বারা স্বামীজির কল্পনা সমধিক প্রভাবিত ছিল। আর ছোটোবেলায় বিলের দুষ্টুমি যেত মাথায় ‘শিব শিব’ বলে এক ঘটি জল ঢেলে দিলে।
১৯০২ সালের ৪ ঠা জুলাই; তখনও জানতেন না তাঁর Master -এর নশ্বর শরীর গেছে। সন্ধ্যেয় তিনি দিব্যচক্ষে দেখলেন, তাঁর সম্মুখে উপস্থিত শিবরূপী স্বামীজি; অন্তর থেকেই বেরিয়ে এলো, “My Salutation. Shiva Guru! Shiva Guru! Shiva Guru!”
শূণ্যপুরাণের কবিতা শুনছেন ভারতবর্ষের দত্তক নেওয়া ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেনের নিবেদিতা; শোনাচ্ছেন প্রতিবেশী তথা বাংলা সাহিত্যের দিকপাল গবেষক ড. দীনেশচন্দ্র সেন। ভাষায় বললে এইরকম “শিব কেন তুমি ভিক্ষা করে খাও? ভিক্ষা বড় হীনবৃত্তি। কোনোদিন কিছু জোটে কোন দিন রিক্ত ভাণ্ডে ফিরে আস, যদি তুমি চাষ করে ধান ভানো, তাহলে তোমার কষ্ট দূর হবে। হে প্রভু, কতদিন তুমি উলঙ্গ হয়ে কেঁদো বাঘের ছাল পরে কাটাবে? যদি কাপাস বুনে তুলো কর তবে কাপড় পরতে পেয়ে কত সুখী হবে।” নিবেদিতা শুনছেন আর উত্তেজনায় কেবলই বলছেন, ‘আশ্চর্য, আশ্চর্য! ‘
“ও দীনেশবাবু, এটা একটা আশ্চর্য জিনিস!” ভক্ত উপাস্যের কাছে চাইবেন কী! উপাস্যের প্রতি অনুরক্ত হয়ে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে ভুলে গেছেন, ঠাকুরের কষ্ট কিভাবে নিবারণ হবে, সেটাই চিন্তা। ভারতবাসী উপাস্যকে কেমনভাবে দেখেন, অবাক করে দিল নিবেদিতাকে।
তার আগে ১৮৯৮ সালের আগষ্ট মাসে কাশ্মীরের ক্ষীর ভবানী মন্দির দর্শন করছেন স্বামীজির সঙ্গে। দর্শন শেষে স্বামীজির তুরীয় অবস্থা, এক প্রগাঢ় মানসিক অভিভব। সেই মৌলিক ভাবপ্রেরণায় ওই বছর সেপ্টেম্বরে লিখলেন উনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ শাক্ত কবিতা মৃত্যুরূপা মাতা, Kali the Mother, ” Who dares misery love,/And hug the form of Death,/Dance in Destruction’s dance,/To him the Mothet comes.” (সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়, মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে,/কাল-নৃত্য করে উপভোগ,/মাতৃরূপা তারি কাছে আসে)। এ যে ভয়ঙ্করের পুজো, মৃত্যুর পুজো, এ যে কাপুরুষের আত্মহত্যা নয়, এ যে শক্তিমানের মৃত্যু সম্ভাষণ!
এক এক করে স্বামীজি লিখে চলেছেন মৃত্যুরূপা কালীকে; ‘নাচুক তাহাতে শ্যামা’, ‘My play is done’, ‘Who knows how Mother plays’. ঠিকই তো! জগজ্জননীর অনন্তলীলার কে কবে তল পেয়েছে? “কেবা সে পামর দুঃখে যার ভালবাসা?” হৃদয়কে শ্মশান করে তুলে, স্বার্থ-সাধ-মানকে চূর্ণ করে সেখানে নাচাতে চান শ্যামা-মাকে। মৃত্যু, অন্ধকার, সংগ্রাম ও দুঃখচেতনার অন্তর্নিহিতি জারিত করেছিল ভগিনী নিবেদিতাকেও।
তাই ১৮৯৯ সালের নভেম্বরে স্বামীজির সঙ্গে পাশ্চাত্যে যাত্রাকালে তিনি আরও গভীরভাবে জেনে নিলেন কালীদর্শন। তিনিও লিখলেন গ্রন্থ, ‘Kali the Mother’, এ যেন মনোময়ী কালী, একেবারেই নিবেদিতার নিজস্বতার ছোঁয়ায়। অবশ্য তার আগেই স্বামীজি নিবেদিতাকে দিয়ে বঙ্গদেশে কালীতত্ত্ব প্রচার করিয়ে নিয়েছেন। ১৮৯৮ সালের ১১ ই মার্চ কলকাতার স্টার থিয়েটারে নিবেদিতা বক্তা, ১৮৯৯ সালের ১৩ ই ফেব্রুয়ারি অ্যালবার্ট হলে, ১৮৯৯ সালের ২৮ শে মে কালীঘাট মন্দিরে। নিজের উপর বিশ্বাস যখন পুরোদমে, তখনই লিখলেন Kali the Mother. তাঁর কালী ভাবনার মধ্যে ফুটে উঠলো মানুষের মনের বিপুল শক্তির আলোড়নের প্রতিচ্ছবি, কালী-সদাশিবের তত্ত্ব। লিখতে পারছেন এই জন্যই যে ততদিনে “তার খ্রিস্টিয় সংস্কারে ওপরে কালীর ঐ কৃষ্ণছায়াপাত”-এর সূচনা হয়েছে। সৃষ্টিতত্ত্বের রহস্যের পরত সরে যাচ্ছে তাঁর কাছে, যেন কোনো লাস্যময়ীর লীলাচাতুরির হাল্কা ওড়নার ঢাকা সরে যাচ্ছে।
সৃষ্টির মিলন কোথায়? শায়িত ঈশ্বর বা শিবের আবেগগ্রস্ত দৃষ্টির সঙ্গে দেবীর নয়নের মিলন। পদদলিত হয়েও প্রেমাবিষ্ট নয়নে দেখছেন শায়িত ঈশ্বর। যে শিবকালী সাধনাকে জাতি-গঠনের কাজে লাগানোর কথা বলেছেন স্বামীজি, সেই শিব-কালীকে ভারতের চৈতন্য হিসাবে রূপায়িত করলেন নিবেদিতা। ভয়ঙ্করী কালী যেন জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ নারীর ভয়ঙ্কর বাসনা-সৃষ্টি!