উত্তর দিনাজপুর জেলায় ভারতীয় ভাবধারায় ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাদানের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের তৎকালীন সরসঙ্ঘচালক ড. রাজেন্দ্র সিংহের অনুপ্রেরণায় সুদর্শন ভট্টাচার্য, অঞ্চল কুমার বোস, রাধাকৃষ্ণ মুদ্রা, সোহনলাল ঝাওয়ার, উৎপলেন্দু সরকার, গোপেশ চন্দ্র সরকার, মহাবীর চঁাদ কাঙ্কারিয়া,, সুজন পাল, রাধাগোবিন্দ পোদ্দার, শ্যামল পাল, গোবিন্দ ঘোষ প্রমুখ সমাজসেবীর উদ্যোগে ১৯৯৫ সালে ১ মে রায়গঞ্জ শহরের সুদর্শনপুরে সারদা শিশুতীর্থের কয়েকটি কক্ষে অস্থায়ী ভাবে সারদা বিদ্যামন্দিরের শুভ উদ্বোধন ঘটে।
১ মে ছুটির দিনে অভিভাবক – অভিভাবিকরা উপস্থিত থাকতে পারবেন বলে ওই দিনটিকে শুরুর দিন হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। সেদিন সকালে অঙ্কুর, কিশলয়, ওয়ান এবং ফাইভ এই চারটি ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে বিদ্যালয়ের পথচলা শুরু হয়েছিল। ওই শিক্ষাবর্ষের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল একশো তিনজন। তখন ছাত্র-ছাত্রীদের মাসিক বেতন ছিল পঞ্চাশ টাকা। তখন প্রিন্সিপাল পদে অরূপ সরকার, আচার্যের পদেসুব্রত সরকার, প্রণতি দে, অর্চনা সাহা, অপূর্ব কুমার দাস, রাজবলী পাল প্রমুখ এবং সেবিকার পদে অঞ্জনা চৌধুরী যোগদান করেন।
১৯৯৫ সালে সুনীল কুণ্ডু চলাচলের রাস্তা এবং বিদ্যালয়ের জন্য ভূমি দান করেন। ওই বছরেই শৈলেন্দ্র নারায়ণ সেন বিদ্যালয়ের ঘর নির্মাণের জন্য চন্দোর মৌজায় পঞ্চাশ শতক জমি দান করেন। সেই জমিতে পশ্চিম মুখী প্রথম পাঁচটি ঘর গড়ে তোলা হয়। ১৯৯৬ সালের এপ্রিল মাসে এই বিদ্যালয়কে তার নিজস্ব (বর্তমান স্কুল প্রাঙ্গণে) ভবনে স্থানান্তরিত করা হয়। পরে সুনীল কুণ্ডু, মানিক চক্রবর্তী ও শেফালি চৌধুরী প্রমুখ অতি স্বল্প মূল্যে কিছু জমি দেন। বর্তমানে বিদ্যালয়ের পরিসর সাঁইত্রিশ বিঘে জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। তবে অধিকাংশ জমি প্রতিষ্ঠান নিজে ক্রয় করে।
সেখানে উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণমুখী ইউ আকৃতির ত্রিতল ভবন গড়ে ওঠেছে। দ্বিতল ও ত্রিতলের ভবনগুলির সঙ্গে দুটি ঝুলন্ত পথ সংযোগ রক্ষা করে চলেছে। সেখানে পঁয়ষট্টিটি কক্ষ ও একটি বড়ো সভাকক্ষ রয়েছে এবং মহাপুরুষদের নামে কক্ষের নামকরণ করা হয়েছে। চার দিকে সীমানা প্রাচীরও গড়ে ওঠেছে। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অশ্বত্থ, আমলকি, বট, পাকুড়, কৃষ্ণচূড়া, দেবদারু, বকুল, আম, কাঁঠাল, লিচুর গাছ এবং বনজঙ্গলে মোড়া কৃত্রিম পাহাড়ে এস.ভি.এম. লেখা দেখে মন জুড়াবে। তার মাঝে শিশুরা জিরাফ আকৃতির স্লিপারে, ঘূর্ণি চেয়ারে ও দোলনায় উঠে মনের আনন্দে খেলাধুলো করতে থাকে।
২০০৫ সালে দিল্লির কেন্দ্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড থেকে এই বিদ্যালয় ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত পঠন পাঠনের (এ.এফ.এফ. নং ২৪৩০০৭৫,এস.সি.এইচ. কোড- ৫৬০০৫) অনুমতি লাভ করে। ২০০৭ সালে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগেরও অনুমতি পায়। তবে বর্তমানে সেখানে বিজ্ঞান বিভাগ চালু আছে। উন্নত মানের পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা ও জীববিদ্যার পরীক্ষাগার গড়ে উঠেছে। বিদ্যালয়ে বিপদ আপদের জন্য ভবনের মাঝে ও দুই প্রান্তে তিনটি সিঁড়ি, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র এবং লোডশেডিংয়ের সময় জেনারেটর ব্যবস্থা চালু আছে। ২০১১ সালে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বোস নামে একটি ছাত্রাবাস স্থাপিত হয়েছে।
এই প্রতিষ্ঠানে প্রভাত ও দিবা দুটি বিভাগে পঠনপাঠন চলে। ২০১৮ সাল থেকে প্রভাত বিভাগ চালু হয়। বর্তমানে এই বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ১৬১৭ জন। সাধারণত অরুণ ও উদয় এইদুটি শ্রেণীতে ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি নেওয়া হয়। তপশিলি জাতি ও মুসলমান সম্প্রদায়ের ছাত্র-ছাত্রীরাও পড়াশুনা করে। তবে অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী সাধারণ সমাজের। রায়গঞ্জ শহরের অধিকাংশ শিক্ষক, ডাক্তার ও ব্যবসায়ীদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করতে দেখা যায়। করণদীঘি, ইটাহার, রায়গঞ্জ, হেমতাবাদ ও কালিয়াগঞ্জ ব্লকের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছেলেমেয়েরা এই বিদ্যালয়ে পড়তে আসে। বিদ্যালয়ের ছোটো বড়ো ষোলটি বাসে প্রায় চল্লিশ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী আসা যাওয়া করে এবং বাকিরা নিজেদের যানবাহনে যাতায়াত করে। বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের পোশাকনীল সাদা রঙের। শীতকালে লাল রঙের সোয়াটার ও মাফলার।
এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পঁয়ষট্টি জন শিক্ষক শিক্ষিকা পাঠদান করেন। কেরল, তামিলনাড়ু, উত্তর প্রদেশ, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তের থেকে শিক্ষক শিক্ষিকারা রয়েছেন। এঁরা অধিকাংশ এম.এ./এম.এসসি এবং প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। মাঝে মধ্যে তাদেরকে সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শিক্ষকদের সাদা ধুতি পাঞ্জাবি এবং শিক্ষিকাদের লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরতে হয়। আধুনিক যুগে ওই পোশাক শহরবাসীকেও আকৃষ্ট করে। এরা সকলে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে স্যার ও ম্যাম বলে পরিচিত। তবে পূর্বে এরা দাদাভাই ও দিদিভাই বলেই পরিচিত ছিলেন। সেখানে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে বারোজন অশিক্ষক কর্মী কাজ করেন। বিদ্যালয়ের সকল স্থায়ী কর্মীর পি.এফ.আছে এবং তাদেরকে ব্যাঙ্কের মাধ্যমে বেতন দেওয়া হয়।
প্রতিদিন বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করে মাতৃবন্দনার মধ্য দিয়ে বিদ্যালয় শুরু এবং জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে তার সমাপ্তি ঘটে। প্রার্থনার সময় ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষক শিক্ষিকা কারও পায়ে জুতো থাকে না। সকলে জুতো খুলে অধ্যক্ষ ও সহ অধ্যক্ষের ঘরে প্রবেশ করেন। যোগানুশীলন, শারীর শিক্ষা, সংগীত, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক এই পাঁচটি বিষয়ের উপর নজর দিয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদান করা হয়। তার ফলে গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি জন্মে, দেশাত্মবোধ গড়ে ওঠে। ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা বলিষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী হয়।
বিদ্যাভারতীর শিক্ষানীতি সময় সময় গ্রহণ করা হয়। শ্রেণী কক্ষে শিক্ষিকারা চিত্র প্রদর্শন, প্লেওয়ে, ভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতি ব্যবহার করেন। তারা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে অভিভাবক অভিভাবিকাদের সঙ্গে পঠন পাঠন সম্পর্কে আলোচনা করে সুপরামর্শ দেন। তার ফলে শিক্ষার্থীদের কাছে জটিল বিষয়গুলি সহজ থেকে সহজতর হয় এবং শিক্ষক শিক্ষিকা এবং শিক্ষার্থী ও অভিভাবক অভিভাবিকাদের মধ্যে সুমধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
এই বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষায় প্রথম দিকে অমিত আগরওয়াল, ঈশা আগরওয়াল, নীতেশ কুমার সাহা, মিহির কুমার ঝা, দীপ্তা চৌধুরী, অরিত্র ব্যানার্জী-সহ বহু ছাত্র-ছাত্রী উল্লেখযোগ্য ফলাফল করে এই প্রতিষ্ঠানকে গৌরবান্বিত করে চলেছে।রাকা মিত্র ন্যাশনাল চিলড্রেন সায়েন্স কংগ্রেস প্রতিযোগিতায় রাজ্য ও জাতীয় স্তরে নির্বাচিত হয় এবং গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদীর। হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করে। এই বিদ্যালয়ের ছাত্রী অন্তরা চক্রবর্তী ক্রীড়ায়, ডালিয়া চন্দ, শিউলি সরকার নৃত্যে এবং মৃন্ময়ী সরকার, উত্তরা ব্যানার্জি সংগীতে বিশেষ সুনাম অর্জন করে।
এই বিদ্যালয়ে পাঠদানের পাশাপাশি ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, জাতীয় উৎসব পালন, বনভোজন, শিক্ষামূলক ভ্রমণ, অভিভাবক অভিভাবিকা সম্মেলন, সায়েন্স সেমিনার, সমারোহের সঙ্গে সরস্বতী পুজোর আয়োজন ইত্যাদি করা হয়। অধিকাংশ সময় সেনাবাহিনীর আধিকারিকরা ক্রীড়া অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করে থাকেন। বিদ্যালয়ের পূর্ব দিকের মাঠে ওই খেলা চলে। বনভোজনে ও ক্রীড়া অনুষ্ঠানে অভিভাবক অভিভাবিকারাও যোগ দেন। শিক্ষামূলক ভ্রমণে তারা চা বাগান, বাণগড়, গৌড়, হাজারদুয়ারি এমনকী ২০০৪ সালে ভারত- পাকিস্তান ওয়াঘা বর্ডার পরিদর্শন করে।
সারদা সেবা ট্রাস্ট এই বিদ্যালয় পরিচালনা করে থাকে। এই বিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে সম্পাদকের পদে আসীন হয়েছেন উৎপলেন্দু সরকার, মহাবীর চঁাদ কান্ধারিয়া, অমরেশ কুমার মুদ্রা। অরূপ সরকার, রাজবলী পাল, রাজেশ কুমার ভার্মা, সৌমেন রায়, ধ্রুবজ্যোতি অধিকারী প্রধান আচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। এদের সকলের সহযোগিতায় এই প্রতিষ্ঠান ফুলে ফলে পল্লবিত হয়ে ওঠে। উল্লেখ্য, বিশিষ্টব্যক্তিদের মধ্যে যোগগুরু রামদেব বাবা, সঙ্ঘের তৎকালীন সরসঙ্ঘচালক সুদর্শনজী, বিদ্যাভারতীর আধিকারিক কৃষ্ণ চন্দ্র গান্ধী এবং বর্তমান সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত এখানে এসেছেন।
গত ১ জুন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে গ্রীষ্মবকাশ শুরু হয়। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক উৎপলেন্দু সরকার। তিনি ওই অনুষ্ঠানে রজত জয়ন্তী বর্ষের সদস্যদের উপস্থিতিতে বিদ্যালয়ের অতীত ইতিহাস তুলে ধরেন। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে ভবন সংস্কার, গ্রাম পরিদর্শন, বৃক্ষরোপণ, নিঃশুল্ক পাঠদান কেন্দ্র, রক্তদান শিবির, সেবক সেবিকাদের ও বিশিষ্টজনদের সম্মান জ্ঞাপন, স্মরণিকা প্রকাশ, শিক্ষামূলক আলোচনা সভার আয়োজন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালের ১ মে পর্যন্ত রজত জয়ন্তী উৎসব চলবে। এই অনুষ্ঠানে বহু মানুষজনের আগমন ঘটবে, ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকের প্রতিভার বিকাশ ঘটবে এবং এলাকাবাসীর চিত্ত বিনোদনের সুযোগ মিলবে।
ড. বৃন্দাবন ঘোষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.