১.
বাংলার আলপনা দ্বিবিধ — কামনাত্মক ও নান্দনিক। নান্দনিক আলপনা আঁকা হয় আনুষ্ঠানিক কাজে সৌন্দর্যের প্রয়োজনে; যেমন বিবাহ, উৎসব, সমাবর্তন সহ নানান সমাজিক-পারিবারিক উৎসবের প্রেক্ষিতে। কামনাত্মক আলপনা আঁকা হয় ব্রতানুষ্ঠানে, যেখানে পার্থিব কামনা-বাসনাই প্রাধান্য পায়। উভয়ক্ষেত্রেই নান্দনিকতা ও কামনার প্রকাশে ব্যবহৃত হয় কিছু ‘ মোটিফ‘ । এই মোটিফ প্রকাশের যা চিত্র, তাকেই এখানে চিহ্ন-সংকেত বা প্রতীক বলা হবে। যেমন আলপনায় কয়েকটি বিশেষ অঙ্কনরীতি হল পদ্ম, ধান, সাপ, প্যাঁচা সহ নানান পাখি, লতামণ্ডন, কলা, গুয়া, সুপারি, কড়ি, মাছ, ময়ূর, ভ্রমর, প্রজাপতি, হাঁস, মৌচাক নৌকো, সূর্য, চন্দ্র, তারা, গোলাঘর, গরু-বাছুর ইত্যাদি। এই সমস্ত প্রতীকচিহ্নগুলির কোনোটি পরিবেশ-পরিস্থিতির দ্যোতক; কোনোটি ফসলরূপে আহার্য, কোনোটি বাংলার চিরায়ত জৈববৈচিত্র্যের অপরিহার্য অঙ্গ, কোনোটিতে রয়েছে যৌন আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ।
আলপনায় প্রচলিত বহু চিহ্নের সঙ্কেত অধুনা বিলুপ্ত হয়েছে। এসেছে নব-পরিবেশানুগ নবতর তাৎপর্য। এই বিলোপ এবং নবায়নের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আলো-আঁধারির ইতিহাস। প্রস্তুত আলোচনায় আমরা আধুনিকতার মধ্যে আদিমতাকে খুঁজে পাবার চেষ্টা করবো। আলপনায় কখনই কোনো চিহ্ন-সংকেত অবিকল তার বাস্তবের প্রতিরূপ নয়। মানে সাপের হুবহু আদলের বদলে সর্পিল রেখা আঁকা হয়; পদ্মের প্রকৃত ছবির বদলে তার সাংকেতিক ছবি উপস্থাপন করা হয়; এক-দুটি রেখায় ফুটে ওঠে প্যাঁচার অবয়ব; দু একটি টানেই মাছ আঁকা হয়ে যায়। কিন্তু কেন? শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ (Abanindranath) তাঁর ‘বাংলার ব্রত‘ গ্রন্থে লিখছেন, তার কারণ শিল্পসৌন্দর্যে লোকসমাজের সীমাহীন অতৃপ্তি। অধ্যাপক মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায় ও অধ্যাপক কল্যাণ চক্রবর্তীর মতে, উদ্ভিদ ও প্রাণীর আদি ও সরলরূপ দর্শনই এর কারণ। এবং এই দেখা লোকস্মৃতিতে বংশপরম্পরায় প্রবাহিত হয়ে এসে আলপনায় চিত্ররূপ পায়। আদিম মানুষ উদ্ভিদ ও প্রাণীর যে অবয়ব লক্ষ লক্ষ বছর আগে থেকে দেখে এসেছে, তা ছিল আজকের চাইতে অনেকানেক সরলরূপ। এই সরলতার একককেই আবিষ্কার করার চেষ্টা করে এসেছে সৌন্দর্য-প্রিয় আদিম মানুষ। আলপনা সম্ভবত সবচাইতে প্রাচীন চিত্রকলার এক বিবর্তিত রূপ যেখানে অঙ্কনের মূল কাঠামোটি আবিষ্কারের চেষ্টা হয়েছে। তাই তার সব প্রতীকই সরলরূপে প্রতিভাত। এ হয়তো আদিম গুহাচিত্রের এক উজ্জ্বল ভৌমাঙ্কন। অজন্তা-ইলোরায় এরই সৌকর্য বাড়ানোর চেষ্টা হয়েছে দেওয়ালে দেওয়ালে।
আলপনার তন্বিষ্ঠ পাঠ করলে দেখা যাবে সেখানে পরিবেশিত চিহ্ন-সংকেতে পরিবেশ-ভাবনা কতটা গভীরভাবে ধরা দেয়। মাঘ-মণ্ডলের আলপনা, পুণ্যপুকুর ব্রতের আলপনাসহ নানান কামনাত্মক আলপনায় সূর্য-চন্দ্র-তারা-নদী-সমুদ্র-পর্বত-বনানী এবং জৈববৈচিত্র্যের সমাহারে যে সামগ্রিক চিত্র উপস্থাপিত হয়, তা লোকশিল্পীর চেনা-পরিচিত জগতের চিত্ররূপ। মানুষ যা দেখে তাই ভাবে, তাই আঁকা হয়ে ধরা দেয়।
বিয়ের আলপনায় মাছ এসেছে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসাবে। বিধবারা মাছ খান না, কেননা তাদের সামাজিক অনুশাসনে সৌভাগ্য-রহিত করে রাখা হয়েছে। তাই বিয়ের আলপনাসহ নানান কামনাত্মক আলপনায় মাছের ব্যবহারের অর্থ দাঁড়ায় সিঁথির সিঁদূরকে অক্ষুণ্ণ রাখা। সাপ বংশবৃদ্ধির প্রতীক; সাপ বা সর্পিল রেখা অঙ্কনের অর্থ যৌনতার প্রকাশ, সন্তান উৎপাদনের আর্জি। কলার চিত্র আঁকা হয় পুরুষের যৌনাঙ্গের প্রকাশার্থে। সাপ সন্তান-উৎপাদনশীল নারীশক্তির প্রতীক। সাপের দুধ-কলার খাবার মিথ যতটা না বাস্তব, তার চাইতেও অধিক তার পরা-বাস্তবতা; লোকসমাজের ফার্টিলিটি-কাল্ট।
দেবী লক্ষ্মী যেহেতু পদ্মাসনা; তাই পদ্মের মাধ্যমে লক্ষ্মীকে অচলা করে রাখার প্রয়াস করেন বাংলার নারী। ধান, ধান-ছড়া, মরাই ইত্যাদি লক্ষ্মীর প্রতীক। আলপনায় কখনও বাঁকা, কখনও সরলরেখায় ধানের শীষ আঁকা হয়। ধানগাছ বাতাসের আন্দোলনে ঢেউ খেলে যায়, শস্যের ভারে নুয়ে পড়ে মাটিতে, ঝড়-বৃষ্টিতে শুয়ে পড়ে তার পাশকাঠি; ধানের এই বৈশিষ্ট্যের (Lodging) জন্যই সম্ভবত আলপনায় ধানের শীষ আঁকা হয় বাঁকা বা লতানো ভাবে। সেঁজুতি ব্রতের আলপনায় সুপারিবাগান আঁকা হয়; পান-সুপারি স্বামী-সোহাগের প্রতীক, পেট ভরে খাবার পেলে তবেই শৃঙ্গারের সাধ জাগে নারীর হৃদয়ে, তখনই ঠোঁট লাল করে পান-সুপারি খান গৃহস্থ নারী; সেঁজুতি ব্রতে এমন স্বামী-সোহাগের জীবন কামনা করা হয় প্রতিনিয়ত।
আজকের আলপনাতে অরণ্য-কেন্দ্রিক সভ্যতার মিসিং-লিঙ্ক চোখে পড়ে অনেক সময়। কৃষি-সম্পৃক্ততার প্রকাশও নানাভাবে ধরা দেয়। মনে করা যেতে পারে, আলপনার যে জ্যামিতি, তার শুরুটা হয়েছিল সম্ভবত আদিম মানুষের বনচারী জীবন ছেড়ে বেরিয়ে চাষের জন্য জমি তৈরি ও সমতল করার প্রাচীন প্রক্রিয়া থেকে। জোয়াল-বাহিত আদি লাঙ্গলের মৃত্তিকা খননে তৈরি হয়েছিল মাঠের আলপনা; তার দুপাশে গবাদিপশু এবং আদিম কৃষকের পদচিহ্ন, জমি-কর্ষণে উদ্ভূত পোকামাকড়ের লোভে ধেয়ে আসা পাখ-পাখালির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদচিহ্ন, সর্বোপরি মাঠ-ভর্তি পাকা ধান/গমের সমারোহ — সব মিলিয়ে মানুষের সহজাত নান্দনিকতায় হয়ে উঠেছে ব্রত-পূজার আলপনার সমরূপ চিত্রাবলী। মানুষ বিশ্বাস করেছে, এমন চিত্র আঁকলেই বাস্তবে কৃষকের মাঠে আজও প্রভূত ফসল নিয়ে ধরা দেবে পৃথিবী-দেবী। অতএব, আলপনা হল মানুষের জাদুবিশ্বাস এবং নান্দনিকতার যৌথ-ফসল।
২ .
আলপনার মধ্যেকার সংযোগ-সামর্থ্য বুঝে নিতে পারলে তার চিহ্ন-সংকেতগুলি ধরা সহজ হবে। আলপনায় লোকশিল্পী-মননের নীরব অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয়। এই যে প্রকাশ, এই যে অভিব্যক্তি, এই যে সংযোগ-সামর্থ্য এর চারটি উপাদান। আলপনার সংযোগ-প্রক্রিয়ায় প্রেরক বা Sender হচ্ছেন ব্রতিনী নারী; বার্তা বা Message হল নারীমনের বিচিত্র কামনা-বাসনার মনঃস্তত্ত্ব; মাধ্যম বা Channel হল পিটুলি গোলা জল যা ভেজা চাল বেটে জলে গুলে তৈরি করা হয় এবং তার মাধ্যমেই ছবি আঁকা হয়; প্রাপক বা Receiver হল সেই ব্যক্তি যে আলপনাকে অবলোকন করেন, পড়ার চেষ্টা করেন, শিল্প-সৌন্দর্য উপভোগ করার চেষ্টা করেন। দর্শক এভাবেই অতি-পুরাতন অথচ চিরনতুন শিল্প কর্মের কামনার নান্দনিক প্রকাশে অভিভূত হন। বুঝতে পারেন বাড়ি, রান্নাঘর, গরু-বাছুর, গোলাঘর, গয়নাগাটির ছবি এঁকে ব্রতিনী বুঝিয়ে দিয়েছেন, তার পার্থিক বাসনা। তিনি তো এসব করেছেন ভাবজগতে পৌঁছে দিতে, লৌকিক ও পৌরাণিক দেবতার কাছে; যদি দেবতার আশিসে তিনি অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতায় পৌঁছাতে পারেন; তার স্বামী, তার ভাইয়ের কৃষি ও ব্যবসায় আয় বহুগুণ বেড়ে যায়।
এদিকে আলপনার রচনায়, নান্দনিকতায়, দর্শনে ও চিন্তনে স্রষ্টা ও দর্শকের মধ্যে যে সুকুমার হৃদয়বৃত্তির জন্মদান করে, তার ফলে উভয়েই এক সাংস্কৃতিক ঐক্য অনুভব করে। এর মধ্যেকার শুভশক্তি, সাংসারিক ঐক্য, গৃহজীবনের আনন্দ, পারিবারিক জীবনের পবিত্রতা — তাই নিমেষে পৌঁছে যায় দর্শকের হৃদয়ে।
কামনাত্মক আলপনায় একদা মূল কামনা ছিল সন্তান, যা গোষ্ঠী-জীবনকে জনসম্পদে পরিপুষ্ট করে। তাই ‘হাতে পো কাঁখে পো’ আলপনায় নারীর কোলে-কাঁখে সন্তান খেলা করার ছবি। এর পরবর্তী চাহিদা শস্য উৎপাদন, শিকারের সহজলভ্যতা। মাটিতে সবুজ ফসল চাই, নদী-বিল-সাগরে প্রচুর মাছ, চিংড়ি আর কাঁকড়া শিকার চাই, গোয়াল ভরা গোরুর অঢেল দুধ চাই কামধেনুর মতো, আর বন থেকে চাই মধু, মোম, কাঠ, বনজ সম্পদ। আবার ‘বেলপুকুর ব্রত‘-এর মতো আলপনায় বটগাছ যেন প্রকৃতির সামীপ্য-সান্নিধ্যে থাকার আকুতি; তার সুপারি গাছ যেন আবাস সন্নিহিত সবুজ-পরতের মাথা উঁকি দিয়ে ধরা দেয়। কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার ব্রততে প্যাঁচা যেন বাস্তবের ধানজমিতে ইঁদুরের আক্রমণ প্রতিহত করবে। কৃষিক্ষেত্রে ইঁদুর ভক্ষণ করে একসময় কৃষকের মন জয় করেছিল প্যাঁচা, তাই ধন্যবাদ দিতে প্যাঁচাই হয়ে উঠলো ক্ষেত্রলক্ষ্মী, পরে দেবতার মানবী মূর্তিতে দেবী লক্ষ্মীর বাহন হয়ে উঠলো সেই প্যাঁচা — এক দীর্ঘ সাংস্কৃতিক-বিবর্তনের ইতিহাস; আলপনাতেও তারই লোকস্মৃতি।
‘বৌ-ছত্র‘, ‘ঘট-লাজ‘ আলপনায় আঁকা হয় পদ্ম; লক্ষ্মীপূজার আলপনাতেও পদ্মের ছড়াছড়ি। কোথাও আলপনায় পূর্ণ বিকশিত পদ্ম, কোথাও দশদল, শতদল পদ্ম, কোথাও যুগ্মপদ্ম, কোথাও শঙ্খ-পদ্ম। বিয়ের পিঁড়িতে আঁকা হয় শতদল পদ্ম। কেন আঁকা হয়? কারণ পদ্মফুল আমাদের চিন্তনে হয়ে উঠেছে নারী-প্রত্যঙ্গের প্রতীকী-ব্যঞ্জনা। পুরুষ যে নারীকে আজ গ্রহণ করতে চলেছে, সে হবে গর্ভবতী, কামনায় তার সর্বাঙ্গ-সুন্দর নিখুঁত যোনী প্রার্থনা করেছে বিবাহের দেবতার কাছে। আর আঁকা হয় ফলন্ত কলাগাছ; নারী তার পুরুষটিকে যেভাবে কামনা করেছে আজ। কাজেই বিবাহের আলপনার প্রতীক চিহ্নগুলি হল পদ্ম, কলা; আর আঁকা হয় প্রজাপতি, আনন্দের বর্ণমালা; আঁকা হয় মৌচাক — নারী-পুরুষের বৈবাহিক জীবনের আনন্দমালা; আঁকা থাকে মাছের ছবি যা সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্যের প্রতীক।
তথ্যসূত্র
মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায় (Mananjali Bandyopadhyay) এবং কল্যাণ চক্রবর্তী (Dr. Kalyan Chakraborty) (১৪১২) আলপনার জৈববৈচিত্র্য, লোকসংস্কৃতি গবেষণা ১৮(১): ৬৯-৭৫।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী (Dr. Kalyan Chakraborty)।