অকৃতজ্ঞতা বহুমাত্রিক। উপকারীর উপকার যারা ভুলে যায় – তাদের ইঁদুরের চেয়ে অধম ভাবা উচিত। গল্পে আছে সিংংহের গুহায় ইঁদুর ঢুকে পড়লে সিংহ তাকে থাবায় ধরে বলেছিল, তোকে আমি খেয়ে ফেলি? সিংহকে ইঁদুর বলেছিল আপনি আমায় প্রাণ ভিক্ষা দিন। পড়ে কখনো আপনার উপকারে লাগতেও পারি। শিকারির জালে আটকে পড়া পশুরাজ সিংহের গর্জন শুনে সেই ছোট্ট ইঁদুর এসে কিভাবে তার প্রাণ বাঁচাতে জালের দড়ি কাটল – আমাদের পাঠশালার কিশোর-কিশোরীরা জানে।
দুঃখের কথা কিছু শিক্ষা দীক্ষায় প্রতিষ্ঠিত পারঙ্গম মানুষ এসব হিতোপদেশ ভুলে যায়। কথাগুলি মনে পড়ল কিছুদিন আগে একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত একটি পত্রের বক্তব্য চোখে পড়ার পর। পত্র লেখকের নাম মনে নেই। পত্রিকাটি আমি পড়ি না। মুখদর্শনী (Facebook) –তে সেই মুদ্রিত পত্র তুলে এক ভদ্রলোক ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ড. শ্যামাপ্রসাদ বাংলায় ভয়াবহ পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন। তিনি কিছুই করেননি।
কথাটি যদি সত্য হত মনে করতাম ড. শ্যামাপ্রসাদের জীবনে কোন বড় ভুল হয়ছিল। কিন্তু তথ্য ঘাঁটতে গিয়ে পেলাম ড. মুখোপাধ্যায় পঞ্চাশের মন্বন্তর চলাকালীন ফজলুল হক মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন না। ‘রাষ্ট্রসংগ্রাম ও পঞ্চাশের মন্বন্তর’ বইটি তিনি লিখেছিলেন পৌষ ১৩৫০ সালে। তার আগে ২০ নভেম্বর ১৯৪২ এ তিনি পদত্যাগ করেছেন। ২৩ নভেম্বর বিবৃতি দিয়েছেন। সেই বিবৃতির একাংশে বহু কথিত স্বায়ত্বশাসনকে হাস্যকর (‘the so called system of Provincial Autonomy colossal mockery’) বলে অভিহিত করেছেন। এর পরও যারা বাংলার ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের জন্য ড. মুখোপাধ্যায়কে দায়ী করেন তারা হয় ইতিহাস জানেন না, নতুবা শ্যামাপ্রসাদ সম্পর্কে অন্ধ বিরোধিতা করতে ব্যস্ত থাকেন।
১৯৪৪ এ ব্রিটিশ সরকার একটি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে গড়ে ‘Indian Femine Commission’ এই কমিশনে ড. মুখোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, “দুর্ভিক্ষ হইবার কোন সঙ্গত কারণ ছিল না, ব্রিটিশ শাসন এবং ভারত গভর্নমেন্ট ও বাংলার মুসলিম লীগ গভর্নমেন্ট পরস্পর সহযোগিতা করিয়া দুর্ভিক্ষ ঘটাইয়াছে”।
১৯৪২ এ শ্যামাপ্রসাদ পদত্যাগ করার পর হক মন্ত্রীসভার পতন আর সাহেব সুরাবর্দির নেতৃত্বে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। মন্বন্তর পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর অবস্থায় বাঁক নেয়। ১৪ জুলাই ১৯৪৩ বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদে একটি অবিস্মরণীয় বক্তৃতা দেন । তাতে আছে বাংলার ‘খাদ্য পরিস্থিতি’ , ‘খাদ্যশস্য সংগ্রহ ও বন্টন’ – ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছে, এজন্য দায়ী ব্রিটিশ সরকার আর বিশেষ করে সুরাবর্দি সরকারের উদাসীনতা। সরবরাহ সচিবের ভুমিকায় তিনি হতাশা ব্যক্ত করেন। শুধু তাই নয়, মন্বন্তর পরিস্থিতিতে ড. শ্যামাপ্রসাদ যে ত্রাণ পরিষেবার সমান্তরাল ব্যবস্থা শুরু করেন – সুরাবর্দি তাকে আক্রমণ সমালোচনা করেছিলেন। শ্যামাপ্রসাদ বক্তৃতায় সেকথা উল্লেখ করতে ভোলেন নি।
সেই অসাধারণ বক্তৃতা যারা অনুসরণ করবেন তারা বুঝবেন, শ্যামাপ্রসাদের মত কণ্ঠস্বর সেদিন লক্ষ – কোটি দারিদ্র্য অনাহার ক্লিষ্ট দেশবাসীর বেদনা ও প্রতিবাদকে তুলে ধরেছিল – এর পাশাপাশি কোন শব্দ কিন্তু শোনা যায় নি সেদিন । তা সত্তেও শ্যামাপ্রসাদকে তাঁর সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক দল, মুসলিম লীগ – কংগ্রেস তাঁকে আক্রমণ করেছে । আজও হিন্দু নামধারী কিছু আশ্চর্য চরিত্র তাঁকে মিথ্যা দুর্নাম দিয়ে চলেছেন। এদের অজ্ঞতা সীমাহীন, কিন্তু অহঙ্কার আকাশ ফাটিয়ে দেয়। ড. শ্যামাপ্রসাদের সমালোচনা করার আগে মূর্খের মত হুঙ্কার না দিয়ে একটু সেই ক্রান্তিকালের ইতিহাস পড়ুন।