প্রথম পর্ব
ওঁ ধ্যায়েন্নিত্যং মহেশং রজতগিরিনিভং চারুচন্দ্রাবতংসং রত্নাকল্পোজ্জ্বলাঙ্গং পরশুমৃগবরাভীতিহস্তং প্রসন্নম্।পদ্মাসীনং সমন্তাৎ স্তুতমমরগণৈর্ব্যাঘ্রকৃত্তিং বসানং বিশ্বাদ্যং বিশ্ববীজং নিখিলভয়হরং পঞ্চবক্ত্রং ত্রিনেত্রম্।।
শিব রুদ্র , প্রলয়ংকর , সর্বশক্তিমান , আদিপিতা। তিনি হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী অরুণাচল থেকে গুজরাট সকল ভারতবাসী একমাত্র গণদেবতা । মহাদেব ,লিঙ্গরাজ, লিঙ্গেশ্বর, পশুপতি , মহাকালেশ্বর ,বৈদ্যনাথ , আশুতোষ ভোলেবাবা কত তাঁর নাম। তিনি অতি সরল ,অনাড়ম্বর, তিনি সংস্কারমুক্ত দেবতা । আচন্ডাল সকলের তিনি দেবতা। তিনি সামান্য বেলপাতা ও জলে তুষ্ট । পথে ঘাটে, মাঠেবাটে, নদীর ধারে, বনে জঙ্গলে ফুটে থাকা ঘেঁটু, আকন্দ, ধুতরা, কুন্দ , বেল, কলকের পুষ্পাঞ্জলিই তাঁর জন্য যথেষ্ট । তাঁর জন্য ওম নমঃ শিবায় মন্ত্র যথেষ্ট।
সিন্ধু সভ্যতার পূর্ব থেকে তিনি আরাধ্য হয়ে আছেনম তিনি আরাধ্য হয়ে আছেন পরম ব্রহ্ম রূপে সৃষ্টির আদিকাল থেকে। তিনি পরম কল্যাণময় পরমেশ্বর ।তিনি শান্তম্ শিবম অদ্বৈতম্। তিনি সত্য , তিনিই সর্বাপেক্ষা সুন্দর। তিনি কখনো কৃষক, কখনো বৈদ্যরাজ, কখনো যোগীরাজ , কখনো বা শ্মশানে অধিষ্ঠাতা। তিনি প্রাণীকুলের রক্ষাকর্তা পশুপতি। তিনি সৃষ্টি স্থিতি লয়ের দেবতা। তিনি আদিম, তিনি মহেশ্বর । তাঁর শক্তি আদ্যাশক্তি মহামায়া । তিনি বলি থেকে ইন্দ্র,রাম থেকে রাবণ , অর্জুন থেকে গান্ধারী সকলের উপাস্য। তিনি পিনাকপানি , তিনি পাশুপত অস্ত্রের অধিকারী ।
সুপ্রাচীন ভারতের একটি সুপ্রাচীন অংশ বঙ্গভূমি। বলি রাজার পুত্র বঙ্গের রাজত্বের মানুষজন বঙ্গবাসী। বঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের একাংশ পর্যন্ত সিন্ধু সভ্যতার বিস্তৃতি ছিল। তাই আদিদেব পশুপতি শিবের উপাসনা হত এই প্রাচীন বঙ্গে। বৌদ্ধ জাতকের গল্পে বর্ধমান এবং মেদিনীপুর অঞ্চলে শিবি এবং চেত নামক দুই রাষ্ট্রের উল্লেখ আছে। এই দুই রাষ্ট্রেই শিবপূজার প্রচলনের কথা জানা যায়। বঙ্গের স্বাধীন নৃপতি শশাঙ্কও শিবের উপাসক ছিলেন। এই বঙ্গেই উত্থান ঘটেছিল নাথযোগী সম্প্রদায়ের।
বঙ্গকে যেমন কালীক্ষেত্র বলা হয় তেমনি বঙ্গ কিন্তু ভৈরবক্ষেত্রও বটে। দেবীর অঙ্গ এই বঙ্গ তথা অখন্ডভারতের যেথায় যেথায় পড়েছে সেথায় সেথায় গড়ে উঠেছে শক্তি পীঠ, আর প্রতি শক্তিপীঠে আছেন শিবের এক এক ভৈরবের অবস্থান।
কলকাতা শহরের বয়স ৩২৭ বছর। কিন্তু এই কলকাতাকে যেমন মাকালীর নামে চেনা যায় তেমনি মহাদেবের কলকাতাও বটে। কলকাতার এমন বহু স্থান আছে যা কেবল ঐতিহাসিকই নয় প্রাচীন এবং ঐতিহ্যমন্ডিতও বটে। ১৮৫৬ সালের এক নথি থেকে জানা যায় সেই পুরোনো কলকাতার রাস্তায় মোট ৫১ টি শিব মন্দির ছিল। আজ তার মধ্যে থেকে যাওয়া চব্বিশটি টি প্রাচীন শিবমন্দির নিয়ে আলোচনা করব:
৫০৯ নম্বর রবীন্দ্রসরণির উপর কুমোরটুলির কাছাকাছি সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরের ঠিক উল্টো দিকে রয়েছে জোড়া_শিবমন্দির । প্রাচীন কলকাতা শহর থেকে বর্তমান কলকাতা শহর…. এই মন্দির জোড়া শিব মন্দির নামেই পরিচিতি লাভ করেছে। এই মন্দিরে দুইটি শিবলিঙ্গ রয়েছে । এই মন্দির স্থাপত্য নবরত্ন মন্দির স্থাপত্যের ন্যায় নির্মিত হয়েছে। বর্তমানে পুরনো মন্দির সংস্কার করে নতুন রূপ প্রদান করা হয়েছে। তবে মন্দিরের খুব একটা পরিবর্তন আসেনি । পরবর্তী সময়ে এই মন্দিরে রামসীতা, রাধাকৃষ্ণ , দেবী জগদ্ধাত্রীর মূর্তি বসানো হয়েছে। মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ করেন স্থানীয় বাসিন্দারাই।
১৮/১ কেনডারডাইন লেন, কলকাতা – ১২ , সেন্ট্রাল মেট্রো আর বউবাজার ক্রসিংয়ে বিবি গাঙ্গুলী স্ট্রিটে মেট্রো বিল্ডিংয়ের পাশ দিয়ে যে গলি গিয়েছে সেখান থেকে এই মন্দিরে যাওয়া যায় । সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ের যোগাযোগ ভবনের পাশ দিয়েও এই মন্দিরে যাওয়া যায়। পঞ্চরত্ন ঘরানার দুটি মন্দিরের সঙ্গে একটি নবরত্ন মন্দির মিশে আছে এখানে । তিনটি মন্দিরে তিনটি শিব লিঙ্গ রয়েছে। এই মন্দির ত্রয় একত্রে মহেশ্বরম শিবমন্দির নামে পরিচিত। ১৭৮৫ সালে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল । ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ফোর্টউইলিয়ামের দেওয়ান ত্রিলোকরাম পাকড়াশি এটি নির্মাণ করেছিলেন । ত্রিলোকেরামের মৃত্যুর পর তাঁর সুপুত্রী সর্বমঙ্গলা দেবী ও তার স্বামী রঘুনাথ মুখোপাধ্যায় মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪০ সালে এবং ১৯৭৫ সালে মন্দিরটির সংস্কার হয়েছিল। বর্তমানে এই মন্দির কলকাতা শহরের একটি হেরিটেজ ব্লিডিং হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।
নিমতলা ঘাট স্ট্রিট এবং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (Devendranath Tagore) ক্রসিংয়ের মসজিদ বরাবর এগিয়ে গেলেই দণ্ডায়মান রয়েছে ৩০০ বছরের পুরাতন এক শিব মন্দির। ভূতনাথ মন্দির থেকে হেঁটে এই মন্দিরে যাওয়া যায়। ১৭১৬ সালে মতান্তরে ১৭৯৪ সালে মদনমোহন দত্ত মতান্তরে তাঁর পুত্র এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন ।এই মন্দিরের নাম দেওয়া হয়েছিল দূর্গেশ্বর শিবমন্দির। প্রায় ৩০ ফুট চওড়া, ৬০ ফুট উচ্চ এই মন্দিরটির মধ্যে রয়েছেন ৮ ফুট উঁচু শিবলিঙ্গ । শিবের মাথায় জল ঢালতে মই দিয়ে উপরে উঠতে হয়। মন্দিরটির পাশেই দত্ত পরিবারের জমিদারবাড়ি এখনো রয়েছে । ছোট ছোট পুরোনো ইঁট দিয়ে নির্মিত এই মন্দিরের এখন প্রায় ভগ্নদশা। যদি কেউ আমার এই প্রবন্ধটি পড়ে থাকেন তবে অনুরোধ রইল যে, তিনি অথবা তাঁরা নিশ্চয়ই মন্দির সম্পর্কে খোঁজ নেবেন।
নন্দরাম সেন স্ট্রিটে অবস্থিত প্রায় ৯০ ফুট উচ্চ, দৈর্ঘ্য প্রস্থে ৩০/ ৪০ ফুট এই মন্দিরের বয়স কলকাতার সমান। এমন্দিরের নাম রামেশ্বর শিবমন্দির। কিংবদন্তি আছে এক সন্ন্যাসীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে এখানে মহাদেব মহেশ্বরে পূজা সূচিত হয়েছিল। তখন বর্তমান মন্দিরের পাশ দিয়ে গঙ্গা বয়ে যেত । তারপর কোম্পানির আমলে সহকারি দেওয়ান নন্দরাম সেন এই শিবলিঙ্গ ঘিরে বর্তমান মন্দির নির্মাণ করেন । এই মন্দিরের গাত্রের ফলকে মন্দির স্থাপনের সময় লেখা রয়েছে ১০৬১ বঙ্গাব্দ ৩১ শে চৈত্র । বর্তমানে মন্দির পরিচালনা সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন মানববিকাশ ট্রাস্ট।
বেলেঘাটা ফুলবাগান অঞ্চলে সুরেন সরকার রোডে অবস্থিত বেলেঘাটা শিব মন্দির। আঠারো শতকের শেষ দিকে জমিদার রাজেন্দ্রলাল মিত্র এই মন্দির মন্দির নির্মাণ করেছিলেন । মন্দিরের স্থাপত্য মাঝারি আটচালা ধরনের। তবে জোড়া আটচালা । এই শিবমন্দিরের নামেই এলাকার নাম হয়েছিল জোড়াশিব বাগান। স্থানীয় উদ্যোগে কয়েক বছর পূর্বে মন্দির সংস্কার করা হয়েছে। এই মন্দিরের নিকট আরও একটি শিবমন্দির রয়েছে। স্থানীয় পূজারী এবং স্থানীয় লোকদের বক্তব্য অনুযায়ী সেটিও রাজেন্দ্রলাল মিত্রের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল।
কলকাতার অন্যতম পুরনো জমিদার রাজা জয়নারায়ণ ঘোষাল। খিদিরপুরে তাঁর জমিদারি ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণের জন্য রাজা জয়নারায়ণে নিকট থেকে বর্তমান ফোর্ট উইলিয়াম এলাকায় তাঁর যা জমি ছিল কিনে নিয়েছিল। তখন ফোর্টউইলিয়ামের জমির নিকট দিয়ে গঙ্গা বহমান ছিল। জয়নারায়ণ বাধ্য হয়ে জমিদারী তুলে নিয়ে এসেছিলেন খিদিরপুরে। তিনি খিদিরপুরের ১০৮ বিঘা জমি কিনে নতুন জমিদার বাড়ি নির্মাণ করলেন। রাজা জয়নারায়ণ ১৭৮০ সালে আটচালা ধরনের দুটি মন্দির নির্মাণ করলেন তিনি । শিব – গঙ্গা নামে পুকুরের দুই পাশের দুই মন্দিরে ১১ ফুটের শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করে তাতে নিত্যপুজা চালু করলেন । রক্তকমলেশ্বর শিব এবং কৃষ্ণচন্দ্রেরশ্বর শিব নামে পরিচিত হয় এই দুই শিব লিঙ্গ। এই দুই মন্দিরের পাশেই রয়েছে জমিদারবাড়ির কুলদেবী মা পতিতপাবনীর মন্দির। শোনা যায় সাধক রামপ্রসাদ এই মন্দিরে এসে স্থানটির নাম দিয়েছিলেন ভূকৈলাস। সেই থেকে এই মন্দিরদ্বয়ের নাম ভূকৈলাস শিবমন্দির। খিদিরপুর ট্রাম ডিপোর খুব কাছেই এই মন্দির । বর্তমানে এটি কলকাতা শহরের একটি হেরিটেজ বিল্ডিং।
শোভাবাজার মেট্রো স্টেশন থেকে নেমে গিরিশ পার্কের দিকে যেতে তিন নম্বর গলি দিয়ে ডান দিকে ঘুরলে দেখা যায় নীলকন্ঠ শিবমন্দির। ১৮৯৪ সালে এই শিব মন্দির নির্মিত হয়েছিল দালান রীতির আঙ্গিকে। নবীনচন্দ্র কর্মকার তাঁর পিতা কুবেরচন্দ্রের ইচ্ছানুসারে এই মন্দির নির্মাণ করেন । একসময় শিবরাত্রিতে এই মন্দিরের যাত্রা হত , সিনেমা কবিগানের আসর বসতো ….এখনো নিয়মিত পূজা করে চলেছেন কর্মকারদের বংশধরেরা।
মহাত্মা গান্ধী রোড ধরে চিত্তরঞ্জন কলেজের উল্টোদিকে রাস্তা ধরে এগোলে ডান হাতে পরবে বেনিয়াটোলা লেন । এইখানেই অবস্থিত বেনিয়াটোলা লেনের শিবালয় শিবমন্দির । দত্তপুকুরে নিবাধুইয়ে মুখোপাধ্যায় জমিদার পরিবারের বাস ছিল । তাঁদেরই একাংশ বর্তমান বেনিয়াটোলা লেনে চলে আসেন ।সেখানে তাঁরা এই শিব মন্দিরটি নির্মাণ করেন । ঠিক কবে এই মন্দির নির্মিত হয়েছে তার সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না বর্তমান প্রজন্মের কাছ থেকে । তবে খুব সম্ভবত অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে হেস্টিংসের আমলে তৈরি বলে জানা যায়। এই পরিবারে বংশপরম্পরায় মন্দিরে রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছেন । তারিণী মুখোপাধ্যায় , সদাচরণ মুখোপাধ্যায় …..পরবর্তী সময়ে খগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় , ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের পরের প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও কালীকুমার মুখোপাধ্যায়ের হাতে এই মন্দিরের প্রভূত উন্নতি হয়।
ক্রমশঃ
This piece has been authored by Durgesh Nandinee, for a joint initiative by Baarta Today and the Indic Collective.
তথ্যঃ কলকাতার শিবমন্দির : জয়দীপ চক্রবর্তী (Joydeep Chakraborty)