সপ্তাহের ছুটিতে কোথাও যাওয়ার কথা ভাবছেন? কোথায় যাবেন, কীভাবে যাবেন, থাকার জায়গা আছে কি না, কী কী দেখবেন– এ সবও নিশ্চয়ই ভাবতে হচ্ছে। এবার থেকে সেই দায়িত্ব আমাদের। যাঁরা বেড়াতে ভালবাসেন, যাঁরা দেখতে চান বাংলার মুখ, তাঁদের কথা মনে রেখেই শুরু হল নতুন এই ধারাবাহিক ‘পায়ে পায়ে বাংলা’। এ হল বেরিয়ে পড়ার ভ্রমণ গাইড। এ এমন এক সোনার কাঠি, যার ছোঁয়ায় জেগে উঠবে রোজকার হাঁপিয়ে ওঠা জীবন, ফুসফুসে ভরে নেওয়া যাবে তাজা হাওয়া, মন মেতে উঠবে আনন্দে। তা হলে আর দেরি নয়। খুঁজে নিন আপনার পছন্দের জায়গা, গুছিয়ে ফেলুন ব্যাগ, হুশ করে বেরিয়ে পড়ুন সপ্তাহের শেষে। আপনার সঙ্গে রয়েছে ‘পায়ে পায়ে বাংলা’।
পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম কিন্তু নতুন কোনও গ্রাম নয়, বেশ প্রাচীন গ্রাম। ওড়িশা রাজ্যের সীমান্তের জঙ্গলে ঘেরা নয়াগ্রাম অতীব সুন্দর এক থানা অঞ্চল। এখনও দিনের বেলা এখানে রাস্তা পারাপার করে হাতি। প্রচণ্ড গরমে কোনও হাতিকে গ্রামের পুকুরে শুয়ে থাকতেও দেখা যায়। স্নান শেষ হলে কাদামাখা হাতি আপন খেয়ালে দুলকি চালে জঙ্গলের দিকে চলে যায়। এত সব থাকার পরেও পর্যটনের কোনও পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি এখানে। তবু সাধারণ মানের হোটেল ও ভাল মানের বনবাংলো পর্যটকদের তৃষ্ণা মেটায়।
নয়াগ্রামের খড়িকামাথানি ব্যস্ত এলাকা। এখান থেকে কাছেই, পাঁচ কিলোমিটার দূরে কালুয়াষাঁড়ের থান। তার চার পাশে জঙ্গলে ঘেরা লোধা সম্প্রদায়ের বাস। এদের উপাস্য দেবতা কালুয়া ষাঁড়। গভীর শাল জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে একটা কালো ষাঁড় আবার জঙ্গলের অন্ধকারেই মিশে যেত। হিংস্র বাঘের মুখে পড়ে জঙ্গলের অসহায় মানুষ ষাঁড়বাবাকে স্মরণ করত। ষাঁড়বাবা উপস্থিত হয়ে বাঘের সঙ্গে লড়াই করে তাদের প্রাণ বাঁচাত। আজও নয়াগ্রাম এলাকার লোকেরা ঘরের বাইরে গেলে কালুয়া ষাঁড়কে স্মরণ করে যান।
এখানে মন্দির বা দেবতার কোনও মূর্তি নেই। গভীর জঙ্গলের মধ্যে থানটির চার দিকে পোড়ামাটির ছোট বড় ঘোড়া ও হাতি। এগুলো দিয়েই পুজো দেওয়ার রীতি এখানে। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার ছাগল ও মুরগি বলি হয়। পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন এখানে বসে বিরাট মেলা। কালুয়া ষাঁড়কে দুম অর্থাৎ মদ দিয়ে পুজো দেওয়ার চল আছে। গা ছমছমে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এখানে পৌঁছনোই বিরাট চ্যালেঞ্জ।
নয়াগ্রাম বাজারের মধ্যে আছে নবাবের কাছারি বাড়ি। মুর্শিদাবাদের নবাব সব এলাকা দিয়ে দিলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে নয়াগ্রামকে হাতছাড়া করেননি। সেই কাছারি বাড়ি অনেক ইতিহাস বুকে নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে কিছুটা এগোলেই ভসরা ঘাট, সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে সুবর্ণরেখা নদী। এখান থেকে দিনের শেষে সূর্যাস্তের দৃশ্য নিয়ে যায় এক অচিনপুরে।
নয়াগ্রাম থেকে পলাশিয়া ১২ কিলোমিটার বাসে গিয়ে, গ্রামের পথে তিন কিলোমিটার গিয়ে রয়েছে সহস্রলিঙ্গের মন্দির। কিংবদন্তী বাদ দিয়ে, বাস্তবে কিন্তু শিবলিঙ্গটি অদ্ভুত আকারের। সচারাচর এমন শিবলিঙ্গ দেখতে পাওয়া যায় না। বৃহৎ লিঙ্গটির গায়ে দশটি থাক। প্রতিটি থাকে ১০০টা করে ছোট লিঙ্গ। এভাবে দশটা থাকে একহাজার লিঙ্গ আছে। তাই নাম সহস্রলিঙ্গ। এই শিবের অধিষ্ঠান পঞ্চরথ শিখর দেউলের মধ্যে। এটা একটা উল্লেখযোগ্য পুরাকীর্তি। ওড়িশার প্রায় সীমারেখায় গ্রামটি। তাই মন্দিরে ওড়িশি স্থাপত্যের ছাপ আছে। মন্দিরটি মাকড়া পাথরে নির্মিত। মাথার কাছে আমলকি, কলস ও ত্রিশূল রয়েছে। মন্দিরের সামনে একটা বৃষের মন্দির ও দক্ষিণে ঠাকুরের একটা কূপ আছে। এই মন্দিরের কোনও প্রতিষ্ঠালিপি নেই তবে আকারে প্রকারে খ্রিস্টিয় ষোল শতাব্দীতে নির্মিত বলে অনুমান।
নয়াগ্রাম থানার উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্য রামেশ্বরনাথের মন্দির। নয়াগ্রাম থেকে গোপীবল্লভপুর যাওয়ার পথে চাঁদাবিলা বাস স্টপ। এখান থেকে জঙ্গলের পথে নানা গ্রাম পেরিয়ে আট কিলোমিটার দূরে সুবর্ণরেখার ধারে অবস্থিত রামেশ্বর মন্দির। সপ্তরথ শিখর দেউলটা মাবাড়া পাথরে নির্মিত। ওড়িশি শৈলির ছাপ রয়েছে। মন্দির ঘিরে বিশাল ঝামাপাথরের বাঁধানো চত্বর। চারিদিকে ফাঁকা, ধূ ধূ করছে আশপাশ, তার মধ্যে অনেকটা এলাকা জুড়ে গর্ভমন্দির, ভোগমণ্ডপ, নাটমন্দির নিয়ে তিরিশ ফুট উচ্চতার মন্দিরটা বিরাজ করছে।
এই মন্দিরকে ঘিরে লোকমুখে একটা গল্প ঘোরে। বনবাসের সময় রামচন্দ্র, সীতাদেবি ও লক্ষ্মণকে নিয়ে এখানে এসেছিলেন। এর মধ্যে শিবরাত্রি এসে পড়লে সীতাদেবী সুবর্ণরেখার বালি দিয়ে বারোটা শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন। পুজোর পরে এই দ্বাদশ শিবলিঙ্গ নদীর জলে ভাসাতে গেলে দৈববাণী শোনা যায়। ফলে রামচন্দ্র এখানে বিশ্বকর্মাকে দিয়ে মন্দির তৈরি করে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন। রামচন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত, তাই এই মন্দিরের নাম হয় রামেশ্বর।
বাস্তবে কোন সময়ে, কে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা জানা না গেলেও মন্দিরটা যে বেশ প্রাচীন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। মন্দিরের নির্মাণ চাতুর্য এমনই, যে গর্ভ মন্দিরে কোনও জানলা না থাকা সত্ত্বেও তিনটে অঙ্গনের দরজা সমান্তরাল থাকায় সূর্যোদয় হলেই গর্ভমন্দিরে আলো ঢুকে এসে শিবলিঙ্গকে আলোকিত করে তোলে। শিবরাত্রির সময়ে এখানে বিরাট মেলা বসে। শিবরাত্রির ভিড় এড়িয়ে এলে এই জায়গার মনোরম পরিবেশের আস্বাদ দেওয়া যায়। এই জায়গাটা বিকেলের মধ্যেই ঘুরে নেওয়া উচিত।
রামেশ্বর মন্দির থেকে তিন কিলোমিটার দূরে দক্ষিণে সুবর্ণরেখা নদীর ধারে গভীর জঙ্গলের মধ্যে রয়েছে অপরূপ সুন্দর এক জায়গা– তপোবন। এমনিতেই অপরূপ এই জঙ্গল। তার মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে একটা সরু খাল। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এখানেই নাকি মহর্ষি বাল্মীকির তপোবন ছিল। এখানেই নাকি সীতাদেবী যমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। এখানে রয়েছে বেশ কিছু উইয়ের ঢিপি। বাল্মীকির সমাধির পাশে সীতার আঁতুড়ঘরও আছে। এখানে বেশ কয়েকটা মাটির কুটির আছে। কয়েক জন সন্ন্যাসীও থাকেন। তাঁরা এক একটা কুটির দেখিয়ে এক এক রকম ব্যাখ্যা দেন। একটা অখণ্ড ধুনি জ্বলছে। তাতে কাঠ দেওয়ার রীতি আছে। তপোবনের আশপাশের গ্রামগুলোয় লোধারা থাকেন। গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তপোবনে পৌঁছোনোর অভিজ্ঞতা বেশ রোমাঞ্চকর। তপোবনে বাল্মীকির আশ্রম পর্যন্ত গাড়িতে যাওয়া যায়। তবে নিজস্ব বা ভাড়া গাড়িতে করে আসা ছাড়া এ পথে কোনও যানবাহন নেই। গাড়ির ব্যবস্থা না থাকলে হাঁটতে হবে।
সব মিলিয়ে নয়াগ্রাম থানা এলাকায় ঘুরে বেড়াতে বেশ রোমাঞ্চ হয়। কলকাতা থেকে ঝাড়গ্রাম হয়ে বাসে নয়াগ্রাম আসা যায়। আবার খড়্গপুর থেকে কোশিয়ারি হয়ে ভসরাঘাট পেরিয়ে এখানে আসা যায়। নিজস্ব গাড়ি থাকলে কলকাতা থেকে উইকএন্ডে খড়্গপুর থেকে কোশিয়ারি হয়ে সুবর্ণরেখা পেরিয়ে নয়াগ্রাম আসা সব চেয়ে সুবিধে।
থাকার জন্য নয়াগ্রাম বনবাংলো রয়েছে। তার বুকিং-এর ঠিকানা-– আঞ্চলিক বনাধিকারিক, ঝাড়গ্রাম। দূরভাষ-– ০৩২২১-২৫৫০১০। আর আছে নয়াগ্রাম পঞ্চায়েত সমিতির লজ, আরণ্যক। বুকিং পঞ্চায়েত সমিতি অফিস, নয়াগ্রাম – দূরভাষ – ০৩২২৩-২৫৭২০৬। এবং নয়াগ্রামের খড়িকামাথানিতে রয়েছে অভিষেক হোটেল। চলভাষ – ৯৯৩২৮২৫৯৮০।
শক্তিপদ ভট্টাচার্য্য : শিক্ষকতার কাজের মাঝে সময় খুঁজে বেরিয়ে পড়েন কাঁধে ঝোলা নিয়ে। ভ্রামণিকদের জন্য গড়ে তুলেছেন “ভ্রমণ আড্ডা ” নামে একটি সংস্থা। একই নামে প্রকাশ করেন একটি পত্রিকাও। পর্যটকদের কাছে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত জেলার হালহদিস তুলে ধরতে ক্রমান্বয়ে লিখে চলছেন “পায়ে পায়ে জেলা ভ্রমণ গ্রন্থমালা “, যার দশটি খণ্ড ইতিমধ্যেই প্রকাশিত।
রত্না ভট্টাচার্য্য : সহধর্মিণী হিসেবে শক্তিপদ ভট্টাচার্য্যর সমস্ত ভ্রমণের সঙ্গীই শুধু নন, “পায়ে পায়ে জেলা ভ্রমণ গ্রন্থমালা “-র অন্যতম লেখক। “ভ্রমণ আড্ডা ” সংস্থার সহযোগী সম্পাদক।