বেনোজল পানের অযোগ্য স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর

বেনোজল আসতেই থাকবে। বেনোজল পানের অযোগ্য স্বাস্থ্যের পক্ষেও ক্ষতিকর। পাকাপাকিভাবে বেনোজল আটকাতে না পারলে বিজেপির নীতি আদর্শ— সব একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে অথৈ বন্যায়।
তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক মনিরুল ইসলাম বিজেপিতে যোগ দেবার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় বয়ে গেছে। যারা প্রতিবাদ করেছেন তাদের বেশিরভাগেরই অভিযোগ মূলত তিনটে। (১) মনিরুল সাম্প্রদায়িক বিভেদের রাজনীতি করেন। (২) ব্যক্তিগত এবং দলীয় স্বার্থে তিনি খুন ধর্ষণ অপহরণ— সব কিছুই করতে পারেন এবং তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তাই করে এসেছেন। (৩) মনিরুল ইসলাম বিজেপিতে থাকলে বীরভূমে বিজেপি শেষ হয়ে যাবে। কারণ, এই মনিরুলদের বিরুদ্ধে লড়াই করেই বীরভূমে দুধকুমার মণ্ডলের মতো নেতা উঠে এসেছেন। এখন যদি দুধকুমারের পাশে মনিরুলকে দেখা যায় তাহলে মানুষ কিছুতেই এই সোনার পাথরবাটি-মার্কা সমীকরণ মেনে নেবে না।
বলা বাহুল্য, তিনটি অভিযোগই সত্যি। মনিরুল কোনওদিনই সভ্যভব্য রাজনীতিকদের দলে পড়েন না। কথাবার্তা যা বলেন তার অধিকাংশই শালীনতার সীমা অতিক্রম করে যায়। তবে মনিরুলের অগাধ গুণপনার নিরিখে এই দুটি অভিযোগ নিতান্তই শিশুসুলভ। বস্তুত, বীরভূমের লাভপুরে যারা তৃণমূল-বিরোধী রাজনীতি করেন, মনিরুলকে তাদের থেকে ভালো কেউ চেনে না। কত বিজেপি কর্মী যে তার পোষা গুন্ডাদের হাতে মার খেয়েছেন তার কোনও হিসেব নেই। এইসব কর্মী যারা এতদিন মার খেয়েছেন, প্রাণ হাতে করে লাভপুর তথা গোটা বীরভূমে বিজেপিকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন তারা যদিহঠাৎ শোনেন মনিরুল তাদের নেতাতাহলে তার থেকে দুর্ভাগ্যজনক কিছু হয় না। স্বাভাবিক ভাবেই তারা এই অমানবিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছেন। ক্ষুব্ধ হয়েছেন সাধারণ মানুষও। বিশেষ করে হিন্দুরা। কারণ এতকাল তারা নানা সময়ে মনিরুলের আশ্রিত মুসলমান দুষ্কৃতীদের অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। তাদের। ঘরবাড়ি পুড়েছে। লুণ্ঠিত হয়েছে ধনসম্পদ। স্ত্রী-কন্যারা ধর্ষিত হয়েছেন। হঠাৎ ভোল পালটানো মনিরুলকে বিজেপিতে দেখে তাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, এ কোন বিজেপি? রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের আচরিত মূল্যবোধের সঙ্গে এই বিজেপির কোনও সম্পর্ক কি আছে?
যাই হোক, প্রবল চাপের মুখে পড়ে মনিরুল ইসলাম ইস্তফা দিয়েছেন। না দিলে ভবিষ্যতে রাজনীতিতে মূল্যবোধ বলে জিনিসটা আদৌ থাকবে কিনা তাই নিয়ে বড়োসড়ো প্রশ্নচিহ্ন উঠে যেতো। তবে অন্য একটি প্রশ্ন ইতিমধ্যেই উঠেছে। মনিরুল ইসলামের অতীত সম্বন্ধে বিজেপি রাজ্য-নেতৃত্ব কিছু জানতেন না, এটা হতে পারে না। তাহলে তাকে দলে কেন নিলেন? তারা কি বোঝেননি, মনিরুলের মতো লোকের সংখ্যা দলে যত বাড়বে বিজেপি ততই গড়পড়তা রাজনৈতিক দলে পরিণত হবে? কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির আর কোনও পার্থক্যই থাকবে না। যে নীতি ও আদর্শের রূপায়ণের জন্য বিজেপির সৃষ্টি, তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে। এসব কথা বিজেপির রাজ্য-নেতৃত্ব অবশ্যই জানতেন। তবুও এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।
একে কি বলব, সাময়িক পদস্খলন ? যাই বলি, এর পিছনে রয়েছে একাধিক কারণ। আজকের রাজনীতি থেকে বিপণনকে বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। কমবেশি সব দলই হাই-টেক বিপণনের সাহায্য নেয়। কিন্তু লক্ষ্য রাখা দরকার এই বিপণন যেন সংশ্লিষ্ট দলটির নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে করা হয়। কারণ বিপণন যদি কেবলমাত্র টার্গেট অভিমুখী হয় তাহলে যে-কোনও মূল্যে ভোটে জেতার বাসনা জাগতে বাধ্য। আর যেন তেন প্রকারে ভোটে জেতা মুখ্য হয়ে উঠলে কাকে দলে নেওয়া হবে আর কাকে হবে না— সেইবিচারবোধ হারিয়ে যাবারই কথা। নেতা দাগী হোক দাঙ্গাবাজ হোক, হাতে নাতে ফল দেওয়ার ক্ষমতা থাকলে তাকে মালা পরিয়ে বরণ করে নিতে আর কোনও বাধা থাকে না।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, মনিরুল ইসলাম কি হাতেনাতে ফল দেওয়ার মতো নেতা? এখন ততটা না হলেও এক সময়ে ছিলেন। তার হাতে লাভপুরের দেড় লক্ষ মুসলমান ভোট। অন্তত লাভপুরের হিসেব উল্টে দেবার ক্ষমতা তিনি ধরেন। কিন্তু এই সামান্য প্রাপ্তির জন্য বিজেপি এত বড়ো ঝুঁকি নিয়েছে, বিশ্বাস হয় না। মনিরুলকে দলে নেওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে বীরভূমে অনুব্রতমণ্ডলকে দুর্বল করা। এক সময় মনিরুল ছিলেন অনুব্রতর ডান হাত। বস্তুত, যাদের পেশিশক্তির জোরে অনুব্রতর আজকের বাড়বাড়ন্ত মনিরুল তাদের অন্যতম। কিন্তু দুই হুজুরের সেই গাঁটছড়া তো এখন আর নেই। এবং সেটা সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে বোঝাও গিয়েছে। অনুব্রত একাই শতাব্দী রায়কে জিতিয়ে এনেছেন। তাহলে একজন হিন্দুবিদ্বেষী খুনির মাথায় ছাতা ধরার এই আদেখলাপনা কেন? বিজেপি কি অনুব্রতের স্টাইলে বাঙ্গলায় ক্ষমতায় আসতে চাইছে ? বিজেপির রাজ্য-নেতৃত্ব তাদের ভুল বুঝতে পেরেছেন। এটাই সব থেকে বড়ো কথা। তবে বেনোজল কিন্তু আসতেই থাকবে। বেনোজল পানের অযোগ্য স্বাস্থ্যের পক্ষেও ক্ষতিকর। পাকাপাকি ভাবে বেনোজল আটকাতে না পারলে বিজেপির নীতি আদর্শ—সব একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে অথৈ বন্যায়।
সন্দীপ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.