খবরের শিরোনামে জুনিয়ার ডাক্তাররা। টানা আন্দোলন চালাচ্ছেন তাঁরা। এখন তাঁদের পক্ষে, বিপক্ষে দু’ভাগ সমাজ। কোন দিকের পাল্লা ভারী সে হিসেব না করে বরং দেখে নেওয়া যাক, হাসপাতাল পরিচালনার ক্ষেত্রে ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এই জুনিয়ার ডাক্তাররা।
জুনিয়র ডাক্তারদের দাবির সমর্থনে এখন অন্দোলনে অংশ নিয়েছেন প্রায় গোটা চিকিৎসক সমাজ। সিনিয়র ডাক্তাররাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। এর কারণ বলতে গিয়ে এক সিনিয়র চিকিৎসকের বক্তব্য, “মনে রাখতে হবে হাসপাতাল পরিচালনার জন্য সিনিয়রদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেন জুনিয়ররা। তাঁদের ছাড়া একটা দিন তো দূরের কথা, একটা মুহূর্তও হাসপাতাল চালানো সম্ভব নয়। দিন রাত এক করে কাজ করতে হয় জুনিয়রদের।”
প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক কারা জুনিয়র চিকিৎসক।
যাঁরা এমবিবিএস পড়ছেন তাঁরাই মূলত জুনিয়র ডাক্তার। হাতে কলমে শিক্ষার জন্যই তাঁরা ডিগ্রি পাওয়ার আগেই কাজে যোগ দেন। প্রতিটি হাসপাতালে এক দিনের জন্য একটি করে চিকিৎসকের ইউনিট তৈরি হয়। একটি ইউনিটে চার থেকে পাঁচ জন জুনিয়র ডাক্তার থাকেন। সেই দলে থাকেন আরও চার-পাঁচ জন পোস্ট গ্ৰ্যাজুয়েট ট্রেনি। এঁরা এমবিবিএস পাশ করার পরে এমডি বা অন্য ডিগ্রির জন্য পড়াশোনা করছেন। একটি ইউনিটে এ ছাড়াও থাকেন একজন হাউস-স্টাফ। এখন মেডিক্যাল পড়ুয়াদের হাউস-স্টাফ হিসেবে পরিষেবা দেওয়াটা বাধ্যতামূলক নয়। তবে অনেকেই এক বছরের জন্য এই পদে থেকে কাজ করেন। এর সঙ্গে থাকেন একজন আরএমও। তিনি কিন্তু পাশ করা চিকিৎসক। বেতন পান।
কতটা চাপ নিতে হয় জুনিয়র চিকিৎসকদের?
সপ্তাহে ছ’দিন তো বটেই কখনও কখনও রবিবারেও হাসপাতালে কাজ করতে হয় জুনিয়র ডাক্তারদের। জেনে নিন জুনিয়র ডাক্তারদের থেকে শোনা তাঁদের রোজনামচা।
সকাল ন’টা নাগাদ যেতে হয় বিভিন্ন ওয়ার্ডে। একটি ইউনিট এক একটি ওয়ার্ড ঘুরে দেখে নেন ভর্তি থাকা রোগীরা কেমন রয়েছেন। কোন রোগীর কোন টেস্ট করা দরকার তার নির্দেশ দেওয়া থেকে কারও ডায়েট বদল করা হবে কিনা সেসবও দেখতে হয়। এর সঙ্গেই কোনও সিনিয়র চিকিৎসক ওয়ার্ডে এলে তাঁকে সঙ্গ দিতে হয়। ঘুরে ঘুরে দেখতে হয়, কোনও রোগীর ওষুধে কোনও বদল হয় কিনা। সেই সময়ে কারও প্রেশার মাপা, কারও ক্যাথিটার লাগানো বা খোলা এই সব কাজও করতে হয় জুনিয়র চিকিৎসকদের।
এর পরে সোজা চলে যেতে হয় আউটডোরে। সকাল ১০টা থেকে আউটডোরে রোগী দেখা শুরু। জুনিয়র চিকিৎসকরাই প্রথমিক ভাবে রোগী দেখেন। কোনও রোগীকে ক্রিটিক্যাল মনে হলে তাঁরা পাঠান পিজিটি-র কাছে। আবার পিজিটিরা মনে করলে তাঁরা পাঠান সিনিয়র চিকিৎসকদের কাছে। একদিনে একটি ইউনিটকে ৩০০ থেকে ৫০০ পর্যন্ত রোগী দেখতে হয়।
এ সবের পাশাপাশি চলতে থাকে জরুরি বিভাগের রোগী দেখা। সেখানে ছোট খাট সার্জারি থেকে ড্রেসিং, সাধারণ জ্বর, পেট ব্যাথা থেকে ক্রিটিক্যাল পেশেন্ট সবই অ্যাটেন্ড করতে হয়। কাউকে ওষুধ দেওয়া তো কারও ভর্তির ব্যবস্থা করা, সবেরই প্রাথমিক দায়িত্ব জুনিয়র চিকিৎসকদের।
আউটডোর বন্ধ হলে খাওয়া। খেয়েই চলে যেতে হয় ওয়ার্ডে। আউটডোর থেকে যে সব রোগীকে ভর্তি নেওয়া হয়েছে তাঁদের খোঁজ নিতে যেতে হয়। স্যালাইন থেকে অক্সিজেন চালু হলে তার ব্যবস্থা করা, কী কী টেস্ট হবে তার নির্দেশ দেওয়া, ডায়েট ঠিক করা সবই করতে হয় জুনিয়র চিকিৎসকদের।
গোটা দিনের শেষেও ছুটি নেই। ফের বসতে হয় ইমার্জন্সিতে। সারা রাত চলে পেশেন্ট দেখা। কলকাতা-সহ রাজ্যের সরকারি হাসপাতালের যা ছবি তাতে গোটা রাতই চলে রোগী আসা। আর রাতের রোগী মানে সবই সিরিয়াস কন্ডিশনের।
পরদিন সকাল আটটায় নতুন ইউনিট দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত চলে ইমার্জেন্সি সামলানোর চাপ। নতুন ইউনিটকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেই কাজ শেষ নয়। সঙ্গে সঙ্গে চলে যেতে হয় ওয়ার্ডে। রাতে যেসব রোগী ভর্তি হয়েছেন তাঁদের দেখভাল করতে হবে। মনে রাখতে হবে হাসপাতালে জুনিয়র চিকিৎসকদের নিজস্ব কোনও বেড থাকে না। বিভিন্ন সিনিয়র চিকিৎসকের বেডেই তাঁরা রোগী ভর্তি করান। এ বার বিভিন্ন বেডের সংশ্লিষ্ট সিনিয়র চিকিৎসক ওয়ার্ডে রাউন্ডে এলে অবশ্যই সঙ্গ দিতে হয় জুনিয়রদেরও। দেখে নিতে হয় প্রাথমিক ভাবে যে চিকিৎসা তিনি শুরু করেছেন তা কতটা ঠিক, কী কী বদল হচ্ছে, আরও কী কী টেস্ট করা দরকার ইত্যাদি।
চিকিৎসক চলে গেলে তাঁর নির্দেশ মতো ব্যবস্থা করতে হয় জুনিয়র ডাক্তারদের। প্রয়োজনীয় পরীক্ষার ব্যবস্থা থেকে চিকিৎসা শুরু করার দায়িত্ব তাঁদের। বিকেলে রোগীদের রক্ত ইত্যাদি পরীক্ষার রিপোর্ট দেখা এবং সেই মতো প্রেসক্রিপশনে পরিবর্তন করা পর্যন্ত চলে টানা দায়িত্ব। সব মিলিয়ে এক একটি ইউনিট ৩৬ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করে বলে দাবি কাজের বিবরণ দেওয়া জুনিয়র চিকিৎসকদের। তাঁরা আরও জানিয়েছেন, রোটেশনের ভিত্তিতে রবিবারেও হাসপাতাল সামলাতে হয় জুনিয়র চিকিৎসকদের।
জুনিয়র চিকিৎসকদের কোর্সের নিয়ম মতো সব কাজই শিখতে হয়। তার জন্য ইন্টার্ন থাকার সময়ে তিন মাস করে মেডিসিন, সার্জারি ও গাইনি তিন বিভাগেই কাজ করতে হয়।
কত টাকা স্টাইপেন্ড পান জুনিয়র চিকিৎসকরা?
পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনিরা স্টাইপেন্ড হিসেবে মাসে মোটামুটি হাতে পান ৫০ হাজার টাকা। আর ইন্টার্নরা পান ২৫ হাজার টাকার মতো।