রাস উৎসবে মেতে উঠলেন শান্তিপুরের মানুষ। কত গল্প, কিংবদন্তী ঘিরে রয়েছে এই রাসকে ঘিরে। আজও শান্তিপুরের মানুষ সচেতনভাবে বিশ্বাস করেন তার অনেকখানি। ছোট থেকে লালিত কিছু আবার রয়ে গেছে অবচেতনে।
কার্তিক পূর্ণিমায় যে রাস হত, তাতে নাকি পুরুষ হিসেবে একমাত্র অংশগ্রহণ ছিল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের। তিনিই মাতিয়ে রাখতেন হাজার নারীকে। একবার দেবাদিদেব মহাদেবের ইচ্ছে হয় রাস দর্শনের। দেখতে ইচ্ছে হয়, কী এমন আকর্ষণ শ্রীকৃষ্ণের, যে এত মহিলা কেবল তাঁর টানে ছুটে যাচ্ছেন। ছদ্মবেশে রাস অঙ্গনে মহাদেবকে ঢুকতে দেখে লজ্জায় সেই অঙ্গন ছাড়েন শ্রীকৃষ্ণ। তখন গোপিনীরা আবিষ্কার করেছিলেন মহাদেবকে।
তাঁর জন্যই ছন্দপতন হয়েছিল। তৎক্ষণাৎ যোগমায়া তাঁকে ভৎর্সনা করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন রাস অঙ্গন থেকে। চলে যাওয়ার সময় মহাদেব নাকি বলে গেছিলেন, ‘‘আজকে আমি চলে যাচ্ছি ঠিকই কিন্তু কলিতে আমি এই রাস দেখিয়েই ছাড়বো।’’
পনেরোশো শতকে বৈষ্ণব ধর্মবেত্তা শ্রী শ্রী অদ্বৈতাচার্যের আবির্ভাবের পর তাঁকেই মহাদেবের অবতার হিসেবে মেনেছিলেন গোটা শান্তিপুরের মানুষ। কার্তিক পূর্ণিমায় নিজের আসনের নারায়ণকে বিশেষ পুজো করেছিলেন অদ্বৈতাচার্য । শান্তিপুরের বড় গোস্বামীবাড়ির আদি পুরুষও এই অদ্বৈতাচার্যই। তাঁর পৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর পুত্র রাঘবেন্দ্র গোস্বামী, বড় গোস্বামী বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা।
কথিত, যশোর থেকে কৃষ্ণমূর্তি নিয়ে এসেছিলেন মথুরেশ গোস্বামী। সেই রাধারমণকে নিয়েই মেতে ছিল গোটা বড় গোস্বামী পরিবার। একদিন আসন থেকে হঠাৎই অন্তর্হিত হয়েছিলেন রাধারমন। বিগ্রহ ফিরে পেতে গোস্বামী বাড়ির সদস্যরা কাত্যায়নী ব্রত শুরু করলে, দেবীর স্বপ্নাদেশে দিগনগরের একটি জলাশয় থেকে উদ্ধার হয় বিগ্রহ।
তখন বড় গোস্বামী বাড়ির সদস্যরা চিন্তা করলেন যে শ্রীকৃষ্ণ একা আছেন বলেই হয়তো অন্তর্হিত হচ্ছেন। তাঁর পাশে রাধিকা মূর্তি দরকার। যেই ভাবা,সাই কাজ। ৩৮ কেজি ওজনের একটা রাধিকা মূর্তি নির্মাণ করা হল। কিন্তু সেই রাধিকার সাথে কৃষ্ণের মিলন হবে কোন তিথিতে? তারপর চিন্তা ভাবনা করে রাস পূর্ণিমাতেই দিন স্থির হয়। রাধারমণের পাশে রাধারানিকে প্রতিষ্ঠা করলেন তৎকালীন প্রভুপাদরা। সেই শুরু শান্তিপুরে জাঁকজমকের রাস। শুধু গোস্বামী বাড়ি নয়, গোটা শান্তিপুরের মানুষকে দর্শন করানোর জন্য যুগল মূর্তিকে রঙিন বস্ত্র ও অলঙ্কারের সাজিয়ে বের করা হয় শোভাযাত্রা। ভাঙা রাসের সেই শুরু।
মঙ্গলবার থেকে শুরু হল রাস উৎসব। দু’দিন পরে ভাঙা রাস। ঐতিহ্য তো ছিলই, এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানান থিমের জৌলুস। আজ থেকে টানা তিন দিন লক্ষ লক্ষ মানুষ মেতে উঠবেন এই রাস উৎসবে। এখনও বড় গোস্বামী বাড়ির রাস শান্তিপুরের বিশেষ আকর্ষণ। সারা দেশ থেকে তো বটেই, বিদেশ থেকেও প্রচুর ভক্ত বড় গোস্বামী বাড়িতে আসেন রাসের টানে। অন্যান্য বাড়িগুলির মধ্যে ছোট গোস্বামী বাড়ি, পাগলা গোস্বামী, মদন গোপাল গোস্বামী, পাতাবুনিয়া গোস্বামী এই সমস্ত বাড়ি রাসও আভিজাত্যের অটুট। অন্যান্য পরিবারগুলির মধ্যে নন্দবাড়ি, বংশীধারী ঠাকুর বাড়ি, মঠবাড়ি, রায়বাড়ি গোপীনাথ জিউর ঠাকুরবাড়ির রাসও আকর্ষণীয়। সব মিলিয়ে উৎসবমুখর গোটা শান্তিপুর।