নেতাজি সুভাষচন্দ্র (Netaji Subhash Chandra) ও তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজ ব্রিটিশ শাসনের ভিত কীভাবে নড়িয়ে দিয়েছিল, তা নিয়ে প্রায়শই আলোচনায় সরগরম হতে দেখা যায়৷ তখন কেন যেন উপেক্ষিত মনে হচ্ছে আর এক দেশনেতা রাসবিহারী বসুকে (Rasbihari Basu) ৷ মনে রাখা উচিত, আজাদ হিন্দ ফৌজ কিন্তু সুভাষচন্দ্র গঠন করেননি, করেছিলেন রাসবিহারী বসু৷ তাঁরই তৈরি করা ভিতের উপর পরবর্তীকালে লড়েছিলেন নেতাজি৷
১৮৮৬ সালের ২৫মে রাসবিহারী বসুর জন্ম বর্ধমানের সুবলদহ গ্রামে। পিতা বিনোদবিহারী বসুর কর্মক্ষেত্র হুগলী জেলারর চন্দননগরে তিনি শিক্ষালাভ করেন।
ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু জাপানে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছিলেন আজ থেকে ১০০ বছর আগে ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মীয় সেজে পিএন ঠাকুর নামে। কত যে নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে তার প্রবাসজীবনে যা বাঙালি জানে না বললেই চলে! তিনিই কি প্রথম বাঙালি যিনি জাপানে প্রথম বিয়ে করেছিলেন জাপানি নারীকে? তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল তোশিকো বসু। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি জাপানের মাটিতে প্রথম ভারতীয় কারিকে পরিচিত করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘ইনদো নো মোন’ বা ‘ভারতীয় তোরণ’ নামে রেস্টুরেন্টে এবং এটাই প্রথম ভারতীয় রেস্টুরেন্ট জাপানে। তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি জাপানে প্রথম ‘এশিয়া’ নামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছিলেন।
রাসবিহারী বসুই সেই বাঙালি যিনি বহু কাঠখড় পুড়িয়ে জাপানের সামরিক সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রী জেনারেল তোজো হিদেকিকে বশ করে জার্মানিতে পলাতক সুভাষচন্দ্র বসুকে জাপানে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তরান্বিত হয়েছিল ভারতীয় স্বাধীনতার লড়াই। ‘নেতাজি’ উপাধিটি তিনিই দিয়েছিলেন বলে কোনো কোনো জাপানি লেখকের গ্রন্থে জানতে পারি।
আজকাল প্রায়ই রাতে ঘুম আসে না মেয়েটির। জানালার পাশে বসে তাকিয়ে থাকে দূরে। এলোমেলো চিন্তা ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়তে থাকে মনে।
গত দেড় মাসে বাড়ির পরিবেশ আমূল বদলে গিয়েছে। চারদিকে একটা চাপা আতঙ্ক! মা-বাবা তো বটেই, দোকানের প্রতিটি কর্মচারীও কেমন সন্ত্রস্ত। সব কিছুর কারণ সেই ভারতীয় বিপ্লবী। দেড় মাসের বেশি যিনি আত্মগোপন করে রয়েছেন বাড়ির পিছনে রুটি কারখানার পরিত্যক্ত গুদামঘরে। সাদা পোশাকের গোয়েন্দারা সর্বক্ষণ ওত পেতে আছে আশেপাশে। ধরা পড়লেই পরিবারের এত দিনের সম্মান, তিল-তিল করে গড়ে তোলা ব্যবসা ধুলোয় মিশতে সময় নেবে না। জাপান থেকে কত দূরের পথ ভারতবর্ষ! সেখানকার এক তরুণ বাঙালি বিপ্লবীর সঙ্গে সিঞ্জিকু শহরের সম্ভ্রান্ত সোমা পরিবারের ভাগ্য যে এ ভাবে জড়িয়ে যাবে, কল্পনাও করেননি পরিবারের বড় মেয়ে, সদ্য কুড়ির তোশিকো।
বাবা-মা আইজো সোমা আর কোকো সোমা বিখ্যাত ‘নাকামুরায়া’ স্টোরের মালিক। জাপানের জনপ্রিয় বেকারি নাকামুরায়ার কেক, বিস্কুট, রুটি কিনতে ভিড় করেন টোকিয়োর ‘এলিট’ লোকজন। এ হেন পরিবারের সঙ্গে কোনও বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীর সম্পর্ক থাকার কথা নয়। কিন্তু আশ্চর্য সব ঘটনা তো এই পৃথিবীতেই ঘটে।
বার কয়েক সেই বিপ্লবীকে দূর থেকে দেখেছেন তিনি। নাম রাসবিহারী বসু। স্বাস্থ্যবান, সুঠাম যুবা। চওড়া, দৃঢ় চোয়াল। দৃপ্ত দুই চোখ। মানুষটাকে দেখে বুক শিরশির করেছে তোশিকোর। জাপানিরাও দেশভক্ত, স্বাধীনতাপ্রিয়। পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করার তাগিদ তাঁদেরও মজ্জাগত। এই যুবকটি তিন মাস জাহাজে ভেসে, মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে অচেনা দেশে এসেছেন নিজের দেশের স্বাধীনতার লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন বলে। ব্রিটিশ শাসককে ঘোল খাইয়ে ছাড়ছেন। তোশিকো মনে মনে শ্রদ্ধা করেছেন মানুষটিকে। আর ভাল লাগা? শিক্ষিতা, অন্তর্মুখী জাপানি তরুণী এর থেকে তেমন কোনও ভাবনাকে প্রশ্রয় দিতে চাননি। তবু মন উচাটন। হঠাৎ হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে ওঠে তাঁর মুখ।
নামলেন কোবে বন্দরে। সেটা ১৯১৫ সালের জুন মাস। হাতে নামমাত্র টাকা, বন্ধু নেই। কোবে থেকে গেলেন টোকিয়ো। সেখানেই পরিচয় এক তরুণ চিনা বিপ্লবীর সঙ্গে। তিনিই পরবর্তী কালের বিশ্ববরেণ্য বিপ্লবী সান ইয়াৎ সেন। আলাপ হল সামুরাই নেতা মিৎসুরু তোয়ামার সঙ্গে। সন্তানস্নেহে তিনি কাছে টেনে নিয়েছিলেন রাসবিহারীকে। ২৭ নভেম্বর টোকিয়োতে লালা লাজপত রায়ের সঙ্গে সভা করলেন। খবর গেল ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের কাছে। তার পরই ব্রিটিশ সরকারের চাপে জাপান মারফৎ জারি হল নির্বাসনের আদেশ। তোয়ামার অনুরোধে রাসবিহারীকে বাঁচাতে আশ্রয় দিতে রাজি হলেন বেকারি মালিক আইজো ও কোকো সোমা। অল্প দিনের মধ্যেই রাসবিহারী হয়ে উঠলেন তাঁদের ঘরের ছেলে। বাবা আর মা বলে ডাকতেন ওঁদের।
কোকো তাঁর নিজের বইয়ে লিখেছেন— ‘মাস চারেক পর রাসবিহারীর উপর থেকে নির্বাসনদণ্ড উঠে গেল। ১৯১৬-র এপ্রিলের এক সকালে আমার ঘরে বিদায় জানাতে এলেন। তখন আমি শয্যাশায়ী। শরীর ও মনে ধ্বস্ত। রাসবিহারীকে লুকিয়ে রাখতে গিয়ে যে প্রবল মানসিক চাপ সহ্য করতে হয়েছিল তাতে আমার বুকের দুধ শুকিয়ে গিয়েছিল। দুধ না-পেয়ে মারা গিয়েছিল আমার সদ্যোজাত কন্যা। তবু ওই ভারতীয় যুবার প্রতি বিন্দুমাত্র বিতৃষ্ণা আসেনি। উল্টে জানালা দিয়ে তাঁর চলে যাওয়া দেখে কান্না সামলাতে পারিনি। সে দিনই পণ করি, ভারতের আত্মার সঙ্গে যুক্ত হলাম আমরা এবং ভারতের এই বিপ্লবীকে সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করব।’
নাকামুরায়া থেকে বেরিয়ে আজাবু অঞ্চলে বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন রাসবিহারী। যাঁরা তাঁর প্রাণ বাঁচিয়েছেন, তাঁদের সবাইকে এক দিন বাড়িতে নৈশভোজে ডাকলেন। নিজের হাতে ভারতীয় কারি রান্না করেছিলেন, আর সবাইকে অবাক করে একটা ধন্যবাদসূচক বক্তৃতা দিয়েছিলেন জাপানিতে। সেই পার্টিতেই প্রথম মুখোমুখি পরিচয় তোশিকো ও রাসবিহারীর। যদিও কথা হয়নি তেমন।
এর পর বছর তিনেক জাপানের বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়ালেন রাসবিহারী। গোয়েন্দারা লেগে রয়েছে, আস্তানা পাল্টাতে হচ্ছে বারবার। নাকামুরায়ার উপরেও সন্দেহ গাঢ় হয়েছে পুলিশের। সোমা পরিবারের লোকেরা দেখা করতে যেতে পারেন না তাঁর সঙ্গে। যেখানেই বাড়ি নিচ্ছেন, অবিবাহিত, বিদেশি যুবককে পাড়ার লোক সন্দেহের চোখে দেখছে। তাতে গোয়েন্দাদের কাছে খবর যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। বিষয়টি চিন্তায় ফেলল তোয়ামাকে। অনেক ভেবে সমাধান পেলেন। খানিক ইতস্তত করে তা বলেই ফেললেন সোমা দম্পতিকে। তাঁদের বড় মেয়ে তোশিকোর সঙ্গে তিনি বিয়ে দিতে চান রাসবিহারীর। তাতে লোকের সন্দেহ কমবে, পুলিশের নজর এড়ানো যাবে। জাপানি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে রাসবিহারীর জাপানের নাগরিকত্ব পাওয়াও সহজ হবে।
প্রস্তাব শুনে স্তব্ধ হয়েছিলেন আইজো আর কোকো। তোশিকো তাঁদের আদরের মেয়ে, শিক্ষা, স্বভাব, রূপ— কোনও দিকেই কমতি নেই। জাপানের সেরা পাত্রদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যাওয়ার কথা তাঁকে বিয়ে করার জন্য। আর তাঁকে কি না তুলে দেবেন পুলিশের তাড়া খেয়ে বেড়ানো, এক কপর্দকশূন্য বিদেশি বিপ্লবীর হাতে! যে কোনও মুহূর্তে পুলিশের গুলিতে যাঁর মৃত্যু হতে পারে! বেঁচে থাকলেও পালিয়ে, লুকিয়ে বেড়াতে হবে! আবার রক্ষণশীল জাপানি সমাজে ভিন জাতি বা ধর্মে বিয়েতে একঘরে হওয়ারও আশঙ্কা। কিন্তু তোয়ামার প্রস্তাব ফেরানো তাঁদের পক্ষে প্রায় অসাধ্য। আর রাসবিহারীও তাঁদের বড় কাছের। কী এক মায়ায় তাঁদের বেঁধে ফেলেছে এই ভারতীয় ছেলেটি। বাঁচানোর উপায় একটাই— তোশিকো।
এক দিন তোশিকোকে কথাটা বলেই ফেললেন কোকো। প্রতিবাদ, কান্নাকাটি আশা করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে অবাক করে শান্ত তোশিকো মাকে বললেন, ‘‘আমাকে মনস্থির করার জন্য একটু সময় দাও।’’ বিষয়ের গভীরতা বুঝতে ভুল হচ্ছে না তো মেয়েটার? মা তাঁকে এই বিয়ের যাবতীয় সমস্যা বোঝালেন। মেয়ের একই উত্তর, ‘‘আমি ভেবে জানাচ্ছি।’’ তিন সপ্তাহ পরে তোশিকো বললেন, ‘‘আমি মিস্টার বোসকে বিয়ে করতে চাই। তাঁকে রক্ষা করতে চাই। এই সিদ্ধান্ত বদলাবে না।’’ সোমা দম্পতি এ বার রাসবিহারীর কাছে তাঁর মত চান। উত্তর এল, ‘‘বিপ্লব আমার ধ্যানজ্ঞান। বিয়ের কথা কখনও ভাবিনি। আমার যা জীবন তাতে এ সব ভাবার কথাও না। তবে মিস্টার তোয়ামা যদি এটাই চান এবং মিস তোশিকো যদি রাজি থাকেন তা হলে আমি বিয়ে করব।’’
একশো বছর আগে, ১৯১৮-র ৯ জুলাই তোশিকো-রাসবিহারীর গোপন বিয়ের সাক্ষী থাকলেন গুটিকয় মানুষ। জাঁকজমকে যে বিয়ের সাড়া ফেলার কথা, সেখানে বর বা কনে কোনও পক্ষের কোনও আত্মীয়-বন্ধু পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন না। কোকো তখনও শয্যাশায়ী। দোতলা থেকে দেখলেন, অতি সাধারণ পোশাকে তাঁর মেয়ে চলেছেন বাবার হাত ধরে। ট্রেনে চড়ে টোকিয়ো, তোয়ামার বাড়ি। সেখানে তোশিকোর বিয়ের পোশাক কিনে রেখেছিলেন তোয়ামার স্ত্রী। তিনিই সাজালেন কনেকে। অনুষ্ঠানে পিতার ভূমিকায় রইলেন তোয়ামা। তোশিকো সোমা হয়ে উঠলেন তোশিকো বসু। পরবর্তী কালে জাপানে তিনি পরিচিত হয়েছিলেন ‘দ্য লিভিং ফ্লেশ শিল্ড টু দি ইন্ডিয়ান ইন এগজ়াইল’ নামে।
বিয়ের পর শিবা অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় ভাড়াবাড়িতে উঠলেন নবদম্পতি। কিছু দিনের মধ্যেই গোয়েন্দারা টের পেল। শুরু হল বাড়ি বদল। আয়োমা মিনামি মাচি সেখান থেকে আয়োমা তাকাগি মাচি— কোথাও দু’মাস, কোথাও তিন। এমন বাড়ি বাছা হত যেগুলো হয় জঙ্গলের মধ্যে, নয়তো সমুদ্রের পাড়ে বা কাদাজমির ধারে। অধিকাংশ বাড়িতে ভাল করে সূর্যের আলো ঢুকত না। দিনের বেলাতেও অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকত ঘর।
ভিতরে-ভিতরে অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছিলেন রাসবিহারী। তাঁর জীবনের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছেন বলেই না এমন ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন তোশিকো। আর এই জীবনের সঙ্গে জীবন মেলানোটাও হয়তো চাপে পড়ে, বড়দের কথা রাখতে। রাসবিহারী তোশিকোকে ভালবেসেছেন, কিন্তু তাঁর মনের তল পাননি এখনও। এই মেয়ে সব দায়িত্ব পালন করছেন মুখ বুজে। আবেগের বহিঃপ্রকাশেও অতি সংযমী নববধূটি।
তখন তাঁরা চিবায় সমুদ্রের ধারের একটি বাড়িতে। এক দিন প্রশ্নটা করেই ফেললেন রাসবিহারী, ‘‘তুমি আমাকে বিয়ে করেছ, কিন্তু আমায় ভালবেসেছ কি? আমি সত্যিটা জানতে চাই।’’ প্রশ্নের আকস্মিকতায় নিষ্পলকে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকেন তোশিকো। চোখের জল এসে দুই গাল ভিজিয়ে দেয়। অস্থির রাসবিহারী তখন বেপরোয়া, উত্তেজিত। বলছেন, ‘‘বলো, তুমি কি আমার জন্য জীবন দিতে পারো?’’ কথা শেষ না হতেই তিরবেগে খোলা জানালার দিকে ছুটলেন তোশিকো। ঝাঁপ দিতে যাবেন, পিছন থেকে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন রাসবিহারী।
এ এক আশ্চর্য প্রেমকাহিনি। সরল হিসেবে মাত্র আট বছর তার মেয়াদ, কিন্তু তোশিকোর অকালমৃত্যুর পর বাদবাকি জীবন সেই ভালবাসার মধ্যেই থেকেছেন রাসবিহারী বসু। তোশিকোর মা কোকো তাঁকে আবার বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। রাসবিহারী হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘তোশিকো ছাড়া আর কাউকে ভালবাসা আমার পক্ষে এ জীবনে অসম্ভব। সেই আট বছরের নির্জন জীবনের মতো তোশিকো চিরকাল আমার কাছেই থাকবে। আমার আর কিছু চাই না।’’
আট বছরে সতেরো বার বাড়ি বদলাতে হয়েছিল রাসবিহারী-তোশিকোকে। ধরা পড়ার ভয়, সঙ্গে তীব্র অর্থসঙ্কট। কিন্তু কিছুই চিড় ধরাতে পারেনি তাঁদের দাম্পত্যে। রাসবিহারীর জীবনের যাবতীয় ঝড়ঝাপটায় তোশিকোই ছিলেন রক্ষাকবচ। তিনি সংসারের হাল ধরেছিলেন বলেই ভারতের কাজে নিজেকে সঁপে দিতে পেরেছিলেন বীর বিপ্লবী। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন— ‘আওয়ার ম্যারেড লাইফ ওয়াজ ভেরি শর্ট বাট ইট ওয়াজ ব্লিস। আই হ্যাড আ ফিলিং দ্যাট আই এনজয়েড টোটাল হ্যাপিনেস ডিউরিং দোজ ফিউ ইয়ার্স।’ প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুর অনেক বছর পর রাসবিহারীর মৃত্যু হলে টোকিয়োর তামা শ্মশানে তোশিকোর সমাধির উপরেই তৈরি হয়েছিল তাঁর সমাধি।
রাসবিহারী বসু যত্ন করে তোশিকোকে বাংলা শিখিয়েছিলেন। বন্ধু শচীন্দ্রনাথ সান্যালকে ১৯২২-এর জুলাইয়ে টোকিয়ো থেকে পাঠানো চিঠিতে লিখেওছিলেন সে কথা। শুধু তা-ই নয়, খাঁটি বাঙালি ধাঁচে শাড়ি পরাও শিখিয়েছিলেন স্ত্রী আর শাশুড়িকে। শিখিয়েছিলেন বাঙালি রান্না। আট বছরে দুই ছেলেমেয়ের মা হন তোশিকো। ১৯২০-র ১৩ অগস্ট জন্মায় ছেলে মাশাহিদে, যাঁর ভারতীয় নাম ছিল ভারতচন্দ্র (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মাত্র ২৪ বছর বয়সে মারা যান তিনি)। ১৯২২-এর ১৪ ডিসেম্বর জন্ম হয় মেয়ে তেৎসুকো-র।
১৯২৩ সালের ২ জুলাই জাপানের নাগরিকত্ব পান রাসবিহারী। সুন্দর একটা বাড়িতে স্বাধীন জীবন শুরু হয়। তোশিকো সংসার সাজিয়ে বসেন। কিন্তু সেই সুখ স্থায়ী হল না। সেপ্টেম্বরে ভূমিকম্পে বাড়ি ভেঙেচুরে গেল। তীব্র অর্থাভাবে পড়লেন রাসবিহারী। কিছু টাকা পাঠালেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯২৪ সালে টোকিয়োতে তোশিকো-রাসবিহারীর বাড়িতেও গিয়েছিলেন কবি। তত দিনে তোশিকোর শরীর ভেঙে পড়ছে। আট বছরের মানসিক চাপ, রাসবিহারীকে নিয়ে ভয়-আশঙ্কা এবং অমানুষিক শারীরিক পরিশ্রম শোধ তুলতে শুরু করেছিল। যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, সঙ্গে নিউমোনিয়া।
শেষের ক’টা দিন স্ত্রীর বিছানার পাশ থেকে নড়ানো যায়নি রাসবিহারীকে। তাঁর হাতের মধ্যে ধরা থাকত তোশিকোর হাত। ধীর, নিচু গলায় সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ করতেন আর তাঁর সঙ্গে ক্ষীণ কণ্ঠে গলা মেলাতেন তোশিকো। সেই ঘরে সে ক’টা দিন তোশিকোর বাবা-মাও ঢোকেননি। মাত্র ২৮ বছর বয়সে চিরঘুমে তলিয়ে গিয়েছেন তোশিকো বসু।
জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমা (১৯৩১-২০১১) বলেছিলেন, বিপ্লবী রাসবিহারী বসু ছিলেন জাপানে আরেক সূর্যসেন! আজ তার চলে যাওয়ার দিন।
পৃথিবীতে সূর্যসেনরাই সবচে বোকা এবং অবহেলিত!