‘রং দে মোহে কেসরিয়া’ হ্যাঁ, ২৩ মে’র অপরাহ্ন বেলায় এই কেসরিয়া অর্থে গেরুয়া রঙের আস্তরণেই যেন ঢেকে যাচ্ছিল উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গের গ্রামাঞ্চল থেকে মফস্সল শহরগুলি। রাজনৈতিক পরিসরে বাঙ্গালি ব্যতিক্রম ছাড়া লাল বা সবুজ রঙেই আনন্দোল্লাস প্রকাশ করতে অভ্যস্ত। বিকেলের দিক থেকেই পরিষ্কার হয়ে আসছিল লোকসভা নির্বাচনে আবার ভারতীয় জনতা পার্টির অবিসংবাদিত প্রত্যাবর্তনের খবর। পশ্চিমাকাশে তখন গেরুয়া রঙের সূর্য তার অস্তাচল যাত্রায় সঙ্গী করে নিচ্ছিলেন ভারতীয় রাজনীতির কিছু পুঞ্জীভূত ক্লেদ। ভারত-পুরুষ নরেন্দ্র মোদীর বিজয়যাত্রা পথে পতন হচ্ছিল বংশবাদ, জাতিবাদ বা নির্দিষ্ট শ্রেণীর তোষণবাদীদের।
ক’দিন আগেই বুথ ফেরত সমীক্ষায় প্রায় মতৈক্যের সুরেই বিজেপি’র সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার খবর প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছিলেন সমস্ত বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ। মনগড়া গালিগালাজ, ইভিএম কারসাজি-সহ দেশের সমস্ত সম্মাননীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে নাগাড়ে হেয় করে (সুপ্রিম কোর্টের আদেশ থেকে নির্বাচন কমিশনের আচরণ— এর মধ্যে কিছুই বাদ পড়েনি) তারা নির্বাচনী পরিমণ্ডলটিকে আগে থেকেই এমন ঘিনঘিনে ও অরাজক করে তুলেছিলেন যাতে মনে হতে পারে নরেন্দ্র মোদীর সরকার যেন জোচ্চোরের সরকার। তারা ৫ বছর মেয়াদের শর্তে দেশবাসীর ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসেনি। একটি কুৎসিত অপবাদ ততোধিক কুরুচিকর ভাবে জনতার মধ্যে চারিয়ে দেওয়ার ভ্রান্ত সাফল্যকে সঠিক মনে করে টগবগে হয়ে উঠেছিলেন পাকিস্তানপন্থী কংগ্রেসের চিরশিশু নেতা রাহুল গান্ধী। আমাদের এখানেও গালিগালাজে দড় জননেত্রী, এমন আকর্ষক খেউড় সহজেই তুলে নিয়ে নিজস্ব ব্রান্ডের সঙ্গে পাঞ্চ করে পরের দিকের সভাগুলিতে প্রয়োগ করতে থাকেন। চটুল গালিগালাজ গড়পড়তা মানুষকে হয়তো সহজেই সাময়িক আমোদ দেয়। বিশেষ করে তা যদি সর্বোচ্চ নেতা-নেত্রীদের মুখ থেকে আসে। কিন্তু ভারতের দিনে ২০ ঘণ্টা পরিশ্রম করা দেশমগ্ন প্রধানমন্ত্রী ‘চোর’ –এ কথাটি যে সাধারণ মানুষের বুকে ধাক্কা দিয়েছে এই সহজ সত্যটি বোঝেননি প্রধানমন্ত্রী পদলোভী নেতৃকুল। এ প্রসঙ্গে সোনিয়া গান্ধী আবার ২০০৪ সালে বাজপেয়ীর কিছুটা অপ্রত্যাশিত হেরে যাওয়ার পর মাত্র ১৪৫ জনকে নিয়ে ফাঁকতালে কংগ্রেস সরকার গঠনের কথা তুলে ভয় ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি বলেননি যে সেবার দায়িত্বহীন ক্ষমতার স্বাদ পেতে তাঁর পাশে এসেছিল ৬৪ জনের বামবাহিনী। তাদের সাজানো বাগান এখন শুকনো। মৃত বিপ্লবের পথিকেরা অবসৃত। ডিএমকে-র কৃপায় এমন তাঁরা ৫। বাঙ্গলায় শূন্য।
তাজ্জব বনে যাওয়ার কথা যে, শূন্য আসনের অধিকারী উত্তরপ্রদেশের দলিত নেত্রী এক বিষম-জোটের সঙ্গী হয়ে বিভোর হয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রিত্বের স্বপ্নে। নরেন্দ্র মোদীকে জাতি তুলে গালি দিলেন। বললেন মোদী জালি নিম্নবর্গীয়। সন্ধ্যে ৬টায় তার সাংসদ সংখ্যা তখনও ২ অঙ্কে পৌঁছায়নি। দলিত শোষক, কোটি কোটি টাকার নোটের মালা পরতে অভ্যস্ত এই বিলাসী নেত্রীর প্রধানমন্ত্রিত্বের স্বপ্নে তখনই পাকাপাকিভাবে বালি পড়ে গেল এটা ধরে নেওয়া যায়, কেননা তার বয়স এখন ৬৪। এই রে, নরেন্দ্র মোদী তো এই বয়সেই প্রধানমন্ত্রী হয়ে গিয়েছিলেন!
বিগত সংসদে শুধু মাত্র পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ৫ জন সাংসদ রেখে ভারতের মতো সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের পরিসরকে কালিমালিপ্ত করার বিরল গ্লানির অধিকারী মুসলমান তোষক সমাজবাদী দল। তাদের বউমা ডিম্পল, দুই ভাই-ভাতিজা ধর্মেন্দ্র আর অক্ষয় ততক্ষণে বিজেপির কাছে পর্যদুস্ত হয়ে পারিবারিক সম্পত্তিসম সংসদে প্রবেশাধিকার হারিয়েছেন। মোদীজী তার বক্তৃতায় বার বার আম্বেদকর উদ্ধৃত করে বলেছেন গণতন্ত্রের সর্বাপেক্ষা বড়ো শত্রু বংশবাদ। এই নির্বাচনে কোনো কোনো দলে তৃণমূল স্তর থেকে উঠে আসা রাজনৈতিক পরিবারের লোক থাকতে পারে। কিন্তু শুধুমাত্র রক্তের অধিকারে দুর্নীতিগ্রস্ত বংশবাদী প্রতিভূ হরিয়ানার হুডা পরিবার, বংশবাদের দিকপাল– জেলবন্দি লালুর কন্যা মিসা, জেলবন্দি চৌতালা পরিবার, চরণ সিংহের পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। ৮৭ বছর বয়সে আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লালসা যিনি সংবরণ করতে পারেন না সেই দেবেগৌড়াও কর্ণাটকের টুঙ্কুর ও মাণ্ড কেন্দ্রে প্রপৌত্র-সহ ভারতে যথার্থ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নরেন্দ্র মোদীর রথ চক্রে নির্বাচনী বলি হয়েছেন। এঁরা বিধানসভা, সংসদ এগুলিকে জায়গির বানিয়ে ছিলেন। এই ঐতিহাসিক নির্বাচন তাই নৈতিক উত্তরণেরই সাফল্য।
প্রধানমন্ত্রিত্বের ‘সামিটে’ পৌঁছতে আমাদের বাঙ্গলাতে রচিত হচ্ছিল ৪২-এ ৪২-এর দাপুটে ছক। অন্তত ৩৫ পেলেই দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হওয়া যাবে। তখন বাকি আট আনা চার আনা, আনি দু’ আনি সকলকে জুটিয়ে বিজেপির জুজু দেখিয়ে কংগ্রেসকে (ধরে নিয়েছিলেন ১০০ অন্তত পাবে) দাবড়ে বাধ্য করবেন সমর্থন দিতে। বিহারের দিকে একটা চলতি কথা আছে। ‘ঘর ঘোটালা চাচা’র (যিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে যোগাযোগ রাখেন, কখনও কেলেঙ্কারি ফাঁস করেন। সদা ব্যস্ত থাকেন) ভূমিকায় নেমেছিলেন অন্ধ্রের চন্দ্রবাবু নাইডু। সাড়ে চার বছর কেন্দ্রে ক্ষমতারমধু খেয়েছিলেন। কিন্তু ওয়াইএসআর-এর জগন রেড্ডি বিপুল জনপ্রিয় হয়ে পড়ায় ভয়ে জোট ভেঙ্গে রাজ্যে ফেরেন। যাতে অন্ধ্র দরদি সেখানো যাবে, আবার ‘ঘর ঘোটালা চাচা’ হয়ে কেন্দ্রে মনোমতো লোক বসিয়ে মালাইও বের করে নেওয়া যাবে। কী করেননি? একবার দিল্লি তো একবার শরদ পাওয়ারের বাড়ি। সেখানে নাকি Common Minimum Programme-97 খসড়াও লেখা হচ্ছিল। কখনও বাঙ্গালোরে। কুমারস্বামীর চোখের জল মোচ্ছাচ্ছেন, আবার কলকাতায় দিদির সভায় ২১ দলের নেতাদের হাত তোলার (উদ্বাহু) ব্যায়াম শেখাচ্ছেন। ২১ তারিখে ভোর রাতে কালীঘাটে এসে ধরনা দিয়েছিলেন। এঁদের। ঘোষিত উদ্দেশ্য ভয়ংকর গম্ভীর— দেশরক্ষা, সংবিধান বাঁচানো, মোদীর হাত থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার প্রভৃতি। দেশের মুখ জনগণ কিন্তু এঁদের মতলব ধরে ফেলেছিল। চন্দ্রবাবুর টিডিপি সংসদে ১৫ আসন থেকে ৩-এ নেমে এসেছে। রাজ্যে ২৪ আসন পেয়ে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। উঠে এসেছেন নবীন প্রজন্মের ৩৫০০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে অন্ধ্রবাসীর সঙ্গে সরাসরি সংযোগ করা মিতবাক জগন রেড্ডি। লোকসভায় ২২টি আসন তার। ইনি কিন্তু রাজনীতিক বাবার ছেলে হয়েও জেলবাস করে, মিথ্যে মামলায় ফেঁসে নিজেকে তুলে এনেছেন। সন্ধ্যে ঘন হয়ে এসেছে। দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদী উত্তাল বিজেপি কার্যকর্তাদের সম্বোধন করবেন। সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। এখানেও আলাউদ্দিন খিলজির দুর্গ পতনোন্মুখ। চুরমার হয়ে গেছে কুস্বপ্ন। অপরিচিত রং গেরুয়া গায়ে মাখছে বাঙ্গলার গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষজন। বিজেপি অবিশ্বাস্য ফল করে ১৮টি আসন। পেয়েছে যা বিধানসভার নিরিখে ১৫০টি।
এই নির্বাচন মিথ্যের মিনার ও জনগণের সঙ্গে ছলনাকে বরাবরের মতো ধ্বস্ত করে দেওয়ায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দিল্লিতে ইতিমধ্যে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে বিজেপি। নিখোঁজ হয়ে গেছেন ‘ঘর ঘোটালা চাচা। খবর এসেছে। তাঁর বহু বহু কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক-ছেলে লোকেশ নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। কর্ণাটকে, উত্তরপ্রদেশে, বিহারে জাতপাত নিকেশ হয়ে গেছে। মোদীজী তার ভাষণে বলেছেন— “দেশের মানুষ একটি দায়বদ্ধ দৃঢ়সংকল্প বিশ্বস্ত সরকার চায় যে। তার মঙ্গলের জন্য কাজ করবে। কদাচ নিজের জন্য নয়। তিনি তাই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইতিমধ্যে কেজরিওয়াল-সহ (ইনি নাকি ৫ জন প্রধানমন্ত্রীর ফরমূলা দিয়েছিলেন।) পূর্বোল্লেখিত প্রধানমন্ত্রিত্বের অনেক নিখোঁজ দাবিদারের নামে এফ আই আর করা হয়েছে। জনতা ফুরফুরে মনে গাইছে ‘রং দে মোহে কেসরিয়া’।
সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.