সার্ধশতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ-শ্যামাপ্রসাদ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় #RabindranathAndSwadesh

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের যোগাযোগ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে কবির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের তথা স্যার আশুতোষের যোগাযোগের কথা দিয়েই সূচনা করতে হয়। ক্ষুদ্র প্রবন্ধে বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ নেই বলে ঘটনাবলির সংক্ষিপ্ত কালানুক্রমিক উল্লেখেই বক্তব্য সীমাবদ্ধ রাখতে হচ্ছে।

সাল ১৯০৮। আশুতোষ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কবির কাছে আহ্বান এলো ১৯০৯ সালের বি.এ পরীক্ষার বাংলার প্রশ্নপত্র রচনার দায়িত্ব গ্রহণের। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সে দায়িত্ব গ্রহণে অসম্মত হন।

সাল ১৯১১। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে কলেজ স্থাপন বিষয়ে আশুতোষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বলে তার জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন। আলোচনায় কলেজ স্থাপনের হ্যাপা বুঝতে পেরে কবি সে প্রচেষ্টা থেকে বিরত হন।

সাল ১৯১৩। সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। কবির নোবেল পুরস্কার লাভের আগে কবিকে ‘অনারারি ডি.লিট’ ডিগ্রী প্রদান করে আশুতোষ কবির প্রতিভাকে জাতীয় স্বীকৃতি দান করেন।

সাল ১৯১৫। সাহিত্যের উপর একগুচ্ছ বক্তৃতাদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে আহ্বান করে। কিন্তু কবি ওই সময়ে বক্তৃতা প্রদানে তার অক্ষমতা জ্ঞাপন করেন।

সাল ১৯১৮। রবীন্দ্রনাথ আশুতোষের সঙ্গে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে এম.এ তে পঠনপাঠন পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন বলে জানা যায়।

সাল ১৯২১। আশুতোষ তার মাতৃদেবীর স্মৃতিতে স্থাপিত ‘জগত্তারিণী স্বর্ণ পদক’ সবার আগে রবীন্দ্রনাথকেই প্রদান করেন।

ওই বছরেই আশুতোষ রবীন্দ্রনাথের জামাতা নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলিকে কৃষিবিজ্ঞানে ‘খয়রা অধ্যাপক’ পদে নিযুক্ত করেন।

কবির সঙ্গে শুধু আশুতোষের নয়, তার পুত্রদের বিশেষ করে মধ্যমপুত্র শ্যামাপ্রসাদের পরিচয় ও পত্রালাপ শুরু হয়েছে আশুতোষের জীবদ্দশাতেই। প্রমাণস্বরূপ ১৯২১ সালের ২৫ আগস্ট লিখিত নিম্নোদ্ধৃত চিঠি। তখনও শ্যামাপ্রসাদ কলেজের ছাত্র। তিনি কবির কাছে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সঠিক তারিখ জানতে চেয়েছিলেন। জবাবে কবি জানালেন।

স্নেহাস্পদেষু,

ঠিক তারিখ মনে নেই এইটুকু মনে আছে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি নোবেল প্রাইজের খবর আমার কাছে আসে।

শুভাকাঙ্ক্ষী

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

25Th august 1921

সাল ১৯২৩। আশুতোষ কবিকে দিয়ে সাহিত্যের উপর ‘রিডারশিপ বক্তৃতামালা’ দানের সিদ্ধান্ত নেন এবং কবিও তাতে স্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন।

১৯২৪ সালের ১-৩ মার্চ আশুতোষের সভাপতিত্বে সাহিত্য সম্পর্কে কবি তিনটি বক্তৃতা দেন। পরবর্তীকালে কবির সংশোধনী সহ এই বক্তৃতামালা সাহিত্য, তথ্য ও সত্য, এবং সৃষ্টি নামে প্রবন্ধাকারে প্রকাশিত হয়।

এই বক্তৃতাদানের ১৮ দিন পর কবি চীনদেশ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন, আর ১৪ দিনের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ভাইস-চ্যান্সেলর হিসাবে আশুতোষেরও সম্পর্কচ্ছেদ ঘটে।

এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদায় নেবার মাত্র এক বছর এক মাস বাইশ দিন পর—২৫মে, ১৯২৪ পাটনায় অকস্মাৎ অসুস্থ হয়ে তার দেহত্যাগ ঘটে।

আশুতোষের মহাপ্রয়াণের পর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেই কবির পত্রালাপ চলতে থাকে বিশেষত আশুতোষের বাড়ি থেকে প্রকাশিত ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকার জন্য লেখা চাওয়ার ব্যাপারে। ইতিমধ্যে শ্যামাপ্রসাদ শনৈঃ শনৈঃ বিশ্ববিদ্যলয়ে আশুতোষের শূন্যস্থানপূরণে অগ্রসর হচ্ছেন, ক্রমেই সাহিত্যের আঙিনা থেকে সরে এসে শ্যামাপ্রসাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ব্যাপারেই নিজেকে অধিকতর ব্যস্ত রাখতে শুরু করেছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তখন আশুতোষ বিরোধীদের হাতে। তবু শ্যামাপ্রসাদকে সম্বোধন করেই ১০ জানুয়ারি ১৯২৬ তাং কবি এক চিঠি লেখেন। বিষয়টি হল- রবীন্দ্র জামাতা নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলিকে প্রদত্ত কোয়ার্টারটি তার বিদেশে অধিষ্ঠানকালে কেড়ে নিয়ে অন্য এক অধ্যাপককে প্রদান করা নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের উষ্মা ও অনুযোগপুর্ণ এই পত্রের জবাব দেওয়া বা প্রতিকার করার মতো অধিকার তখন শ্যামাপ্রসাদ অর্জন করেননি—তাই অধ্যাপক গাঙ্গুলিকে কোয়ার্টার ফেরত না দিয়ে ঘরভাড়া দেওয়ার সিদ্ধান্তই হল।

১৯৩০ সালের পর থেকে শ্যামাপ্রসাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেবায় নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করেন। আর তখন থেকেই শান্তিনিকেতন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তথা শ্যামাপ্রসাদের মধ্যে বিভিন্ন কাজকর্মের মাধ্যমে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বেড়েই চলে। রবীন্দ্রনাথের একাধিক রচনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পরীক্ষার পাঠ্য তালিকাভুক্ত হতে থাকে।

১৯৩০ সালে অধ্যাপক হাসান সুরাবর্দীকে বাগীশ্বরী অধ্যাপক পদে নিযুক্ত করার কালে রবীন্দ্রনাথের সুপারিশকেই শ্যামাপ্রসাদ বিরোধীদের সমালোচনার মুখে তুলে ধরেন।

১৯৩২ সালে রবীন্দ্রনাথকে বাংলা সাহিত্য বিভাগে ‘বিশেষ অধ্যাপক’ পদে নিয়োগের ব্যাপারে শ্যামাপ্রসাদই মুখ্যভূমিকা নেন। তার বিরুদ্ধে কোনো কোনো মহল থেকে আপত্তি উঠলে কবি শ্যামাপ্রসাদকে সঙ্কোচ ও কুণ্ঠামেশান এক পত্র লেখেন। তদুত্তরে শ্যামাপ্রসাদ কবিকে সশ্রদ্ধ মর্যাদাপূর্ণ যে চিঠি লেখেন তার প্রাসঙ্গিকতা আজও হারায়নি।

(হস্তলিখিত চিঠির অনুলিপি)

77 Asutosh Mookerjee Road

Calcutta

২৪ জুলাই, ১৯৩২

শ্রীচরণকমলেষু

কাল সন্ধ্যার সময় সেনেটের মিটিঙ থেকে ফিরে এসে আপনার পত্র পেলাম। আমি যতটুকু জানি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্থাপিত হচ্ছে দেখে দেশের লোকের মনে যথার্থ আনন্দ ও আশার সঞ্চার হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ অধ্যাপককে যে সকল আইনকানুনের বশবর্তী হয়ে চলতে হয়, আপনার সঙ্গে তার কোনোই সম্পর্ক থাকবে না। আপনাকে আমি সকল কথাই পরিষ্কার করে বলেছিলাম। এই প্রস্তাবে যদি আপনার সম্মান বা শান্তির ব্যাঘাত হবার কোনো সম্ভাবনা থাকত, আমি কখনই এ কথা আপনার নিকট তুলতাম না।

দু-চারজন সঙ্কীর্ণমনা কি বলেছে না বলেছে সেদিকে আমাদের নজর দিলে চলবে না। আমার পক্ষে এ কথা বলা ধৃষ্টতা যে আমাদের দেশে কোনো ভালো। কাজে নামতে গেলেই প্রথমতঃ অল্প বিস্তর বাধাবিপত্তি হতেই হবে, কিছু অসঙ্গত আলোচনাও হবে। কিন্তু সে আলোচনা, বাধাবিপত্তি বেশিদিন স্থায়ী হয় না, যতই আমরা কাজের দিকে অগ্রসর হই, বাধাবিপত্তি আপনা হতেই সরে যায়।

যে কাজের জন্য আপনার সাহায্য, ভিক্ষা করেছি, সে কাজ যথার্থ দেশের মঙ্গলকারক। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকট হতে এইরূপ সংস্কারের দাবি আপনি বহুকাল হতে করে এসেছেন। আজ যখন বিশ্ববিদ্যালয় আপনাকে এই বৃহৎ কাজে যোগ দেবার জন্য অনুরোধ করেছে, আপনি দ্বিধাশূন্য মনে এই আহ্বান গ্রহণ করুন, এই আমার প্রার্থনা। ইতি

প্রণত

শ্রীশ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

কবির সত্তর বর্ষপূর্তি উপলক্ষে কবিকে সিনেট হলে ৬.৮.১৯৩২ তারিখে অভিনন্দন জ্ঞাপন করা হয়। কবির সপ্ততিতম জন্মোৎসব পালনের জন্য যে জাতীয় কমিটি গঠিত হয়, তার অন্যতম যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ; অপর সম্পাদক ছিলেন অমল হোম।

সাল ১৯৩২। প্রিয়তম জ্যেষ্ঠ কন্যা কমলা দেবীর অকাল মৃত্যুতে শোকাহত পিতা আশুতোষ ‘কমলা লেকচার’ নামে স্মৃতি বক্তৃতার ব্যবস্থা করেছিলেন। শ্যামাপ্রসাদ কবিকে দিয়ে ১৯৩২ সালে তাঁর বড় দিদির নামাঙ্কিত এই স্মৃতি বক্তৃতা প্রদানের ব্যবস্থা করেন। ১৯৩৩ সালের ১৬, ১৮ ও ২০ জানুয়ারি কবি ‘মানুষের ধর্ম’ শীর্ষক এই কমলা লেকচার’ প্রদান করেন।

‘অধ্যাপক হিসাবে রবীন্দ্রনাথ প্রথম বক্তৃতা দেন ১৯৩২-এর ডিসেম্বরে, বিষয়—‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ। ১৯৩৩-এর ফেব্রুয়ারির শেষে দেন দ্বিতীয় বক্তৃতা। বিষয়—“শিক্ষার বিকিরণ’ এ ছাড়াও কবি ছন্দ ও সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়ে দুটি বক্তৃতা দিয়েছেন।

১৯৩৩ সালে শ্যামাপ্রসাদের পারিবারিক জীবনে এক ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে। চারটি নাবালক সন্তান রেখে সামান্য রোগভোগে পত্নী সুধাদেবী অকস্মাৎ পরলোক গমন করেন। অনুজ উমাপ্রসাদ লিখেছেন সুধাদেবীর লক্ষ্মীপ্রতিম মৃতদেহটি চিতার উপর শায়িত। সিথিভরা টকটকে লাল সিঁদুর। নয় বছরের পুত্র মুখাগ্নি করছে। দাউ দাউ করে চিতা জ্বলে উঠছে। প্রস্তরমূর্তির মতো শ্যামাপ্রসাদ নির্বাক নিস্পন্দ হয়ে বসে। নিষ্পলক চোখে সেদিকে চেয়ে আছেন। হঠাৎ শোনা গেল তার অস্ফুট । স্বগতোক্তি—”কী সর্বনাশই না হয়ে গেল।” (শ্যামাপ্রসাদের ডায়েরি ও মৃত্যু প্রসঙ্গ)

এই শোকাবস্থায় কবির কাছ থেকে শ্যামাপ্রসাদ সান্ত্বনা বাণী পেলেন—

শ্রীশ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

শান্তিনিকেতন

কল্যাণীয়েষু,

তোমার স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদে স্তম্ভিত হয়েছি। তোমার বলিষ্ঠ চিত্ত, এই দুঃসহ শোককে উত্তীর্ণ হয়েও সান্ত্বনা পাবে সন্দেহ নেই। জীবনের সর্বপ্রধান অভিজ্ঞতা মৃত্যুতে, সেই মৃত্যু যখন নিকটতম আত্মীয়ের ঘটে, তখন অন্তরের গভীরতম কয় উদ্ঘাটিত হয় তার আঘাতে। সেইখান থেকে তুমি সেই বৈরাগ্যের বাণীকে লাভ করো যা ইহলোক ও পরলোকের মাঝখানে দৌত্যসাধন করে এই কামনা করি।

ইতি

সম্ব্যধিত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৩ আগস্ট ১৯৩৩

উপাচার্যপদে শ্যামাপ্রসাদ

স্ত্রীর মৃত্যুর এক বছর পর ১৯৩৪ সালের ৮ আগস্ট শ্যামাপ্রসাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাল ধরলেন উপাচার্য হিসাবে। মাত্র ৩৩ বৎসর বয়স। সর্বকনিষ্ঠ, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে সর্বজ্ঞ। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের মতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে ‘বাপকা বেটা’। এত দিন অন্যান্য উপাচার্যদের বকলমে কবির সঙ্গে যোগাযোগ; এখন থেকে উপাচার্য হিসাবে স্বকলমে কবির সঙ্গে পত্রালাপ। নতুন কর্মক্ষেত্রের শুরুতেই যথোপযুক্ত মর্যাদার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন শ্যামাপ্রসাদ। ১৯৩৫ সালের ২৪ জানুয়ারি থেকে প্রতিষ্ঠা দিবস বেশ জাঁকজমক সহকারে পালিত হতে থাকে। এ ব্যাপারে শ্যামাপ্রসাদ পরোক্ষভাবে কবিকে জড়িত করেছিলেন।

মাতৃভাষায় পরীক্ষা দানের ব্যবস্থা : বিভিন্ন মুখ্যপরিকল্পনা

এদিকে মাতৃভাষার মাধ্যমে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেবার ব্যবস্থা তো হল; কিন্তু উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক কোথায়? তাই রবীন্দ্রনাথকে সভাপতি করে এবং ১২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে সদস্য করে বাংলা পাঠ্যপুস্তক রচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরে রাজশেখর বসু এবং প্রমথ চৌধুরিকেও এই কমিটিতে (Text Book Committee) নেওয়া হয়। এছাড়া বিষয় অনুসারে ১০টি—সাব-কমিটিও গড়া হয়। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপকগণ এসব কমিটির সদস্য মনোনীত হন।

এ প্রসঙ্গেই বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি বিষয়ের বাংলা পরিভাষার প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভূত হয়। তা ছাড়া বাংলা বানানের রাজ্যেও কোনো নিয়ম শৃঙ্খলা ছিল না। ১৯৩৪ সালে পরিভাষা রচনা ও সংকলনের জন্য একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিভাষা সংকলন ও বানান-সংস্কারের উভয়বিধ কাজ একসঙ্গে শান্তিনিকেতন থেকে চলতে থাকে। গবেষণা সহায়কের পদে নিযুক্ত ছিলেন বিজন বিহারি ভট্টাচার্য। ১৯৩৫ সালে ‘বাংলা বানানের নিয়ম’ শীর্ষক পুস্তিকা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। ভূমিকা লেখেন উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ভূমিকায় তিনি বলেন, ‘প্রায় দুইশত বিশিষ্ট লেখক ও অধ্যাপকের অভিমত আলোচনা করিয়া সমিতি বানানের নিয়ম সংকলন করিয়াছেন।’

ভাইস-চ্যান্সেলর না হলেও সবই চলে তার অঙ্গুলিহেলনে

রবীন্দ্রনাথকে বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক বাংলা ভাষার উন্নয়ন প্রকল্পে যুক্ত হতে দেখে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী আজিজুল হকের উদ্যোগে এক সরকারি শিক্ষা সপ্তাহ পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কবি জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখলেন : ‘১৯৩৬ খ্রিঃ ৮ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ কলিকাতায় শিক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে উদ্বোধনী ভাষণ দেন। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী আজিজুল হকের প্রেরণায় ও চেষ্টায় এই শিক্ষা-উৎসবের আয়োজন হয়েছিল।

শিক্ষা সপ্তাহের ভাষণে রবীন্দ্রনাথ যে প্রস্তাব পেশ করেন অর্থাৎ বাংলা ভাষার মাধ্যমে যে সকল জ্ঞান বিজ্ঞান প্রচারিত হইবে এই প্রস্তাব লীগ গভর্নমেন্ট সর্বান্তঃকরণে অনুমোদন ও গ্রহণ করিতে পারিলেন না। (না পারারই কথা; কারণ তাহলে শ্যামাপ্রসাদ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তিত নীতিকেই তো সমর্থন করতে হয়—লেখক) তবে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এ বিষয়ে কিছুটা উৎসাহ দেখাইলেন, শ্যামাপ্রসাদ তখন ভাইস-চ্যান্সেলর; বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকশিক্ষা গ্রন্থমালায় রবীন্দ্রনাথের ‘বাংলাভাষা পরিচয়’ নামে গ্রন্থ প্রকাশিত হইল। দুঃখের বিষয় এই ‘লোকশিক্ষা’ গ্রন্থমালায় খুব বেশি বই বাহির হয় নাই।

বাংলা গ্রন্থ রচনার প্রধান অন্তরায় তাহার পরিভাষার দীনতা; এই বিষয়ে এই সময়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানান সংস্কার এবং বৈজ্ঞানিক পারিভাষিক শব্দ সংকলন করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন; রবীন্দ্রনাথ উভয়টিতেই অংশগ্রহণ করেন।”

প্রতিষ্ঠা দিবস পালনের সূচনা

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা দিবস পালন প্রসঙ্গে আসা যাক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটি এক অভিনব প্রচেষ্টা। শ্যামাপ্রসাদের উপাচার্য কালেই এই অনুষ্ঠানের সূচনা। ১৯৩৫ সালে প্রথম প্রতিষ্ঠা দিবসটি মোটামুটি সন্তোষজনকভাবে উদ্‌যাপিত হল। ১৯৩৬ সালের প্রতিষ্ঠা দিবস যাতে আরও সর্বাঙ্গসুন্দর ও জমকালো করা যায় শ্যামাপ্রসাদ সেদিকে নজর দিলেন। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পতাকা তৈরি হয়েছে। প্রতীকচিহ্ন থেকে ব্রিটিশ রাজশক্তির চিহ্ন অপসারণ করে সেস্থলে প্রস্ফুটিত পদ্মেপরি বাংলা ‘শ্রী’ অক্ষর বসেছে। ব্যাণ্ড পার্টি তৈরি করে বাজনার তালে তালে কুচকাওয়াজ করতে করতে বিভিন্ন কলেজের ছাত্রছাত্রীরা নিজ নিজ কলেজের পতাকা নিয়ে শোভাযাত্রা সহকারে সভাস্থলে গিয়েছে। প্রতিষ্ঠা দিবস পালনের এই নতুনত্বে চারদিকে দারুণ উৎসাহ ও কৌতুহলের সঞ্চার হয়েছে। শ্যামাপ্রসাদ কবিকে অনুরোধ করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা দিবসের শোভাযাত্রায় কুচকাওয়াজের সঙ্গে। গাইবার উপযোগী একটি গান রচনা করে দেবার জন্য। কবি দুটি গান রচনা করেছিলেন : (১) চলো যাই, চলো যাই, এবং (২) শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান। বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম গানটি গাইবার জন্য মনোনীত করে।

বাংলায় সমাবর্তন ভাষণ দানের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত

শ্যামাপ্রসাদের আন্তরিক ইচ্ছা সমাবর্তন উৎসবে কবিকে দিয়ে দীক্ষান্ত ভাষণ দেওয়ার। কবি রাজি হলেন, কিন্তু শর্ত আরোপ করলেন তিনি বাংলায় ভাল দিবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের এরকম নজির নেই। শ্যামাপ্রসাদ এই তিন রচনায় এক কথায় রাজি হলেন তবে শর্ত দিলেন বাংলা বক্তৃতার ইংরেজি অনুবাদ তাকে দিতে হবে। কবি বিনা আপত্তিতে সে শর্ত মেনে নিলেন। ১৯৩৭ সালেহ বার্ষিক সমাবর্তন সভায় কবি বাংলায় তার দীক্ষান্ত ভাষণ দিলেন (১৭.২.৩৭)। সেই ভাষণে কবি বাংলাদেশে শিক্ষাজগতে যে ঋতু পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে সে কথা সানন্দে উল্লেখ করেন এবং এই পরিবর্তন স্যার আশুতোষ ও তার সুযোগ্য পত্র যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে সে কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করে কবিরল বলেছেন : “আশুতোষ বিশ্ববিদ্যলয়ের পরভাষাশ্রিত আভিজাত্যবোধকে অকস্মাৎ আঘাত করতে কুণ্ঠিত হলেন না; বিশ্ববিদ্যালয়ের তুঙ্গচূড়া থেকে তিনিই প্রথম। নমস্কার প্রেরণ করলেন তার মাতৃভাষার দিকে। তারপরে তিনিই বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাভাষার ধারাকে অবতারণ করলেন; সাবধানে তার স্রোতঃপথ খনন করে দিলেন। পিতৃনির্দিষ্ট সেই পথকে আজ প্রশস্ত করে দিচ্ছেন তারই সুযোগ্যপত্র বাংলাদেশের আশীৰ্ভাজন শ্রীযুক্ত শ্যামাপ্রসাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের দীক্ষামন্ত্র থেকে বঞ্চিত আমার মতো ব্রাত্যবাংলা লেখককে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি দিয়ে আশুতোষ প্রথম রীতি লঙ্ঘন করেছেন, আজ তারই পুত্র সেই ব্রাত্যকেই আজকের দিনের অনুষ্ঠানে বাংলাভাষার অভিভাষণ পাঠ করতে নিমন্ত্রণ করে পুনশ্চ সেই রীতির দুটো গ্রন্থি এক সঙ্গে যুক্ত করেছেন। এতে বোঝা গেল, বাংলাদেশে শিক্ষা জগতে ঋতু-পরিবর্তন হয়েছে, পাশ্চাত্ত্য আবহাওয়ার শীতে আড়ষ্ট শাখায় আজ এল নব পল্লবের উৎসব।

মানসিক উদারতা ও ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার সংঘাত

কিন্তু এই আনন্দের বাজারেও সাম্প্রদায়িক দৈত্য তার নােংরা ছায়া ফেলতে দ্বিধা করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রতীকে “শ্রী ও পদ্ম”-র অবস্থান মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত হানার অভিযোগে মুসলমান ছাত্রগণ এই সমাবর্তন উৎসব বর্জন করে এবং তাদের উস্কানিদাতা মুসলমান নেতা ও মন্ত্রীরাও আমন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও দলবেঁধে অনুপস্থিত থাকেন। ইতিমধ্যে শিক্ষাব্যবস্থাকে সাম্প্রদায়িকীকরণের তোড়জোড় শুরু হয়েছে পুরোদমে। ম্যাট্রিকুলেশন, ইন্টারমিডিয়েট ইত্যাদি পাঠ্য তালিকায় রবীন্দ্রনাথের কবিতার মাঝেও সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ খোঁজা হতে থাকে। সংবাদপত্র প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন ” সাম্প্রদায়িক মনোভাব সেখানে (বাংলায়) খুবই প্রবল, শিক্ষাসংক্রান্ত ব্যাপার লইয়া গুরুতর বিরোধ দেখা যাইতেছে।

মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের এসব নষ্টামি দুষ্টামির বিরুদ্ধে শ্যামাপ্রসাদ এতদিন। মুখ খোলেননি। কারণ উপাচার্যের আসনে অধিষ্ঠিত নােংরা রাজনীতি নাক গলানো। তিনি সমীচীন মনে করেননি। ১৯৩৮ সালের ৭ আগস্ট তার উপাচার্যকালের মেয়াদ শেষ হল; আর ১৯৩৯ সালের তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতির সংস্পর্শ আসেন, তাও শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার তাণ্ডব প্রতিরোধ করতেই।

বাংলার মুসলিম লীগ সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে নিজেদের অধিকার কায়েম করতে এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে হাতে না মেরে ভাতে মারতে এক মাধ্যমিক শিক্ষা বিল পাস করাতে উদ্যোগী হল। এই বিলের বিরুদ্ধে সমগ্র হিন্দুসমাজ রুখে দাঁড়ায় এবং ১৯৪০ সালের ২১-২৩ ডিসেম্বর কলকাতায় তিনদিন ব্যাপী এক প্রতিবাদ সভা আহ্বান করে। তখন কবি গুরুতর অসুস্থ এবং বলতে গেলে চলৎশক্তি রহিত। তাই তাকে সভায় উপস্থিত থাকার অনুরোধ বৃথা জেনে শ্যামাপ্রসাদ তাঁর কাছে সভার উদ্দেশ্যের উপর একটি বাণী প্রার্থনা করে চিঠি লেখেন

77, Asutosh Mookherjee Road Calcutta

14-12-40

শ্রীচরণকমলেষু

আপনার শরীরের বর্তমান অবস্থায় পত্র দিতেছি বলিয়া মার্জনা করিবেন।

মাধ্যমিক শিক্ষা বিলের প্রতিবাদ-সভা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রর সভাপতিত্বে ২১, ২২, ২৩ ডিসেম্বর কলিকাতায় আহ্বান করা হইয়াছে। সারা বাংলাদেশের প্রতিনিধি ইহাতে যোগদান করিবেন। সকল দলের লোকই সাগ্রহে এই সভাকে সাফল্যমণ্ডিত করিতে উদ্যোগী হইয়াছেন। আমাদের সকলের ইচ্ছা ছিল আপনি এই সভার উদ্ধোধন করিবেন। কিন্তু তাহা এখন সম্ভব নহে, জানি।

আমাদের বিশেষ ইচ্ছা যদি সম্ভব হয় একটি বাণী পাঠাইবেন। আজ বাংলার বিশেষ সঙ্কটময় দিন। এই বিলের দ্বারা যে শুধু শিক্ষায়তনের উপর সরকারী কর্তৃত্বের পাকাপাকি বন্দোবস্ত হইতেছে, তাহা নয়—আমাদের বহু-শতাব্দীর সাধনা ও কৃষ্টির মূলোৎপাটন করবার ইহাকে জঘন্য প্রয়াস।

বাংলাভাষা ও ইতিহাসের উপর যে অন্যায় আক্রমণের পর্ব আরম্ভ হইয়াছে, তাহারই পূর্ণ সমাপ্তি এই বিলের দ্বারা সাধন করিবার অপচেষ্ঠা হইতেছে। আজ এই সময়ে আপনার বজ-বাণীর দ্বারা সারা বাংলার হিন্দুকে পুনর্জাগ্রত করুন যেন তাহারা সকল বাধা ও বিপদকে তুচ্ছ করিয়া আপন শিক্ষা মন্দিরের পবিত্রতা ও স্বাধীনতা রক্ষা করিতে যত্নশীল হয়। আমার প্রণাম জানিবেন। আমি আজ ঢাকা যাইতেছি, বৃহস্পতিবার কলিকাতায় ফিরিয়া আসিব। ইতি–

স্নেহবদ্ধ শ্যামাপ্রসাদ

কিন্তু বাণী দেবে কে? স্বয়ং বাণীর বরপুত্রের তখন জরায় জরজর অবস্থা। এই চিঠি কবির গোচরীভুত না করাই স্বাভাবিক। কারণ, তখন তার স্বাস্থ্যের অবস্থা সম্পর্কে সকাল বিকাল যে ডাক্তারদের বুলেটিন প্রকাশ করা হচ্ছে। ডাঃ নীলরতন সরকার এবং ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় ইতোপূর্বেই কবিকে সর্বপ্রকার উত্তেজনা ও মানসিক অশান্তি থেকে রক্ষা করার আবশ্যকতা সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করেছেন। এবং লোকে যেন উপদেশ, সহানুভূতি ও সহযোগিতা লাভের জন্য তার কাছে না যান সেজন্য সবাইকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছেন ফলে শ্যামাপ্রসাদের শেষ চিঠি যেমন কবির হস্তগত হয়নি, তেমনি তার শেষ চিঠির শেষ উত্তরও আসেনি।

কবির জীবদ্দশায় শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে লিখিত যোগাযোগের এখানেই ইতি ঘটে। বলা যায়।

এসকল বৃহৎ বৃহৎ ব্যাপার ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বভারতীতে শিক্ষা সম্পৰ্কীয় নানা বিষয়ে পত্র বা লোকমারফত শ্যামাপ্রসাদ ও কবির মধ্যে মত বিনিময় শলাপরামর্শ চলে। বাহুল্য বিধায় সেসব আর উল্লেখ করা গেল না। অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তির প্রবন্ধকার লিখিত ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত “প্রসঙ্গ : কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়” গ্রন্থটি দেখতে পারেন।

ড. দীনেশচন্দ্র সিংহ
(লেখক কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ডেপুটি রেজিস্ট্রার ও প্রবন্ধ লেখক)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.