বাঙালির গৌরবময় ইতিহাসের আরেকটি উজ্জ্বলতম দিন পঁচিশে বৈশাখ। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সঙ্গীতের কিংবদন্তি পুরুষ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। প্রেমময়ী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৮তম জন্মবার্ষিকীতে এখনো বাংলা ভাষার প্রধানতম কবি হয়ে বাঙালির হূদয়ে চির আসন করে নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ এমন এক সময় জন্মগ্রহণ করেন যখন রাষ্ট্র ছিল পরাধীন। চিন্তা ছিল প্রথাগত ও অনগ্রসর।

এই সময় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বমানে উন্নীত করার পাশাপাশি জাতির চিন্তাজগতে আধুনিকতার বীজ বুনে দিয়ে ছিলেন তিনি। বাঙালির মানস গঠনে পালন করেছিলেন অগ্রদূতের ভূমিকা। বাঙালিকে আবেগ অনুভূতি প্রকাশের ভাষা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।

পঞ্জিকা মেনে ২৫ শে বৈশাখ বাঙালির সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই প্রাণের, গানের, নাটকের, ছন্দের মহাকবি আর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবর্ষ শুরু কিংবা শেষ হয়। গ্রহণযোগ্য একটি অভিন্ন বর্ষপঞ্জি থাকলে খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সমন্বয়ের পরিত্রাণ থেকে মুক্ত হয় এপার-ওপার বাংলার মানুষরা। তা একান্তই বাঙালির সৌর বছরের পঞ্জিকা, চাঁদ কিংবা ঘড়ির সঙ্গে মিলিয়ে নেয়ার ভাবনা যেন ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে না পারে।

যার জন্ম না হলে বাংলা সাহিত্য পরিপূর্ণতা পেত না, যার জন্ম না হলে বাঙালির বাঙালিয়ানার গৌরব হত না সম্পূর্ণ, তার নাম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি পশ্চিমবঙ্গের আনাচে-কানাচে থেকেও এই বাংলাকে দেখেছিলেন অন্যরকম আঙ্গিকে। রবীন্দ্রনাথের লেখা, দর্শন, চিন্তাচেতনা, তথা বহুমাত্রিক আলোকছটার ঔজ্জ্বল্যে ও মহিমায় বাঙালির জাতিসত্ত্বা হয়েছে মহিমান্বিত ও গৌরবান্বিত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বহু ভাষায় অনুদিত হয়েছে তার সাহিত্য। মহাকালের বিস্তীর্ণ পটভূমিতে এক ব্যতিক্রমী রবির কিরণে রবীন্দ্রনাথের উজ্জ্বল আলোকিত দিনটিই ছিলো পঁচিশে বৈশাখ। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যকে যেভাবে দর্শন ও সাহিত্য রচিয়তার মধ্য দিয়ে লালন করেছে, বিশ্বসাহিত্য সভায় আর কেউ সেই পরিচিতি লাভ করতে পারবে না।

বিশ্বকবির লেখা গান বাঙালির মনে আজো প্রতিধ্বনিত হয়। গতকাল পালিত হয়ে গেলো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভ জন্মদিন। তাই এই বিশেষ দিনে কবিগুরুকে অনেক অনেক শ্রদ্ধা আর ভালবাসা প্রকৃতির সৌন্দর্য্য পিপাসু সব ধরনের ফুলেল শুভেচ্ছা এই দিনটিতে।

‘রাত্রি হলো ভোর।

আজি মোর

জন্মের স্মরণপূর্ণ বাণী,

প্রভাতের রৌদ্রে-লেখা লিপিখানি

হাতে করে আনি

দ্বারে আসি দিল ডাক

উদয় দিগন্তে ওই শ্রভ্র শঙ্খ

বাজে।

মোর চিত্ত-মাঝে

চির নূতনেরে দিল ডাক

পঁচিশে বৈশাখ।’

হে নূতন,

দেখা দিক আর বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।

তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদ্ঘাটন

সূর্যের মতন।

রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন।

ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,

ব্যক্ত হোক তোমা মাঝে অসীমের চিরবিস্ময়।

উদয় দিগন্তে শঙ্খ বাজে,

মোর চিত্ত মাঝে

চির নূতনেরে দিল ডাক।

বৈশাখের ২৫তম দিনে এভাবেই ডাক দিয়েছিলেন বাঙালির মন ও মননের সঙ্গী কবিগুরু। বিশ্বের প্রতিটি দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতির পেছনে গাঁথা থাকে কোন বিখ্যাত মানুষের নাম। যারা বিভিন্ন অবদানের জন্য বিশ্ব খ্যাত হয়ে রয়েছেন এখনও।

যেমন কেউ রয়েছেন কাব্যে কিংবা গ্রন্থে; আবার সাহিত্যে জনপ্রিয় ও স্বনামধন্য হয়ে আদৌ স্মৃতির আয়নায় বেঁচে আছেন। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে জ্ঞান চর্চা, সংস্কৃতির পাশাপাশি তাদের ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে লালন করতে যেকোন বিশেষ দিনে জাতীয় সংগীত দিয়ে শুরু করে সেদেশের কৃষ্টি কালচার। আর তেমনি বিরল একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সংস্কৃতির বিকাশ দিয়ে।

পৃথিবীতে বাংলাভাষার লেখক ও মহাকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই একমাত্র ব্যক্তি যিনি তিন-তিনটি স্বাধীন দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। সাহিত্যের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের গান বাংলা সঙ্গীত ভাণ্ডারকে দারুণভাবে সমৃদ্ধ করেছে। আজকের বদলে যাওয়া সময়েও বিপুল ঐশ্বর্য্য নিয়ে টিকে আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত।

এর আবেদন যেন কোন দিন ফুরোবার নয়। বরং যত দিন যাচ্ছে ততই রবীন্দ্রসঙ্গীতের বাণী ও সুরের ইন্দ্রজালে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে বাঙালি। তাদের আবেগ-অনুভূতি কবিগুরুর গানের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ইংরেজি ১৮৬১ সাল আর বাংলা ১২৬৮’র ২৫ বৈশাখ কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে কবিগুরু জন্মগ্রহণ করেন।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাতা সারদা সুন্দরী দেবীর চতুর্দশ সন্তান হিসেবে ঘর আলো করে জন্ম নিয়েছিলেন বাঙালির তথা বাংলার কবি, বিশ্বকবি, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৭৫ সালে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাতৃবিয়োগ ঘটে। পিতা দেবেন্দ্রনাথ দেশভ্রমণের নেশায় বছরের অধিকাংশ সময় কলকাতার বাইরে অতিবাহিত করতেন।

তাই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হয়েও রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা কেটেছিল ভৃত্যদের অনুশাসনে। শৈশবে তিনি কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্ম্যাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা করেন। কিন্তু বিদ্যালয়-শিক্ষায় অনাগ্রহী হওয়ায় বাড়িতেই গৃহশিক্ষক রেখে তার শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। ছেলেবেলায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অথবা বোলপুর ও পানিহাটির বাগানবাড়িতে প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন।

১৮৭৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশে তিনি ইংল্যান্ডে যান। সেখানে তিনি ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে আইনবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। প্রায় দেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটিয়ে ১৮৮০ সালে কোনো ডিগ্রি না নিয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন। ১৮৮৩ সালের ভবতারিণীর সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

বিবাহিত জীবনে ভবতারিণীর নামকরণ হয়েছিল মৃণালিনী দেবী। ১৮৯১ সাল থেকে পিতার আদেশে রবীন্দ্রনাথ নদিয়া, পাবনা ও রাজশাহী জেলা এবং উড়িষ্যার জমিদারি তদারকি শুরু করেন। কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়ীতে তিনি দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন। ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা চিত্র রূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোমান্টিক, সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা তার সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ ছেড়ে চলে আসেন বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের উপকণ্ঠে শান্তিনিকেতনে।

১৯০২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মাত্র ৩০ বছর বয়সে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী মারা যান। এরপর ১৯০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কন্যা রেণুকা, ১৯০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ১৯০৭ সালের ২৩ নভেম্বর কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ মৃত্যুবরণ করেন। বাংলা ভাষার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তার জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পর প্রকাশিত হয়।

তার সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ১৯১০ সালে রচিত গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালে কলকাতায় পৈতৃক বাসভবনেই মৃত্যুবরণ করেন।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সম্ভবত বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ দিনে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে রেসকোর্সের ময়দানে লাখ লাখ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে কবিগুরুর সেই বিখ্যাত কবিতা পংক্তির ‘সাত কোটি বাঙালিকে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি” বিপরীতে অশ্রুভেজা কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘কবিগুরু, তোমার উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

দেখে যাও তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ এর থেকে বড় শ্রদ্ধার্ঘ্য কবিগুরুর প্রতি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কের আর কী হতে পারে? রবীন্দ্রনাথ শিখিয়েছেন প্রাণের সঞ্চার ঘটানোর পেছনে মানবজাতির কি প্রয়োজন। তিনি জানান দিয়েছেন তার বিভিন্ন সাহিত্যগ্রন্থের মাধ্যমে একটি দেশের কৃষ্টি কালচার কিভাবে উন্নয়নের প্রসার ঘটানো যায়। যার জন্ম না হলে বাংলা সাহিত্য পরিপূর্ণতা পেত না, যার জন্ম না হলে বাঙালির বাঙালিয়ানার গৌরব হত না সম্পূর্ণ, তার নাম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি পশ্চিমবঙ্গের আনাচে-কানাচে থেকেও এই বাংলাকে দেখেছিলেন অন্যরকম আঙ্গিকে।

রবীন্দ্রনাথের লেখা, দর্শন, চিন্তাচেতনা, তথা বহুমাত্রিক আলোকছটার ঔজ্জ্বল্যে ও মহিমায় বাঙালির জাতিসত্ত্বা হয়েছে মহিমান্বিত ও গৌরবান্বিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে তার সাহিত্য। ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। তার এ প্রাপ্তি বাংলা সাহিত্যকে বিরল গৌরব এনে দেয়। বাঙালির চেতনার রং স্পষ্ট হয়েছিল রবির আলোয়। বাঙালির প্রতিটি আবেগ আর সূক্ষ্ম অনুভূতিকে স্পর্শ করে আছেন তিনি।

বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যকে যেভাবে দর্শন ও সাহিত্য রচিয়তার মধ্য দিয়ে লালন করেছে, বিশ্বসাহিত্যসভায় আর কেউ সেই পরিচিতি লাভ করতে পারবে না। প্রেমময়ী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৮তম জন্মবার্ষিকীতে এখনো বাংলা ভাষার প্রধানতম কবি হয়ে বাঙালির হূদয়ে চির আসন করে নিয়েছেন। বিশ্বকবির লেখা গান বাঙালির মনে আজও প্রতিধ্বনিত হয়।

আখতার-উজ-জামান

লেখক, গবেষক, সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.