স্বকল্পিত বিধানদাতা স্বার্থান্বেষী পুরোহিতকুল, মৌলতন্ত্র ও পোপতন্ত্রের অজ্ঞানাঞ্জন লিপ্ত নয়নে দুগাত্ত্বিান্বেষণ নয়, এই অন্বেষণ বিদ্বদ্নয়নে নব যুগের অভিধান চয়ন করে। পৌরাণিক যুগে পৌরোহিত্যের অস্পৃশ্যতারূপ অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতেই একদিন লক্ষ লক্ষ দরিদ্র অসহায় হিন্দু জনগণ মুসলমানদের দরগায় যেতে বাধ্য হয়েছে। আর সেই সুযোগেই তারা ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হয়। এই নির্মম পুরোহিত তন্ত্রের প্রভাবেই ভারতীয় সভ্যতা ও সমাজ দুশো বছর পিছনে পড়ে গিয়েছে।বিবেকানন্দই একমাত্র পুরোহিততন্ত্র ও মৌলতন্ত্রের নিষ্ঠুর বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। সুতরাং, দুর্গাপূজার তত্ত্বান্বেষণ পুরোহিত নয়নে নয়, এ অন্বেষণ যুক্তিবাদী বিদ্বদ্নয়নে।
বিবেকানন্দের কথায়, কারো মতে মত দিয়ে বিশ লক্ষ দেবতার বিশ্বাস করা অপেক্ষা যুক্তির অনুসরণ করে নাস্তিক হওয়া ভালো। শতপথ ব্রাহ্মণেও বলা হয়েছে—“যঃ অন্যং দেবতাম উপিসত্যেন স বেদ যথা পশুরেব স দেবানা’— অথাৎ কল্পিত দেবতার উপাসনাকে পশুতুল্য বলা হয়েছে। কারণ, পরমাত্মা ও তাঁর মূর্তপ্রকাশ সর্বজীবকে ভুলে প্রতিমা পূজা নিরর্থক। শ্রীমদ্ভাগবতে (৩।২৯।২১-২৫) : অরূপকে রূপের কল্পনার খাঁচায় বন্দি করে তাঁর অনির্বচনীয়তাকে খণ্ডন করার জন্য মহর্ষি বেদব্যাসও পুরাণ লিখে অনুতপ্ত হয়েছিলেন। সাধক রামপ্রসাদ গেয়েছিলেন— ‘মায়ের মূর্তি গড়তে চাই মনের ভ্রমে মাটি দিয়ে। মা বেটি কী মাটির মেয়ে, মিছে খাটি মাটি দিয়ে। সুতরাং, এই সকল উক্তি এটাই প্রমাণ করে যে, প্রতিমা পূজা মূলত তত্ত্বেরই পূজা, সমাজ সচেতনতারই পূজা। সেই তত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত না হলে প্রতিমা পূজা নিরর্থক। সুতরাং, পূজার তত্ত্বনা জেনে কেবল পুরোহিতের বিধান অনুসারে যে পূজা করা হয়, তা প্রকৃতপক্ষে অজ্ঞানপূর্বক পূজা। তাই পূজাতত্ত্বটির যথার্থ অন্বেষণ সর্বাগ্রে প্রয়োজন।
মহাবিশ্বে বিস্ফোরণের ফলে যে প্রচণ্ড পরিমাণে শব্দ ও বিপুল পরিমাণে শক্তি বিচ্ছুরিত হয়েছিল, ঋগবেদে সেই শক্তিকেই ‘বিশ্বেদেবা অদিতিঃ পঞ্চজনা অদিতিৰ্জামদিতিজনিত্বম’, অথাৎ ‘অদিতি’ বলা হয়েছে। সেই অদিতিই চৈতন্যদায়িনী দুর্গারূপা মহেশ্বরী আজ শারোদোৎসবে দেবীমাতৃকারূপে মৃন্ময়ী প্রতিমায়, বিল্ববৃক্ষে ও নবপত্রিকায় (উদ্ভিদ জগতের বিভিন্ন শ্রেণীভুক্ত মোট নয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য ও ভেষজ গুণসম্পন্ন উদ্ভিদের সমাহার) আবিভূতা ও আরাধিতা হচ্ছেন। সেই শক্তিই সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়ের আদি ‘অক্ষর-ব্রহ্ম’ বা ‘শব্দ-ব্রহ্ম’হিসাবে ওঁ-কার শুঙ্গরূপী গণেশের মধ্য দিয়ে আরাধিতা হচ্ছেন। বিস্ফোরণের পর যে প্রচণ্ড শব্দের সৃষ্টি হয়েছিল, তারই চিহ্ন হিসাবে শিবের হাতের ডমরু যুক্তিবাদী নয়নে প্রতিভাত হচ্ছে বিরাটের প্রতীকরূপে। শয়নার্থক ‘শী’ ধাতু থেকেই ‘শিব’ শব্দটির উৎপত্তি। যেখানে সকলে শয়ন করেন— অর্থাৎ সকলের যিনি আধার তিনিই শিব। আবার যিনি অশুভের নাশ করে মঙ্গল বিধান করেন, যিনি মঙ্গলময়, সুখ ও আনন্দ স্বরূপ তিনিই শিব। ঘৃণা, লজ্জা, ভয়, শঙ্কা, জুগুপ্সা, কুল, শীল এবং জাতি—এই আটটিকে অষ্টপাশ থেকে যিনিমুক্ত তিনিই শিব। যে সমষ্টি অধিষ্ঠানচৈতন্যে অষ্টশক্তি প্রকাশিত হয় তিনিই শিব। আবার যে আধারে প্রলয় হয় সেই আধারই মহেশ্বর। সেই মহেশ্বরই সর্বগুণাধার। তাই, সাবজেক্টরূপী (আধার) শিব আঁকা থাকে অবজেক্টরূপী (আধেয়) দুর্গাপ্রতিমার পিছনে। তাই, শিব অজ্ঞানরূপী নয়নের অগোচরে অথাৎ প্রতিমার পশ্চাতে।
দুর্গাপূজায় লিঙ্গপূজা আবশ্যক। লিঙ্গ’ অর্থে যে পরম সত্তার মধ্যে জগৎ লীন হয় এবং যাঁর থেকে জগতের আবার উৎপত্তি হয়, সেই পরম কারণকেই বলা হয় লিঙ্গ। শিবের প্রতীক চিহ্ন বলে তাকে শিবলিঙ্গ। শাস্ত্রকাররা বলেছেন, লিঙ্গপূজা না করে অন্য দেবতার পূজা করলে সেই পূজা বিফল হবে এবং যিনি পূজা করবেন তাঁর নরকে গতি হবে। লিঙ্গার্চন তন্ত্রে আছে, ‘লিঙ্গপূজাং বিনা দেবি! অন্য পূজাং করোতি যঃ। বিফলা তস্য পূজাস্যাদন্তে নরক আপুয়াৎ। লিঙ্গ কোনো অঙ্গবিশেষ নয়, তা হল সাক্ষাৎ মহেশ্বরের জ্যোতির্ময় রূপের প্রকাশ এবং গৌরীপট্ট হলো জগন্ময়ী মা পার্বতীর চিন্ময়ী রূপ। লিঙ্গপূজার আগে আচমন করা বিধি। কারণ, মোক্ষের পথে যেতে গেলে আত্মশুদ্ধির প্রয়োজনার্থে সর্বাগ্রে আচমনমন্ত্রে বিষ্ণুস্মরণ করার বিধি। আমরা কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয় দিয়ে বিষয়ভোগ করতে গিয়ে ওই সকল ইন্দ্রিয় অশুদ্ধি করে ফেলি।তাই সর্বাগ্রে আচমনের মধ্য দিয়ে শুদ্ধিকরা প্রয়োজন। চক্ষু যেমন রূপজ মোহে আসক্ত, কর্ণ তেমনি শব্দজ মোহ, জিহ্বা লোভ, নাসিকা সুগন্ধে, মন নানা বিষয় মোহে আকৃষ্ট হয়ে আত্মার শুদ্ধস্বরূপতা ভুলে গিয়ে অশুদ্ধপ্রাপ্ত হয়। তাই, এই সংস্কাররূপ উচ্ছিষ্টগুলি প্রথমেই (আচমন তারই প্রতীকী) ধুতে হয়। আচমনের পর ন্যাস করা হয়।
সেই ‘ন্যাস’ মানে ত্যাগ বা স্থাপন। আমাদের প্রতিটি অঙ্গে যে ‘আমি ও আমার বোধ আছে, সেটি ত্যাগ করলেই ভগবৎ সমীপে গমন করা সম্ভব। ন্যাসের সময়ে ‘আং’, ‘ঈং’ প্রভৃতি মাতৃকা মন্ত্র উচ্চারণ করার কারণ হলো যে— সাধক ক্রমে মাতৃকাময় হয়ে উঠবেন, অথাৎ সকল জড়ত্ব (তামস, মহিষের প্রতীক) থেকে মুক্ত হয়ে কক্রে রজ (সিংহ) এবং অবশেষে শুদ্ধসত্ত্বগুণ সম্পন্না দণ্ডায়মান মা। জীবের চেতনভাবটি এইরূপ চিন্তার ফলে উদ্ভাসিত হয়। তাই পূজক ব্যাপকন্যাস, মাতৃকান্যাস, করন্যাস, অঙ্গন্যাস প্রভৃতির মধ্য দিয়ে নিজেকে শুদ্ধ হওয়ার ভাবনায় ভাবিত হওয়া চেষ্টা করেন। কারণ, শুদ্ধমনেরই ঈশ্বরের দর্শন হয়। শ্রীরামকৃষ্ণদেবও বলেছেন— ‘ঈশ্বর শুদ্ধ মনের গোচার। এটিই ন্যাসতত্ত্বের মূল তাৎপর্য।
মহালয়া থেকেই দুর্গাপূজা অর্থাৎ দেবীপক্ষের সূচনা হয়। মহালয়া তত্ত্বটি হলো মহান আলয় অথাৎ শ্রেষ্ঠ আশ্রয়। অথবা, মহতের পরমস্থান যেখানে। মহা’ ‘লয়’ অন্য অর্থে জীবগণ পরমলীন হয় যেখানে। আবার মহতাদির লয় হয় যেখানে অর্থাৎ পরমাত্মায় বা পরব্রহ্মে। এই মহালয়ে তর্পণাদি অনুষ্ঠানটিও তাৎপর্যপূর্ণ। তর্পণ হলো— দেবতা, ঋষি ও পূর্বপুরুষের তৃপ্তিবিধানের উদ্দেশে জলের অঞ্জলি নিবেদন। এই অঞ্জলি প্রদান্যের মধ্য দিয়ে পরিবার, দেশ, জাতি ও সমাজে এক সংহতি স্থাপিত হয়। জলশুদ্ধি বা তীর্থ আবাহন সময়ে অঞ্জলি প্রদানকালে বলা হয় ঃ “ওঁ কুরুক্ষেত্রং গয়া-গঙ্গা-প্রভাস-পুষ্করাণি চ। তীর্থ্যানি। এতানি পুণ্যানি তর্পণ-কালে ভবহি। “ওঁ গঙ্গে চ যমুনে চৈব। গোদাবরি সরস্বতি।নর্মদে সিন্ধু-কাবেরি জলেহস্মিন সন্নিধিং কুরু। হেযুক্তিবাদী পাঠক! সনাতন হিন্দুধর্মে তর্পণের মধ্য দিয়ে কীভাবে সংহতিবোধের বার্তা যাচ্ছে তা ভাবলে অবাক হতে হয় না কী? সুতরাং সনাতন হিন্দু ধর্মই সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের কাছে আদর্শ ও পথপ্রদর্শক।
এরপর দেবীর বোধনপর্ব। বোধন মানে বোধ শক্তির উন্মেষ। এই বোধ সম্পর্কেই শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন— ‘তোমাদের চৈতন্য হোক’। চরম লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপায়স্বরূপ আত্মশক্তির (চৈতন্যর) উদ্বোধন হওয়াই বোধন। ব্রাহ্মণ সাহিত্যে বিল্ববৃক্ষকে দেখানো হয়েছে সূর্যের প্রতীক হিসাবে ‘বিং জ্যোতিরিতি আচক্ষতে। তাই সূর্যকে সর্বশক্তির আধার মনে করে তাঁর নিকট মহাশক্তির আবাহন করা হয়।
বোধনের পরই দেবীর মহাস্নান। এই মহাস্নানের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে সমাজের পূর্ণাঙ্গ ছবি। যেখানে দেবীকে পঞ্চশস্য, পঞ্চরত্ন, পঞ্চকাষায়, দুগ্ধ-দধি, বিভিন্ন নদ-নদীর জল, পতিতালয়ের গৃহ মৃত্তিকা দিয়ে দেবীর মহাস্নান করানো হয়। এর মধ্যে দিয়ে সমাজের কৃষিসম্পদ, খনিজসম্পদ, বনজসম্পদ, গোরক্ষা, নদী সংযোগ প্রভৃতি সার্বিক সমাজ কল্যাণ চিন্তা ফুটে ওঠে। দেবী দুর্গার আর এক নাম শাকম্ভরী। সর্বজীবের প্রাণরক্ষার উপযোগী শাকের দ্বারা পৃথিবীকে পালন করেন বলেই দেবী শাকস্তুরী নামে পরিচিত। কারণ দেবী পূজার সঙ্গে সমাজকল্যাণ চিন্তাও অনুসৃত থাকে। সেইজন্য নবপত্রিকার পূজা মূলত একবীজ ও দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদ, দুর্বল ও সবল কাণ্ডযুক্ত একাধিক ঔষধি গুণসম্পন্ন উদ্ভিদের সমাহারে সম্পন্ন বনজ সম্পদের প্রতি ঐকান্তিক শ্রদ্ধা ও মানব স্বীকৃতির উজ্জলতম দৃষ্টান্ত। তাই, নবপত্রিকার আরাধনা।
এরপর মঙ্গলঘট স্থাপন করা হয়। এই একটি গভীর তত্ত্ব। আমরা জানি যে, মানুষের যেমন প্রথম আবির্ভাব ঘটে মাতৃগর্ভে অথাৎ প্লাসেন্টায়। সেইরূপ দেবতাদেরও প্রথম আবাহন করা হয়। মঙ্গলঘটে। ঘট মঙ্গল হওয়া কারণ, এই (দেহরূপ) ঘট দিয়েই মানুষ আত্মজ্ঞান লাভ করতে পারে। তাই, সেই ঘটটি স্থাপন করা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। সুতরাং, ঘট বা কলস দেবশক্তিরই প্রতীক। শিশু মাতৃভূমি স্পর্শ করার আগে যেমন সেই স্থানটিকে ডেটল, ফিনাইল প্রভৃতি ছিটিয়ে পরিশুদ্ধ রাখা হয়, সেইরূপ ঘট স্থাপনের পূর্বে বেদিটিকেও শোধন করা হয়। ঘটটি জলপূর্ণ করতে হয়। জলই জীবন বা প্রাণ। জলে তাই প্রাণশক্তির প্রতিষ্ঠা। মৃত্তিকার উপর পঞ্চশস্যাদি দিয়ে তদুপরি জলঘটটি স্থাপনা করা হয়। ঘটে পঞ্চরত্ন বা নবরত্ন অবশ্য দেয়, ঘটের মুখে পঞ্চপল্লব। তাই, তত্ত্বগুলোকে সূক্ষ্মদেহকে বিশেষভাবে ধরার জন্যই তদনুকল্পরূপে ঘটস্থাপন শাস্ত্রে বিহিত হয়েছে। এই পরিদৃশ্যমান স্থূলদেহ সূক্ষ্মদেহেরই ঘনীভূত বিকাশ বা অভিব্যক্তি। স্থলশরীর সূক্ষ্মে লীন হয়, সূক্ষ্ম শরীর আবার কারণশরীরে লীন হয়। তখন কারণাতীত ক্ষেত্রের দিকে অর্থাৎ শুদ্ধ আত্মার দিকে নিপতিত হয়। এইভাবেই জীব আত্মস্বরূপের সন্ধান পায়। ঘটের গায়ে সিন্দুরমূর্তি সূক্ষ্ম দেহেরই প্রতিরূপ। দেবপূজায় সূক্ষ্মদেহের অনুভবই বিশেষ প্রয়োজনীয়। হৃদয় থেকেই দেবশক্তির আবির্ভাব হয়। যতক্ষণ দেবতার উদ্দেশে অর্পিত পত্র পুষ্প প্রভৃতি উপচার স্বকীয় হৃদয়স্পর্শের অনুভূতিকে প্রকাশ করতে না পারে, ততক্ষণ বুঝতে হবে, যথার্থরূপে ঘটস্থাপন হয়নি। আত্মশ্রদ্ধা সহ পরমদেবতাকে স্কুলে এনে প্রাণ ও জ্ঞানশক্তির সাহায্যে মনকে সূক্ষ্মতত্ত্বে নিবদ্ধ রেখে ক্রমে স্কুল থেকে সূক্ষ্ম শরীরে, সূক্ষ্ম থেকে কারণশরীরে এবং কারণ থেকে কারণাতীত অবস্থা প্রাপ্ত হওয়াই মঙ্গলঘট স্থাপনের সার্থকতা। বেদে আছে – ‘যজ্ঞো বৈমহিমা’ ‘মহিমা’বা মঙ্গলঘট আসলে সূর্যেরই প্রতীক। বৈদিক যজ্ঞে যে তিনটি ঘটের উল্লেখ পাওয়া যায়, তাহলো একই সূর্যের তিনটি বিবর্তিত অবস্থামাত্র। সূর্যের তিন বিবর্তিত রূপ হলো প্রাতঃসূর্য, যার দেবী সরস্বতী, মধ্যাহ্ন সূর্য যার দেবী দুর্গা এবং সায়ংসূর্য যার দেবী লক্ষ্মী। অথাৎ প্রত্যেক জীবাত্মাকেই সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় বা সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক বা জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি—এই তিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যা পরবর্তীকালে ত্রিরত্ন বা ত্রিশক্তির প্রতীক হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। তারই প্রতিরূপ ঘটত্রয়। এই ত্রিশক্তিই মাতৃকারূপে পূজিতা হন মঙ্গলঘটে। যে কোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে তাই আমরা এই তিনটি ঘটের সহাবস্থান দেখতে পাই। প্রবেশদ্বারের দু’পাশে দুটো এবং মূল অনুষ্ঠানকেন্দ্রে পূজকের সামনে একটা। সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের প্রতীক ঘট বা পুণ্যকলস সৃষ্টি-স্থিতি-সংহারকারিণী মাতৃকারূপে পূজিতা হন। ঘটের উপরে ডাব বা নারিকেল দেওয়ার কারণ আমাদের বুদ্ধি বা জ্ঞানশক্তির স্থান যেহেতু মাথা। যেহেতু, মাতার প্রতীক হিসাবে ‘ডাব’ ঘটের উপরে থাকাই স্বাভাবিক। ঘটের গায়ে স্বস্তিক আঁকা থাকার কারণ স্বস্তিক চিহ্ন মূলত সূর্য বা বিষ্ণুর চক্রের প্রতীক হিসাবেই পূজিত হয়। নিয়ত পরিবর্তনশীল জগতের কেন্দ্রস্থলে ভগবান বিষ্ণু স্বয়ং অবস্থান করে সংসারী জীবকুলকে সকল অশুভ শক্তির হাত থেকে নিয়ত রক্ষা করেন বলেই স্বস্তিক মঙ্গলের প্রতীক।
ঘট স্থাপন ও নবপত্রিকা স্নানের পরই শুরু হয় দর্পণ প্রতিবিম্বে দেবীর মহাস্নানপর্ব। এই মহাস্নান-তত্ত্বটি বিদ্বদ্ নয়নে বিশ্বরূপ দর্শনের সমতুল্য। সামাজিক বা রাজনৈতিক দৃষ্টিতেও এই মহাস্নানের মধ্য দিয়ে প্রস্ফুটিত হয় সমাজের এক পূর্ণাঙ্গ সংহতির ছবি। এই মহাস্নানে দেবীকে পঞ্চশস্য (ধান, গম, যব, ভুট্টা, ডাল), পঞ্চরত্ন (সোনা, রুপা, তামা, ব্রোঞ্জ, হিরা), পঞ্চকাষায়— (জাম, বকুল, কুল, বেড়ালা ও শিমুল), পঞ্চগব্য- (দুধ, দই, ঘি, গোমূত্র, গোময়), শিশির, বৃষ্টির জল থেকে শুরু করে সপ্তনদী ও সপ্ত সাগরের জল, নদী মৃত্তিকা, পতিতালয়ের গৃহ মৃত্তিকা প্রভৃতি নানা উপাচার দিয়ে দেবীর মহাস্নান করানো হয়। এইসকল ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমাজের কৃষি-সম্পদ, খনিজসম্পদ, বনজসম্পদ, জল-সম্পদ, গোরক্ষা প্রভৃতি সার্বিক সমাজ কল্যাণ চিন্তা ফুটে ওঠে। নৈতিকতা স্থাপনে সর্বভূতজননী ওই দেবীরই অধিষ্ঠান স্বরূপ পতিতোদ্ধারের ভাবটিও ফুটে ওঠে। চাষাভুসা, মুচি-মেথর থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণ, মালী, কুম্ভকার, তন্তুবায়, নরসুন্দর, ঋষি, দাস সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ বিশ্ব সংহতি ও বিশ্বের কাছে এক অসাম্প্রদায়িক সম্প্রদায়ের সমন্বয়-বার্তা প্রেরণ করে। এইরূপ এক সঙ্বদ্ধ জাতিগঠন ও রাষ্ট্রভাবনা আমাদের মনে সংহতির মানচিত্র অঙ্কিত করে।
বিদ্বদ্ মননে গণপতি তত্ত্বটিও অপূর্ব। তাঁর পূজা প্রথম হওয়ার কারণ বিশ্বসৃষ্টির প্রথমেই যে শব্দটি উদগিরিত হয়েছিল সেটি হলো ওঁ-কার। গণেশের ওঁ-কার সদৃশ্য শুঙ্গ সেটিরই নির্দেশ দেওয়ার তাঁর পূজা সর্বাগ্রে করা হয়। দ্বিতীয় কারণ, তিনি জনগণের অধিপতি, তাই তিনি ‘গণপতি। আবার তিনি ‘গণানাম্ ঈশ্বরঃ– গণেশ’ অথাৎ জনগণের ঈশ্বর বা প্রভু। তৃতীয়ত, তিনি ব্যাসদেবের (ব্যাস-‘জ্ঞানী’ অর্থে) দক্ষ স্টেনোগ্রাফার। তাই তিনি লিপিকার গণেশ। এছাড়া যিনি ক্ষুদ্রের সঙ্গে বৃহতের, অভিজাতের সঙ্গে অবনতের মিলন ঘটিয়ে স্বকীয় গ্রীবাদেশে যুক্ত করেছেন, ধনী, অভিজাত, প্রজ্ঞাবান, পণ্ডিত, শক্তিমান নাগরিকদের প্রতীক হিসেবে বৃহৎশক্তিশালী গাম্ভীর্যপূর্ণ হাতির মাথাখানি, তিনিই আবার দরিদ্র, অবহেলিত, মুখ, দুর্বল, পরিশ্রমী, উপেক্ষিত ব্যক্তিদের প্রতীক। হিসেবে বাহন করেছেন অতি ক্ষুদ্র, ধৈর্যশীল, মূষিকপ্রবরকে অর্থাৎ যিনি ছোট বা বড়ো কাউকেই উপেক্ষা না করে ঐক্য ও সমন্বয়ের এক বিশ্বজনীন মূর্তি গড়ে তুলতে চান তাঁর আরাধনাই তো সর্বাগ্রে হওয়াই যুক্তিযুক্ত। এলিস গেটির মতে, গণেশের বড়ো দাঁত লাঙ্গলের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় তাঁকে কৃষির দেবতাও বলা হয়। বিষ্ণুর মতো গণেশেরও হাতে শঙ্খ-চক্র গদা ও পদ্ম। শব্দের প্রতীক শঙ্খ বা ডমরু, কালের (সময়ের) প্রতীক হিসাবে চক্র, সকল স্থলবস্তুর প্রতীক হিসেবে গদা, সকল কার্যের উৎপত্তিস্থলের আধারের প্রতীক হিসেবে পদ্ম (এই পদ্মই সনাতন হিন্দুধর্মের অন্যতম প্রতীক)। সুতরাং, সৃষ্টির আদিরূপ গণেশ। তার পূজাই সর্বাগ্রে হওয়া অভিপ্রেত। ভগবান বিষ্ণু হলেন সকল জীবের পালন ও রক্ষাকর্তা। গণেশও তাই। ঐতিহাসিক এলিস গেটির মতে, গণেশের গ্রীবা দেশে হাতির মাথা ও পাদদেশে বাহন মুষিক পশু-সংস্কৃতিকে স্মরণ করায়। আবার লাঙ্গলের মতো তাঁর একদন্ত কৃষির দেবতা বলেই অনুমিত হয়। তাঁর বাহনটি হলো অতি ক্ষুদ্র ও উপেক্ষিত প্রাণী মূষিক। মূষিক খুবই পরিশ্রমী। তাঁর দুটি তীক্ষ দাঁত বিবেক ও বৈরাগ্য। এই দুটি থাকলেই তাকে মান্স বলা যায়। অতএব, গণেশ তত্ত্বটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
আরও দুটি মূলতত্ত্ব হলো—কুমারীপূজা ও সন্ধিপূজা। সমাজে শুদ্ধ মাতৃভাব প্রতিষ্ঠাথেই দুর্গাপূজায় কুমারীকে ‘জ্যান্ত দুর্গারূপে প্রতিমার পাশে রেখে আরাধনার ব্যবস্থা। কারণ, শুদ্ধ, সাত্ত্বিকভাবে অন্তর পূর্ণ হলে তবেই বিশ্ব কলুষমুক্ত হতে পারে। সন্ধিপূজা হলো কুমারী পূজার সমাপন্তে অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণের ৪৮মিনিটের সন্ধিপূজার অনুষ্ঠানও এক মহাযজ্ঞ স্বরূপ। মহাশক্তি মহামায়া এখানে রণচণ্ডিকামূর্তিতে দণ্ডায়মান। তাই, তাঁর শ্রীচরণে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন করাই এই পূজার মূল উদ্দেশ্য। আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষণই সন্ধিপূজার সমতুল্য। কারণ, সব সন্ধিক্ষণেই বিরাজ করে মৃত্যুর অভিসার! উপায় হলো মহৎ ক্ষণটিকে ধরা।
পূজার অন্তিম দিনে ভক্তগণ পরমানন্দে সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন। সিঁদুর (লাল রঙ) যা অনুরাগের প্রতীক। পরমাত্মার প্রতি অনুরাগ বশতই এক জীবাত্মা অপর জীবাত্মার প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই আকর্ষণই অনুরাগরূপ সিঁদুর। জীবত্ব নাশ ও শিবত্বপ্রাপ্তিই দুগাৰ্তত্ত্বের মূল তাৎপর্য।
স্বামী ত্যাগিবরানন্দ
(লেখক সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম, কৈলাসহর, ত্রিপুরা)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.