‘পুত্রান্ দেহি’ পরিবর্তনের ভণ্ডামি

‘আপনি আচরি ধর্ম অপরে শিখায়’। কৃষ্ণদাস কবিরাজের ভাষায় শ্রীচৈতন্য এভাবেই সমাজ পরিবর্তন করেছিলেন। নিজেকে মহান প্রতিপন্ন করার জন্য আমি কি বলছি সেটা মানুষ বিশেষ গুরুত্ব দেয় না, আমি নিজের জীবন দিয়ে কি করছি, সেটাই সমাজ দেখে। আজকের সমাজে একটা বড় সমস্যা নারী ও পুরুষের সামাজিক বৈষম্য। কন্যাভ্রুণ হত্যায় এ রাজ্য দেশের অন্য প্রান্তের থেকে কোনও অংশে পিছিয়ে নেই। ইউনিসেফ প্রতি বছরই গ্রাম বাংলার মেয়ে বাচ্চাদের তুলনামুলকভাবে বেশি অপুষ্টির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধানের নিদান দিয়েছেন এ রাজ্যের সবচেয়ে এগিয়ে থাকা গোষ্ঠী। দুর্গাপুজোর মন্ত্র পালটে দাও, এখন আর ‘পুত্ৰান্ দেহি’ বলা যাবে না, বলতে হবে ‘সন্তানন দেহি’। গোটা দেবীপক্ষ জুড়ে চলল এই নাটক। যাঁরা জ্ঞানী, যারা গুণী, যাঁরা বিখ্যাত শিল্পী, তাঁরা বাইট দিয়েছেন। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। কাজ হতে বাধ্য। পুজোর শেষের দিকে ফলাফলও ঘোষণা হয়ে গেল। লন্ডন থেকে কলকাতা – সব্বাই অঞ্জলির মন্ত্র পালটে ফেলেছেন। বাঙালি আর ‘পুত্ৰান্ দেহি’ বলবে না।
কয়েক বছর আগে একটা বিষয় চর্চায় উঠে এসেছিল, কলকাতার এক নামকরা সংবাদমাধ্যমের মালিকানা নিয়ে। তাদের কোম্পানির নিয়ামক আইনে লেখা আছে যে, বংশের পুরুষরা কেবল পরিচালনের দায়িত্ব পাবেন। সংস্থা পরিচালনার যোগ্যতা আপনার যতই থাকুক। যদি আপনি মহিলা হন, তবে পরিচালনার দায়িত্ব পাবেন না। সেই সংবাদ সংস্থার মালিকপক্ষের সকলেই দেশে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে এসেছেন। একজন মানুষও এগিয়ে এসে বললেন না, আজকের যুগে নারীকে এভাবে বঞ্চিত করা যায় না। তাই শাপমোচন সম্ভব হল না। আচ্ছা, মালিকপক্ষকে না হয় ছেড়েই দেওয়া হল। যারা জ্ঞানী-গুণী, শিল্পী, সাহিত্যিক, প্রগতিশীল মানুষ, বাংলার সেই এগিয়ে থাকা সমাজ, তারাও তো বললেন না, এ অন্যায়! এ যুগের সভ্য সমাজে এ নিয়ম অচল। কেন? কোম্পানি পরিচালনার আইন অপরিবর্তনীয় বলে? আসলে দুর্গাপুজোর মন্ত্র পরিবর্তনের উপদেশ দেওয়া অনেক নিরাপদ। কিন্তু যে মালিকের নুন খেয়েছেন, তাঁদের দিকে আঙুল তোলা অসম্ভব। সকলেই সস্তা নাটকের কুশীলব। নারীকে প্রকৃত সম্মান দেওয়া এসবের উদ্দেশ্য নয়। আর অত্যাচারিতের পাশে দাঁড়ানোর প্রশ্নই ওঠে না। তার জন্য অনেক সাহস লাগে। সেই সাহস থাকলে তিন তালাকের মতো অমানবিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেন। তিন তালাকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চুড়ি পড়া মুষ্টিবদ্ধ প্রথম হাতটা তো কলকাতা থেকেই উঠেছিল। এনারা সেদিকে ফিরে তাকাবার ভুলটা করেন নি। আসলে প্রগতিশীলতা প্রমাণের জন্য। এনাদের বাবুরাম সাপুড়ের সেই বিশেষ প্রজাতির সাপ চাই। ‘করে নাতো ফোঁস-ফাস, খায় শুধু দুধভাত।’ এমন সাপ হল, চাল-কলা প্রত্যাশী বেচারা দুর্গাপুজোর পুরোহিত।
হিন্দু ধর্মে অপরিবর্তনীয় বলে কিছু নেই। স্থান, কাল, পরিস্থিতি হিসাবে ঋষিমুনিদের সময় থেকে রামমোহন-বিদ্যাসাগর পর্যন্ত যখন সমাজের প্রয়োজন হয়েছে, তখনই নিয়ম পরিবর্তিত হয়েছে। কলুষ ঝেড়ে ফেলে নতুন মানবিক রূপ গ্রহণ করেছে। আজকের সমাজে সন্তান ছেলে না মেয়ে, তার ওপর খুব একটা নির্ভর সত্যিই করে না। যে মানুষটি দুর্গাপুজোর মন্ত্র বলার সময় তার অর্থ সঠিকভাবে বুঝে বলতে পারবেন, তিনি জানেন যে আজকের ভারত বর্ষে লেখাপড়া থেকে ক্রীড়াজগৎ অনেক জায়গাতেই ভারতের মেয়েরা ছেলেদের থেকে অনেক এগিয়ে। আধুনিক দুনিয়াদারিতে ইন্টেলিজেন্স কোশেন্ট (আই কিউ) থেকে বেশি লাগে ইমোশনাল কোশেন্ট (ই কিউ), আর এই দৌড়ে মেয়েরা অনেক এগিয়ে থাকে। তাই ম্যানেজমেন্টের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলি ধীরে ধীরে মেয়েদের দখলে যাচ্ছে। বাবা-মায়ের প্রতি কর্তব্য ছেলে কিম্বা মেয়ে, সকলেরই থাকে। তবে আজকের বাবা-মায়েরা একটু হলেও মেয়েদের ওপরেই বেশি ভরসা করেন। হিন্দুধর্ম মূলত, ব্যক্তি সাধনার। তাই নাটমন্দিরে নয়, আসল উপাসনা গর্ভগৃহেই হয়। তাই কেউ দুর্গাপুজোর অঞ্জলি দেওয়ার সময় বিশেষ করে কন্যা সন্তানই চাইতে পারেন। সেটা ভক্ত আর ভগবানের সম্পর্ক। তাই ওই পুত্রান দেহি মন্ত্রের জন্য নারী বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাচ্ছে তার কোনও অর্থ নেই। যে মন্ত্রটি নিয়ে এত আপত্তি, সেটি কালিকাপুরাণোক্ত দুর্গাপুজোর দুর্গাস্তুতি। “ওঁ আয়ুৰ্দেহি, যশোদেহি, ভাগ্যং ভবতি দেহি মে। পুত্ৰান্ দেহি, ধনং দেহি, সৰ্বান কামাংশ্চ দেহিম।” ‘অনুষ্টুপ ছন্দে লেখা কালিকাপুরাণের এই শ্লোক বাঙালি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শুনেছে। কালিকাপুরাণের উল্লেখ কালিদাস বা মাঘের রচনাতেও আছে। এত বছরের পুরাতন শ্লোকও পরিবর্তন হতে পারে, যদি সত্যিই সমাজের যথেষ্ট ক্ষতি করে। কিন্তু এই এগিয়ে থাকা পণ্ডিতের দল ‘পুত্রান্’ শব্দের বদলে সন্তানন্ করেছেন। ছন্দের বাবা আর মায়ের একসঙ্গে গঙ্গাপ্রাপ্তি হয়েছে সেখানে!
যুগটা নিজের ঢাক নিজে পেটানোর। তাই লক্ষ লক্ষ টাকা খরচের পরে সমাজের উপর তার কতটা প্রভাব পড়েছে, সেটা বড় কথা নয়। ধ্বনিবর্ধক যন্ত্রটা কার হাতে আছে, সেটাই আসল বিষয়। তাই কলকাতা থেকে লন্ডন সর্বত্র নাকি সাড়া ফেলেছে এই ছন্দহীন বকচ্ছপ পরিবর্তন। এ বছর পুজো শেষ। আর নিশ্চিতভাবে বলা যায় আগামী বছরেও বাঙালি তার আবহমান কাল থেকে বলে আসা শ্লোক উচ্চারণ করেই মা দুর্গার কাছে ফুটফুটে একটি কন্যা সন্তান প্রার্থনা করবে।
মা আবার এক বছর পরে আসবেন। এক বছরটা অনেকটা সময়। শ্রদ্ধেয় যে সব মানুষ, শিল্প-সাহিত্যের নামীজন, এই ‘পুত্রান দেহি’ মন্ত্র পরিবর্তনের জন্য তাঁদের অমূল্য সময় দিয়েছেন, তাদের কাছে একটা অনুরোধ আপনারা ডাক দিন, বাংলার যে সব সংস্থা এমন নারীবিদ্বেষী নীতিতে পরিচালিত হচ্ছে, তাদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে।
যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা দেশের বর্তমান আইন, দ্য হিন্দু সাকশেসন (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট ২০০৫ হিসাবে নিজেদের না সংশোধিত করছে, ততদিন পর্যন্ত কোনও গুণীজন সেখান থেকে এক পয়সাও সাম্মানিক গ্রহণ করবেন না। কোটি টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিতে হবে না, কাগজের এক কোণে এক কলাম বিজ্ঞাপনে তাদের সংস্থার শাপমোচনের কথা ঘোষণা করুন ১৪২৭ বঙ্গাব্দের দুর্গাপুজোর মহাষষ্ঠীর সকালে। নিজেরা আচরণ করলে দেখুন ওই ছোট্ট বিজ্ঞাপনে বাংলার সমাজে কত গভীর প্রভাব পড়ে। দুর্গাস্তুতির সময়োপযোগী ছন্দ অনুসারী পরিবর্তনের কথা না হয় তারপরের বছর ভাবা যাবে।
জিষ্ণু বসু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.