যখন যেটা মনে আসে তিনি দুম করে বলে দেন। আগু পিছু, সাত-সতেরো, শব্দ-ব্যাকরণ সব সময়ে যে ভেবে বলেন এমন নয়! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এরকমই! সেটাই অ্যাদ্দিন তাঁর রাজনীতির পুঁজিও ছিল।
কিন্তু এখন আবহাওয়া খারাপ। পরিস্থিতিও সুখকর নয়। বিধানসভা ভোটের আগে তৃণমূলের রাজনৈতিক কৌশল স্থির করতে তাই এখন দিদি-কে প্রশান্ত কিশোরের পেশাদার সংস্থার সাহায্য নিতে হচ্ছে। এবং তৃণমূল শীর্ষ সূত্রেই খবর, সেই প্রশান্ত কিশোর সম্প্রতি দিদি-র সঙ্গে দেখা করে বলেছেন, আপনি কোনও বিষয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেবেন না। অন্তত তিন মাস চুপ থাকুন। সরকারি অনুষ্ঠানে, জনসভায়, দলের কর্মিসভায় বক্তৃতা দিন। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে, দুম-দাম জবাব দেওয়ায় আপাতত বিরতি দিন। সেই সঙ্গে দলের কর্মিসভায় আপনার বক্তব্য সরাসরি সম্প্রচারও বন্ধ রাখুন।
গোড়াতেই বলে রাখা ভাল, প্রশান্ত কিশোর দিদি-কে যে এ কথা বলেছেন তৃণমূলের কোনও শীর্ষ নেতা তা প্রকাশ্যে স্বীকার করেননি। তবে ঘরোয়া আলোচনায় এর সত্যতা অনেকে স্বীকার করছেন। তা ছাড়া এই কৌশলের প্রতিফলনও দেখা যাচ্ছে দিদির কাজ কর্মে। যেমন, আগে নবান্ন থেকে বেরোনোর সময় মাঝে মধ্যেই সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতেন মুখ্যমন্ত্রী। কেউ অপ্রিয় প্রশ্ন করলেও উত্তর দিতেন বা না দিয়ে বকা ঝকা করতেন। কিন্তু গত দশ-বারো দিন ধরে তাও বন্ধ হয়ে গেছে। তবে সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আড্ডা বন্ধ করেননি দিদি। তা তাঁর সময় সুযোগ মতো চলছেই।
তৃণমূলের একাধিক নেতার কথায়, লোকসভা ভোটের ফলাফল দেখার পর দিদি স্বাভাবিক ভাবেই বিরক্ত ছিলেন। সেই কারণে কালীঘাটে সাংবাদিক বৈঠকে তিনি সংখ্যালঘু ভোটের প্রশ্নে বলে ফেলেন, ‘যে গরু দুধ দেয়, তার লাথিও খাব’। এ কথা বলার পিছনে রাজনৈতিক ভাবনায় ভুল ছিল না। কিন্তু উপস্থাপনা হয়তো ঠিক হয়নি। আবার ভোটের আগে পুলওয়ামার ঘটনা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যখন বলেছিলেন, “কোনও রকম তদন্ত ছাড়াই কাউকে দোষারোপ করা ঠিক হচ্ছে না”। তখন সেই কথাটিও মানুষ হয়তো ভাল ভাবে নেননি। অথচ মুখ্যমন্ত্রী আসলে বোঝাতে চেয়েছিলেন, পুলওয়ামার ঘটনা কি আকস্মিক ভাবে হলো? নাকি আগাম গোয়েন্দা তথ্য থাকার পরেও স্রেফ ভোটে সুবিধা নেওয়ার জন্য ওই ঘটনা ঘটতে দেওয়া হলো?
তৃণমূলের ওই নেতাদের কথায়, মমতার রাজনৈতিক ভাবনা বা কৌশলে ভুল ছিল না। কারণ, পরবর্তী কালে কংগ্রেস সহ সব বিরোধী দলই সেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিল। কিন্তু শব্দ চয়নে বা ভাষার প্রয়োগে ভুল হয়েছে। হতে পারে এ ভাবে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেওয়া বন্ধ করতে বলেছেন প্রশান্ত কিশোর।
সূত্রের খবর, শুধু এই পরামর্শ দেননি প্রশান্ত। তাঁর এও পরামর্শ যে বিধানসভা ভোট পর্যন্ত ইতিবাচক রাজনীতি করুক তৃণমূল। সরকার ও দল উন্নয়নের কথা বলুক। কারণ, প্রত্যন্ত ও প্রান্তিক এলাকাতেও গত আট বছরে যে উন্নয়নের কাজ হয়েছে তা স্রেফ নেতিবাচক রাজনীতির জন্য হারিয়ে যাচ্ছে। খাদ্য সাথী, কন্যাশ্রী, সবুজ শ্রী ইত্যাদি প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার যে উপভোক্তা শ্রেণি তৈরি করেছে, তাদের অনেকের ভোটও শুধু নেতিবাচক রাজনীতির জন্যই তৃণমূল পায়নি।
তৃণমূলের কয়েক জন নেতার মতে, নেতিবাচক রাজনীতির আরও কিছু দৃষ্টান্ত রয়েছে গত কয়েক বছরে। যেমন, বিধানসভা ভোটে একা ২১১ টি আসন তৃণমূল জিতলেও বাংলাকে বিরোধী শূণ্য করতে নেমে পড়ে। কংগ্রেস ও সিপিএম থেকে একের পর বিধায়ক, কাউন্সিলর ভাঙিয়ে আনা হয়। এতে দলের মন্দ বই ভাল হয়নি। তা ছাড়া পঞ্চায়েত ভোটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বারো আনা আসন জেতার চেষ্টাও ইতিবাচক ছিল না। তাতে সামগ্রিক ভাবে এই বার্তাই গিয়েছে যে বাংলায় গণতন্ত্র নেই। সেই নেতিবাচক ভাবমূর্তিই কাটানোর এখন চেষ্টা হচ্ছে। এবং অনেক দিন পর এ বার এই প্রথম বিধানসভার অধিবেশনও অনেক দিন ধরে চলছে।