ভোট চলাকালীন একটি খবর প্রকাশ্যে এসেছিল যে তৃণমূলের জল্লাদ বাহিনী জলপাই পোশাক পরে তৈরি হচ্ছে। বুঝতেই পারছেন কেন্দ্রীয় আধা-সামরিক বাহিনী, জওয়ানদের সঙ্গে এই পোশাকের সাদৃশ্য রয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতি নিয়ে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব বারবার অসন্তোষ ব্যক্ত করেছে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে বুথে বুথে তৃণমূল সিভিক ভলেন্টিয়ারদের নিয়োগ করেছিল, যাদের চাকরি দেওয়া হয়েছিল তৃণমূলের আমলে এবং তৃণমূলের ক্যাডার হওয়াই ছিল যাদের যোগ্যতার মাপকাঠি। এদের নিরাপত্তায় রাজ্যের সাধারণ মানুষ গত পঞ্চায়েতে ভোট দিতে না পারলেও, তৃণমূলের জল্লাদ বাহিনী ‘অবাধে ভোট দিয়েছিল। প্রায় অর্ধেক আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা, আর বাকিগুলির অধিকাংশতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ না দিয়ে জিতে গিয়েছিল তৃণমূল।
কিন্তু বছর ঘুরতে পরিস্থিতিটা আমূল পল্টেছে, বুথে বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতির সম্ভাবনায় আতঙ্কিত তৃণমূল তাদের জল্লাদ বাহিনীকে ওই ধরনের পোশাক পরিয়ে ‘ক্যামোফ্লেজ’করতে চেয়েছিল, রাজ্যের সাধারণ ভোটারদের ভয় দেখানো ব্যতীত ৪২-এ ৪২-র স্বপ্নে বিভোর তৃণমূলের ভাগ্যে যে একটাও আসন জুটবে না, মমতা ব্যানার্জির চেয়ে ভালো আর কে-ই বা জানে। তাই সারা দেশে নির্বাচন যখন উৎসবের মেজাজে হচ্ছে, তখন কংগ্রেস সিপিএম শূন্য পশ্চিবঙ্গে একমাত্র বিরোধী বিজেপির কর্মীরা বুক ঠুকে আসরে নেমে তৃণমূলের হাতে মার খাচ্ছে ভোটের প্রতিটি দিন। মমতা ব্যানার্জির যথেষ্ট ক্ষোভ রয়েছে নির্বাচনে কমিশনের প্রতি, কেন তারা সর্বোচ্চ সাত দফাতে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন করছে, কেন প্রতি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী ইত্যাদি বিষয়ে।
সারা ভারতের ভোট উৎসবের চিত্রটার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের চিত্রটা মেলালেই বোঝা যাবে পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ নির্বাচনী পর্যবেক্ষক অজয় নায়েক কেন দশ বছর আগের অশান্ত বিহারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের তুলনা করেছেন। এও বোঝা যাচ্ছে কেন কেন্দ্রীয় বাহিনী ছাড়া নির্বাচনের কাজে যেতেসরকারি চাকুরিজীবীরা ভয় পাচ্ছেন, বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। ২০১৬-য় রায়গঞ্জে রাজকুমার রায়ের অভিজ্ঞতার টাটকা ক্ষত এখনও যে তাঁদের মনে। এর পরেও প্রথম দফায় অধিকাংশ বুথেই ছিল না কেন্দ্রীয় বাহিনী। মাত্র দু’টি আসনের লোকসভা ভোটে তাই অবাধে বুথ দখল আর ছাপ্পা ভোটের কারবার চালিয়েছে। তৃণমূলের ভোট লুঠেরা। সিতাইয়ে ভিভিপ্যাট (অর্থাৎ আপনি কাকে ভোট দিয়েছেন, যে যন্ত্রের সাহায্যে বোঝা যায়) ভাঙচুরের ঘটনা থেকে শুরু করে, দিনহাটায় বিরোধী দলের পোলিং এজেন্টদের বুথ থেকে বের করে দেওয়া, সারাদিন শাসক দলের দাপাদাপিতে সাধারণ মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার কেমনভাবে প্রয়োগ করতে পেরেছেন তা বোঝাই যাচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে কোচবিহারের বিজেপি প্রার্থী নিশীথ অধিকারীকে তিনশো বুথে পুনর্নির্বাচন চেয়ে জেলাশাসকের দপ্তরের সামনে ধরনাতে পর্যন্ত বসতে হয়েছিল।
দ্বিতীয় দফাতেও ছবিটা বিশেষ বদলায়নি। এই পর্যায়েও অল্প আসন— রায়গঞ্জ, দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি। বিক্ষিপ্ত হিংসা, অশান্তি অব্যাহত ছিল। বুথ দখল, ভোট জ্যাম, ছাপ্পা প্রতিটা কেন্দ্রেই কোথাও না কোথাও তৃণমূলি গুন্ডারা সংঘটিত করেছে। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে। প্রথম দু’দফার ভোটে অর্ধেকেরও কম বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন ছিল, কিন্তু একমাত্র বিরোধী হিসেবে বিজেপির সংগঠন শক্তিশালী হওয়ার দরুন প্রতিরোধের কিছুটা সুযোগ অন্তত পাওয়া গিয়েছিল। তবুও সামগ্রিক চিত্রটা বেশ হতাশাজনক। তৃণমূলের ভয়ে ঘরবন্দি ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে পৌঁছে দিচ্ছেন এক সাংবাদিক, এমন দৃশ্যও টেলিভিশন চ্যানেল আর সোশ্যাল মিডিয়ার সৌজন্যে রাজ্যবাসী দেখেছেন। এর জন্য সংশ্লিষ্ট চ্যানেল কর্তৃপক্ষের রোষে সেই সাংবাদিকটি পড়বেন কিনা সেটা সময়ই বলবে, কিন্তু গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তরের অবক্ষয়ের যুগে এই চিত্র বেশ আশাব্যঞ্জক। দুর্ভাগ্য হলো, যে কাজটা করার ছিল স্থানীয় প্রশাসন ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর, কিন্তু শাসকদলের প্রতি প্রশাসনের আনুগত্য ও বাহিনীর অনুপস্থিতিতে এক কাজটা একজন অত্যন্ত স্বল্পক্ষমতাসম্পন্ন সাংবাদিককে অসীম সাহসিকতায় সম্পন্ন করতে হচ্ছে। ফলে সার্বিক পরিস্থিতির ভয়াবহতা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
প্রথম দু’দফার অভিজ্ঞতা থেকে তৃতীয় দফায় কমিশন আরেকটু সচেতন হয়। নব্বই শতাংশ বুথেই কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন হয়। কিন্তু তৃণমূলের প্রকৃত স্বরূপ এই ভোটপর্ব থেকেই প্রকাশ পেতে থাকে। এই প্রতিবেদন যখন লেখা হচ্ছে তখন ষষ্ঠ দফা ভোটপর্ব মিটে গিয়েছে। তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ— এই চার দফায় শাসক দলের হিংসার যে নমুনা দেখা গিয়েছে, সপ্তম দফাতেও তা বজায় থাকবে আশঙ্কা করা যায়। সেই সঙ্গে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম গণতন্ত্রের একটি অঙ্গরাজ্যে গণতন্ত্র কীভাবে ভূলুণ্ঠিত হলো তার সাক্ষী থাকবে ইতিহাস।
তৃতীয় দফার ভোট ছিল বহরমপুর বাদে মুর্শিদাবাদ, উত্তর ও দক্ষিণ মালদা ও বালুরঘাটে। মুর্শিদাবাদেকংগ্রেসের কিছুটা শক্তিশালী, অধীর চৌধুরীর সৌজন্যে। শাসকের হামলায় ভগবানগোলায় নিহত হন এক কংগ্রেসকর্মী। এবারের লোকসভা নির্বাচনের দিন প্রথম প্রাণ হারান দলীয় কর্মী। ডোমকলে মুড়ি-মুড়কির মতো বোমা পড়তে থাকে, ডোমকল এমনিতেই অশান্ত এলাকা। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই এলাকায় বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরাও যথেষ্ট পরিমাণে আছে, কখনও তৃণমূল, কখনও কংগ্রেস, যখন যেখানে সুযোগ পায় আশ্রয় নেয়। রাজনৈতিক দলগুলি যতদিন না এদের প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করবে, ডোমকল-সহ গোটা মালদা-মুর্শিদাবাদে ভারতীয় ভোটাররা অবাধে, শান্তিতে যে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন না, তা ডোমকল দেখিয়ে দিয়েছে। মালদায় ইভিএম ভেঙেছে তৃণমূল। অশান্তি হয়েছে বালুরঘাটেও। তপনে তৃণমূলের হাতে বিজেপি কর্মী নিগৃহীত। পুলিশ দর্শকের ভূমিকায় ছিল। স্থানীয়রা প্রতিবাদে নামলে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয় পুলিশ।
চতুর্থ দফাতেও নির্বাচনী হিংসা মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। এই পর্বে বহরমপুর, কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, বর্ধমান (পূর্ব), বর্ধমানদুর্গাপুর, আসানসোল, বোলপুর, বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রে ভোট হয়। এর মধ্যে দুটি আসন বিরোধীদের দখলে, বাকিগুলিতে কোনওটাতেই তৃণমূল সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। সাংসদ ও মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়র গাড়ি ভাঙচুর হয়, তাঁর পোলিং এজেন্টকে মারধর করা হয়। এই অশান্তির পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক বক্তব্য রেখেছেন বাবুলের প্রতিপক্ষ মুনমুন সেন। সকাল থেকে তার দাঁড়ানো কেন্দ্রে অশান্তি, অথচ তিনি কী করছেন, সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে অকপটে দুপুর নাগাদ মুনমুন জানিয়ে দেন, হোটেলে তার বেড-টি দিতে দেরি হয়েছে, তাই ঘুম ভাঙেনি, যে কারণে কোনও গণ্ডগোলের খবর তিনি রাখেন না। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
পরিস্থিতি এতটাই অগ্নিগর্ভ হয়েছিল যে, কালনায় খোদ বিজেপি প্রার্থী পরেশচন্দ্র দাস তৃণমূলি দুষ্কৃতীদের হাতে আহত হন। পূর্বস্থলীতে পাল্টা প্রতিরোধ করেন বিজেপি কর্মীরা। বীরভূমের বিভিন্ন কেন্দ্রে বিজেপি সমর্থকদের ভোট দিতে বাধা দেয় অনুব্রতর গুন্ডারা।নানুরের রাস্তায় নেমে পড়ে মা-বোনেরা তৃণমূলি দুষ্কৃতীদের সন্ত্রাস রুখতে চেষ্টা করেন। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে দুবরাজপুরে শূন্যে গুলি চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। দুর্গাপুরেও কয়েকদফা সংঘর্ষেবিজেপি কর্মীরা গুরুতর জখম হন। সব মিলিয়ে চতুর্থ দফা ভোটের দিন সরকারি হিসেবে মোতাবেক এফআইআর হয়েছে ৬টি, গ্রেপ্তার ১৪৫; অভিযোগ এসেছে ৬০০টি, আহতের সংখ্যা ৫। এই অশান্তির রেশ ভোটের পরের দিনও অব্যাহত ছিল। বোলপুরে তৃণমূল-বিজেপি সংঘর্ষ, বর্ধমানে র্যাফ নামানো, দুর্গাপুরে বিজেপির ওপর হামলায় আহত অন্ততপক্ষে কুড়ি, মঙ্গলকোটে বিজেপি কর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে স্থানীয় জনজাতিদের পথ অবরোধ, নাদনঘাটে বল্লম নিয়ে মহিলাদের পর্যন্ত তৃণমূলিদের আক্রমণ, আউশগ্রামেও অশান্তি হয়।
পঞ্চম ও ষষ্ঠ দফার অশান্তি অবশ্য সবকিছুকে টেক্কা দিয়েছে। এই দুই দফার অশান্তির ক্ষত রাজ্যবাসীর মনে এখনও টাটকা। একদা এলাকায় যাদের দোর্দণ্ডপ্রকাপ ক্ষমতা প্রদর্শন চলত সেই ব্যারাকপুরে অর্জুন সিংহ, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল লোকসভার অন্তর্গত কেশপুরে ভারতী ঘোষ যথাক্রমে পঞ্চম ও ষষ্ঠ দফায় শাসকদলের রোষের মুখে। পড়েছিলেন, শুধু তাই নয় বিরোধী এজেন্টকে বসতে না দিয়ে। ভারতীর ক্ষেত্রে অবস্থা তো আরও নক্কারজনক। তাকে নানা অজুহাতে ভোটের আগে থেকেই বিভিন্ন জায়গায় আটকানোর চক্রান্ত হয়েছিল। ভোটের দিন তার গাড়ি পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হয়। যারা নীতিমতো উল্লসিত বোধ করছেন ভারতী কিংবা অর্জুনের ঘটনায়, তারা হয়তো বোঝেন না বা বুঝতে চান না, তৃণমূল শাসকের ক্ষমতার দম্ভে ভারতী কিংবা অর্জুন ছিলেন প্রতীক মাত্র। তারা ভিন্ন পথে হাঁটতে অত্যাচারী শাসক আজ প্রতিশোধ স্পৃহায় মেতেছে। সুস্থ গণতন্ত্রের পক্ষে এই প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব কী বিপদজ্জনক আকার ধারণ করতে বাম-জমানা তার প্রমাণ। তৃণমূল জমানাও সেই একই পথের শরিক।
মজার ব্যাপার হলো, যাঁরা তাত্ত্বিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব তাদের আমলেই সবচেয়ে বেশি মাত্রায় প্রতিফলিত হয়েছিল, সেই বামেরা অর্জুন-ভারতীর ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব দেখিয়ে প্রকারান্তরে তৃণমূলের গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধকে সমর্থন করেছেন। পঞ্চম দফার নির্বাচনে হাওড়া-হুগলিতে বিজেপি কর্মীরা ভোটের আগে থেকে ভোটের দিনও যথেচ্ছ আক্রান্ত হয়েছেন। হুগলিতে লকেট চট্টোপাধ্যায়, হাওড়ায় রন্তিদেব সেনগুপ্তের লড়াকু মনোভাবে অত্যাচার কিছুটা ঠেকানো গেলে পঞ্চম দফার নির্বাচনে দিনের শেষে হিসাব এফআইআর-এর সংখ্যা ৫, গ্রেপ্তারি ৪২, অভিযোগ এসেছে ২৫৬০টি, আহতের সংখ্যা ১৪।ষষ্ঠদফায় আহত হয়েছেন ২৬ জন, গ্রেপ্তার ১৬ জন। এই দফায় দুই মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া জেলায় ভোট ছিল। ভোট শুরুর আগেই ঝাড়গ্রামের গোপীবল্লভপুরে বিজেপির বুথ সভাপতিকে খুন হতে হয়। তৃণমূলি দুষ্কৃতীদের হাতে ইতিপূর্বে নিহত পুরুলিয়ার শিশুপাল মাহাতোর বাড়িতে বাবা, দাদাকে লক্ষ্য করে ভোট পর্ব চলাকালীন হামলা চালায় তৃমমূলীরা।
সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা। সব দেখেও চোখে ঠুলি এঁটে তারা হিংসা-দ্বীর্ণ নির্বাচনকে ‘অবাধ, শান্তিপূর্ণ বলে দিচ্ছেন। কেন্দ্রীয় বাহিনী একশো শতাংশ বুথেই থাকার কথা থাকলেও কার্যক্ষেত্রে তাদের উপস্থিতি চোখে পড়ছে না বলইে অভিযোগ। এও মনে হচ্ছে যে তৃণমূলের তঁাবে থাকা এ রাজ্যের প্রশাসনিক আধিকারিকেরা নির্বাচন কমিশনকে বিপথে চালিত করছেন।
অভিমন্যু গুহ
2019-05-17