রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা ও শিষ্টাচারের অভাব – নাকি ক্ষমতা হারানোর আতঙ্ক

ডিসেম্বর মাসের দশ তারিখে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতির কনভয়ের ওপরে বর্বরোচিত আক্রমণ এবং তারপর রাজ্য প্রশাসনের ক্ষমতায় থাকা তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মানসিক অবস্থার ওপরে। “বদলা নয় বদল চাই” অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় আসা তৃণমূল কংগ্রেস এর শাসনকালে এ রাজ্যে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার যতগুলো ঘটনা ঘটেছে তা বাস্তবিকই বাম আমলের অসংখ্য রাজনৈতিক অত্যাচারের ইতিহাসকে পশ্চিমবঙ্গের জনমানসের স্মৃতি থেকে মলিন থেকে মলিনতর করেছে। আর শিষ্টাচারের দায় যে আমাদের রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের নেই তা তারা তাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ক্রমাগত বুঝিয়ে চলেছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রীকে তুই তোকারি থেকে আরম্ভ করে দড়ি বেঁধে ঘোরানো – কোনো কিছুই যেখানে বলতে বাকি রাখা হয় না, সেখানে রাজনৈতিক শিষ্টাচারের সন্ধান করতে যাওয়া মরীচিকার ভ্রম বৈকি। বর্তমানে তৃণমূলএর রাজ্যসভার সাংসদ ও তৎকালীন বিধায়ক মানস ভুঁইয়াকে আমরা মঙ্গলকোট এ ধুতি তুলে প্রাণভয়ে দৌড়ানোর দৃশ্য সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে আমরা অনেকেই দেখেছি। তাঁকেই আমরা দেখেছি খুনের মামলায় জড়িয়ে দিতে এবং শেষমেষ তৃণমূলে যোগদান করে তাঁর আপাত মধুরেণ সমাপয়েৎ। এরকম বহু ঘটনার সাক্ষী আমাদের এই গত এক দশকে হতে হয়েছে। ছলে, বলে, কৌশলে বিরোধী শূন্য রাজনৈতিক পরিসর তৈরির এই প্রচেষ্টার ছত্রে ছত্রে জড়িয়ে রয়েছে ক্ষমতার মোহ। যার পরিণতি আজ পশ্চিমবঙ্গের আইনের শাসনের প্রায় পঞ্চত্ব প্রাপ্তি। বিয়াল্লিশ এ বিয়াল্লিশ স্লোগান তোলা তৃণমূল কংগ্রেস গত লোকসভা ভোটে প্রায় হাফ হয়ে যাবার পরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ গোটা তৃণমূল দলটার একটা হাঁটুকাঁপার যন্ত্রনা শুরু হয়ে গিয়েছিলো। ডাক্তার হিসেবে ভাড়া করে নিয়ে আসা হলো কর্পোরেট ভোট ম্যানাজার প্রশান্ত কিশোরকে। তিনি হাঁটুর যন্ত্রণার উপশম করতে গিয়ে খাইয়ে দিলেন কুইনিন ওষুধ। বরিষ্ঠ রাজনীতিবিদদের তিনি এমন পরিচালনা করলেন যে অধিকাংশ নেতারাই গাওয়া আরম্ভ করলেন বেসুরো। অনেকেই এই অপশাসনের হাত থেকে মুক্তি লাভের আশায় নাম লেখালেন বিজেপিতে গিয়ে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিহিংসা পরায়ণ রাজনীতির সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা অনেকে আবার ভোটের দিন ঘোষণার দিন গুনছেন – যেদিন থেকে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের তত্বাবধানে সরকার চলা শুরু করবে। বস্তুত ২০২০ সাল যেমন বাস্তবিকই সারাবিশ্বের জন্যই যেমন এক অভিশাপ নিয়ে এসেছে কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে এই সাল পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে সম্পূর্ণরূপে বেআব্রু করে দিয়েছে। শুধু কোভিড -১৯ সামলাতে গিয়ে রাজ্য সরকারের নাকানি চোবানি ও পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যে না ঢুকতে দেওয়ার নির্লজ্জ প্রয়াস রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অন্তঃসার শূন্য অবস্থা প্রকট করে তুলেছে। আমফান পরবর্তী অচলাবস্থায় সামনে চলে এসেছে দুর্যোগ মোকাবিলায় রাজ্যের অক্ষমতা। কলকাতাবাসীর তিক্ত অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশের ভয়ে আজও কলকাতা কর্পোরেশনের ভোট করানোর সাহস আর এই সরকারের হয়ে ওঠেনি। প্রকাশ্যে এনে দিয়েছে সিইএসসির সঙ্গে শাসক দলের যোগসাজসে অত্যধিক ও ভুয়ো ইলেকট্রিক বিলের মাধ্যমে জনগণকে শোষণের চিত্র। থমকে পড়া অর্থনীতি সমূলে আঘাত করেছে কাটমানি ও তোলাবাজির ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা একটি দলকে। দলীয় তহবিল ও নেতাকর্মীদের পকেটে লুটের টাকা ঢোকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর চাতক পাখির মতো হাঁ করে থাকা দলীয় কর্মীরা শেষমেশ চাল,আটা, ত্রিপল থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন ত্রাণ সামগ্রী চুরিতেও জড়িয়ে পড়ে। আমফান দুর্নীতি নিয়ে শেষমেষ হস্তক্ষেপ করেছে কলকাতা হাইকোর্ট এবং ক্যাগকে দুর্নীতির তদন্ত করে তিন মাসের মধ্যে প্রাথমিক রিপোর্ট পেশ করতে নির্দেশ দিয়েছে। যা ভোটের আগে বিরোধীদের যে বাড়তি অক্সিজেন যোগাবে তা সন্দেহাতীত। হাইকোর্ট নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও সরকারি কর্মচারীদের বকেয়া ডিএ না দেবার পরিণতি যে ভোটবাক্সে দারুন ভাবে প্রতিফলিত হবে সে ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী নিজেও বোধহয় নিশ্চিত। সমস্ত নিয়মকে তোয়াক্কা না করে যেভাবে উচ্চ প্রাথমিকে যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে (কানাঘুষোয় সোনা যায় বহু টাকার বিনিময়ে) প্রচুর লোকের চাকরি হয়েছিল। এমন বহু তৃণমূল নেতাদের পরিবার রয়েছে যাদের বাড়িথেকে খুব সাধারণ মেধার একাধিক প্রার্থী চাকরি দখল করে বসে রয়েছে। আর যোগ্য প্রার্থীরা রাস্তায় বিক্ষোভ দেখতে গিয়ে তাদের কপালে জুটেছে পুলিশি অত্যাচার। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ে আজ সেই চাকরি বিশ বাওঁ জলে। বহু প্রার্থী যারা তৃণমূলের নেতাদের বড় বড় অংকের টাকা দিয়ে চাকরি বাগিয়েছে তারা এবারে টাকা তো ফেরত চাইবেই। ভোটের আগে সেই আতঙ্ক তারা করছে বহু নেতাদেরই। সামগ্রিক ভাবে পুলিশ মন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই খবর নিশ্চিতরূপে অবগত। তারই ধারাবাহিক প্রতিফলন ঘটছে যুগপৎ রাজনৈতিক হিংসা ও শালীনতার মাত্রা ছাড়ানোর মধ্যে দিয়ে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ভ্যাঙানো ও নির্লজ্জ মিথ্যে কথা বলা তাঁর বরাবরের অভ্যেস। শালীনতা বজায় রাখার সদভ্যাস তাঁর কোনোকালেই নেই, আজও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এর সঙ্গে তাঁর মাথায় চেপে বসেছে ক্ষমতা হারানোর আতঙ্ক। তাই ভারতবর্ষের তথা সমগ্র বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের সর্বোচ্চ নেতার কনভয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে তৃণমূল আশ্রিত গুন্ডাদের বর্বরোচিত আক্রমণের পরেও মাননীয়া নির্ভেজাল বলতে পারেন এটা বিজেপির নিজস্ব চক্রান্ত!! তাও আবার কিনা তাঁর অত্যন্ত বিশ্বাস ভাজন শওকত মোল্লার এলাকায়! সেই শওকত মোল্লা – যাকে উদ্দেশ্য করে প্রশাসনিক সভায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং পুলিশ মন্ত্রী বলেছিলেন “তুই তো সারাক্ষন বোমা বাঁধছিস”। শুধু চক্রান্তের কথাতেও থেমে না থেকে তিনি এরপর “চাড্ডা নাড্ডা গাড্ডা হাড্ডা ” এই সব চটুল মন্তব্য করে শুধু যে অশালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেলেন তাই নয়, ভারতবর্ষের জাতীয় সংহতির পক্ষেও এমন মন্তব্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। বিভিন্ন জাতি ধর্মের সংগমস্থল এই ভারতবর্ষের ইতিহাসে বোধহয় কোনোদিন কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি কারও পদবি নিয়ে এমন অপমানসূচক মন্তব্য করেননি।এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে বাঙালীদেরই। আমাদের সম্পর্কে এক ব্যঙ্গাত্মক ও নেতিবাচক ধারণা দেশের অন্যান্য রাজ্যে বসবাসকারীদের মধ্যে বদ্ধমূল করার দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছে এই তৃণমূল। যা ক্ষতি করার তা তো তিনি করেই ফেলেছেন, এবারে মুখ্যমন্ত্রীর উচিৎ ক্ষমতা হারানোর আতঙ্কে আরও ক্ষতি না করে বরং সকাল বিকাল তিনি যোগাভ্যাস করুন। মনকে শান্ত করুন। লোকে বলাবলি করছে ক্ষমতার এত দুর্ব্যবহার আপনি করেছেন, যে ক্ষমতা হারালে আপনি উন্মাদ হয় যেতে পারেন। তাই আগে থেকে মনকে শান্ত করলে রাজ্যের ও আপনার উভয়ের-ই মঙ্গল। নাহলে এরপরে ভোটের রেজাল্ট বেরোনোর পর জনতার আক্রোশ কিন্তু আছড়ে পড়বে আপনাদের ওপরে। অথচ আপনার বক্তব্য সোনার কেউ থাকবে না। কারণ সব মাত্রা তো আপনি আগেই পার করে দিয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.