একের পর এক কিডনি দান। তা কি অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করার স্বার্থে ? নাকি এর পিছনে রয়েছে কোনও অর্থের বিনিময়, সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে নদিয়ার তাহেরপুর থানার কালীনারায়ণপুর-পাহাড়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতের একাধিক বাসিন্দার কিডনি দান নিয়ে। সন্দেহের আরও একটি কারণ যাঁরা নিজেদের কিডনি দান করেছেন তাঁদের পরিবারের অনেকেরই নেই আর্থিক সচ্ছলতা। সকলেই অত্যন্ত দারিদ্রর মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। নেই তাঁদের পাকা ঘরও। যদিও বিষয়টি গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানের কানেও গিয়েছে। প্রধান নিজেই তদন্ত কমিটি গড়ে এই বিষয়ে তদন্ত করার দাবি তুলেছেন। এর পিছনে কিডনি পাচার চক্রের হাত থাকার সম্ভাবনার কথাও বলছেন গ্রামপঞ্চায়েত প্রধান। এমন ঘটনার অভিযোগ উঠেছে নদিয়ার তাহেরপুর থানার কালীনারায়ণপুর-পাহাড়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতের কালীনারায়ণপুর শর্মাপাড়া, মণ্ডলপাড়ায়। যদিও পুলিশ প্রশাসনের কাছে কিডনি বিক্রি করার কোনও খবর নেই।
মঙ্গলবার সন্ধেয় রানাঘাট মহকুমা পুলিশ প্রশাসনের একজন আধিকারিক জানিয়ে দিয়েছেন, “না, এমন কোনও খবর আমার জানা নেই।” তাহেরপুর থানার একজন পুলিশ আধিকারিক অবশ্য বলেছেন, “কিডনি বিক্রি করার কোনও প্রমাণ আমরা এখনও পাইনি। তদন্ত করছি। তবে যে ক’জনের কথা জানা গিয়েছে, তাঁরা নিজেদের কিডনি দান করেছেন বলে জানিয়েছেন। আমরা প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের আলাদাভাবে জিজ্ঞাসা করেছি। সবাই কিডনি দান করার কথাই বলেছেন। বিক্রির প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
যদিও শর্মাপাড়া গ্রামের একজন গৃহবধূ স্পষ্টই জানিয়েছেন, “আমাদের গ্রামের একজনের অসুস্থতার খবর আমি পেয়েছিলাম। তাঁকে আমার স্বামী কিডনি দিতে চেয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, না, আমি দেব। ওরা বলেছিল, সাড়ে চার লক্ষ টাকা দেবে। চার লক্ষ টাকা পেয়েছি। অবশ্য বাকি ৫০ হাজার টাকা আমি আর চাইনি।” যদিও ওই গৃহবধূর সঙ্গে কার মাধ্যমে যোগাযোগ হয়েছিল অসুস্থ পরিবারের বাড়ির লোকজনের, তা খোলসা করেননি ওই গৃহবধূ। বলেছেন, “আমি নিজেই যোগাযোগ করেছিলাম। কাগজপত্র ঘুরে ঘুরে তৈরি করেছিলাম। কলকাতার একটি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হয়।” বাদকুল্লার একটি জায়গায় কাজ করেন ওই গৃহবধূ। নিজেই জানিয়েছেন, “কাজের চাপ পড়লে মাঝেমধ্যে পেটে ব্যথা হয়।”
যদিও ওই গ্রামের বাসিন্দা দীপক বিশ্বাস নামে একজন নিজের কিডনি বিনামূল্যে দান করেছেন বলে জানিয়েছেন। থাকেন কাঁচা বাড়িতে। পরিবারে অভাবের ছাপ যথেষ্ট। কাপড় বোনেন। তিনি বলেছেন, “আমি টাকার বিনিময়ে নয়, দান করেছি আমার কিডনি।” যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে পুলিশের। তাই তদন্ত শুরু হয়েছে। সাধারণত আত্মীয়-পরিজন বা নিজেদের মানুষের মধ্যেই কিডনি দান হয়ে থাকে। থাকে আরও কিছু আইনি ব্যাপার। যদিও তাঁর স্বামী একজন আত্মীয়কে কিডনি দান করেছেন বললেও সেই আত্মীয়ের সঠিক পরিচয় জানাতে পারেননি দীপালী বিশ্বাস।
ওই গ্রামের বাসিন্দা পরিতোষ সরকার অবশ্য বলছেন, “এখানে ধীরে ধীরে অনেকেই নিজেদের কিডনি বিক্রি করছেন। এটা বন্ধ করা দরকার। আমি সবার কাছে এই আবেদন করছি। আর্থিক অবস্থা খারাপ হলেও এটা করা উচিত নয়। কারণ একজনকে দেখে অন্যজন তা করবে, প্রবণতা বাড়বে, এমন যেন না হয়। তবে যে ক’জন এমন কাজ করেছেন, তাঁরা কেউ কাজকর্ম করেন না। যদিও কাদের কাছে কিডনি দেওয়া হয়েছে, সেটা ওঁরাই বলতে পারবেন।” গ্রামের আর এক বাসিন্দা বিভাস শীল বলেন, “কাজ করে খেতে খাটনি হবে, তাই অর্থের লোভে পড়ে কিডনি বিক্রি করেছেন আমাদের গ্রামের কয়েকজন। স্বামী জুয়া খেলে, কিডনি বিক্রি করেছে তার স্ত্রী।”
এ বিষয়ে স্থানীয় গ্রামপঞ্চায়েত প্রধান দীপা দাস ঘোষ বলেছেন, “বিষয়টা আমি শুনেছি, আমাদের কানে এসেছে, এখানকার কয়েকজন মানুষ কিডনি বিক্রি করেছেন। অভাবের তাড়নায় বিক্রি করেছেন বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু অভাবের তাড়না সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কথা। কারণ, কয়েকদিন আগেও আমাদের গ্রামে তিনবার দুয়ারে সরকারের শিবির হয়েছে। যদিও তাঁরা এটা কেন করছেন, আমিও চাই এর তদন্ত হোক।