বন্ধ কারখানার মাঠে মোদী, ‘নিজের মেয়ে’ বনাম ‘শিল্পের খিদে’

হালফিলে সাহাগঞ্জে গিয়েছেন? ডানলপ কারখানার চৌহদ্দির মধ্যে?

দিনের আলো থাকতে থাকতেই যাওয়া ভাল। ভিতরের স্টাফ কোয়ার্টারগুলোয় দু-চার ঘরে এখনও লোকজন থাকে। কিন্তু মেন রোড থেকে ঢুকতেই গা ছমছমে ব্যাপারস্যাপার। যেন মৃত্যুপুরী! দু’দিকে অফিস বাড়িগুলোর দরজা জানালা আগেই চুরি হয়ে গেছে। হাসপাতালটারও তাই দশা। মূল কারখানার যন্ত্রপাতি-মেশিনে আগাছা বাইছে।

হাইস্কুলটা এখনও চলছে। তার লাগোয়া মস্ত মাঠটাতেই সোমবার ২২ ফেব্রুয়ারি সভা করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বাংলায় এ বার বিধানসভা নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রথম প্রচার সভা করেছেন শিল্পশহর হলদিয়ায়। দ্বিতীয় সভাটি হবে এ বার ডানলপ মাঠে।

এই এক আর দুইয়ে যদি মেলানো যায়, তা হলে দিব্যি দেখা যেতে পারে স্পষ্ট একটা অঙ্ক রয়েছে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহর মাথায়। হতে পারে কোনও সমীক্ষার ভিত্তিতে তাঁরা এমন কৌশল নিয়েছেন। কিংবা এমনিই পড়ে ফেলেছেন বাঙালি মন।

গত প্রায় তিন দশক ধরে বাংলায় শিল্পে খরা চলছে। অথচ স্বাধীনতাত্তোর সময়ে দেশে যখন ভারী শিল্পের পত্তন শুরু হয়, তার প্রথম গন্তব্য ছিল বাংলাই। বেসরকারি শিল্প সংস্থা ও রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সংস্থার সহাবস্থানে গুজরাতের বহু আগেই ভাইব্র্যান্ট ছিল গঙ্গার পশ্চিমকূল। পরে বাম শাসনে একের পর এক শিল্প সংস্থা প্রথমে রুগ্ন হয়ে যাওয়া পরে তালা ঝোলা নৈমিত্তিক ছবিতে পরিণত হয়। শিল্প আনতে জ্যোতিবাবুর বিদেশ সফর কিংবা অমিত মিত্রর জার্মানিতে গিয়ে বিএমডব্লিউর দফতরে যাওয়ার মতো ঘটনায় আখেরে যে কিস্যু যে হয়নি তাও হয়তো সিংহভাগ বাঙালিই বিশ্বাস করেন।

অনেকের মতে, বাংলায় এখন শিল্পের চাহিদা রয়েছে বললে হয়তো কমই বলা হবে, বরং বলা যেতে পারে তা চরম ক্ষুধায় পরিণত হয়েছে। বন্ধ শিল্প কারখানার স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ডানলপ, জেশপের মতো মৃত্যুপুরী। আর শুরুর আগেই মুখ থুবড়ে পড়ার স্মারক হয়ে রয়েছে সিঙ্গুর।

শিল্পায়নে এই স্থবিরতা নিয়ে বহু বাঙালির মনে যে অসন্তোষ রয়েছে তা হয়তো অনুধাবন করতে পারছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তাই ভোটের আগে দেউচা পাচামি, বা অশোকনগরের তেল নিয়ে যেমন ঘটা করে বলছেন, তেমন লজিস্টিক হাব গড়ে তোলার প্রস্তাবকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে।

পর্যবেক্ষক ও সমীক্ষকদের একাংশ মনে করছেন, দশ বছর ক্ষমতায় থাকার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের বিরুদ্ধে যে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা তৈরি হয়েছে তার অন্যতম উপাদান হল, শিল্পে খরা ও কর্মসংস্থানের অভাব। সেই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা থেকে মুখ ঘোরাতেই ‘বাংলা’ ও ‘বাঙালি’ এবং ‘বহিরাগতর’ মতো প্রাদেশিকতার রাজনীতিতে শান দেওয়া হচ্ছে। স্লোগান তোলা হয়েছে ‘বাংলার নিজের মেয়ে’।

কিন্তু নরেন্দ্র মোদীও যেন দুর্বলতার স্থানটিকে চিহ্নিত করে ফেলেছেন। গত ৭ ফেব্রুয়ারি হলদিয়ায় দাঁড়িয়েই তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, কী এমন হল যে বাংলা শিল্পে পিছিয়ে গেল? আর তাঁর সভার জন্য বিজেপি স্থান নির্বাচন করেছে যা একদা হুগলি তো বটেই গোটা বাংলার গর্ব ছিল।

ব্রিটিশ জমানায় গড়ে উঠেছিল ডানলপ কারখানা। সাইকেল, মোটর সাইকেলের টায়ার তৈরি হত এখানে। পড়ে বিমানের টায়ার এবং কনভেয়ার বেল্ট পর্যন্ত তৈরি হত। বিশ্বজুড়ে টায়ারের চাহিদা বেড়েছে বই কমেনি। তা সত্ত্বেও বাংলার এই শিল্প সংস্থা কেন বন্ধ হয়ে গেল সেই প্রশ্নটাই হয়তো খুঁচিয়ে তুলতে চাইবেন প্রধানমন্ত্রী। শিল্প ও কর্মসংস্থানের জন্য বাঙালির খিদেটাই আরও বাড়িয়ে তুলতে চাইবেন তিনি। সেই সঙ্গে হলদিয়ার সভার মতই শিল্পায়ণের স্বপ্ন দেখাতে পারেন বাংলাকে। এই বার্তা দিতে পারেন যে কেন্দ্র রাজ্য একই সরকার তথা ডবল ইঞ্জিনের সরকার থাকলে তবেই উন্নয়নের চাকা গড়াবে। ইতিমধ্যে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে ‘আত্মনির্ভর বাংলার’ হোর্ডিং পড়তে শুরু করে দিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হল, শুধু স্বপ্ন দেখালেই তো হবে না, তা বাংলার মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারবেন তো প্রধানমন্ত্রী? কারণ, কোভিডের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি এখনও মন্দাগ্রাস থেকে বেরোতে পারেনি। শিল্পে, বাণিজ্যে নতুন বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে।

অনেকের মতে, সম্ভবত এই কারণেই এ ধরনের রাজনৈতিক সভার পাশাপাশি কোনও সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধনও করছেন প্রধানমন্ত্রী। যেমন হলদিয়ায় উড়ালপুল, এলপিজি ইমপোর্ট টার্মিনাল, গ্যাস পাইপলাইনের মতো বড় পরিকাঠামো প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন, তেমনই ২২ তারিখ মেট্রো রেলের সম্প্রসারণ সহ গুচ্ছ প্রকল্প উদ্বোধনের কথা রয়েছে। সেই সঙ্গে আত্মনির্ভর ভারত প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে উৎসাহ দেওয়ার কথা বলছেন তিনি। যাতে নতুন কর্মসংস্থানের পথ প্রশস্ত হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.