ঘটনাটা পাঁচ বছর আগেকার। ২০১৪ সালে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া মোদীঝড় পশ্চিমবঙ্গে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। মাত্র দুটি আসন পেয়েছিল বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গের সবুজ দুর্গ অটুট রাখতে পেরেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু কার সৌজন্যে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পেরেছিলেন মমতা? উত্তরটা সবাই জানেন। মুকুল রায়। ২০১৭ সালে মুকুল বিজেপিতে যোগ দেন। তাই ২০১৯-এর মোদী ঝড় মমতা সামলাতে পারলেন না। বিজেপি ১৮টি আসনে জয় পেল। আর মমতার দল মুসলমানের মুষ্টিভিক্ষ্যায় ২২টি আসনে জিতে রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল।
একা মুকুলের জন্যেই কি পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির জয়জয়কার ? অবশ্যই না। নরেন্দ্র মোদী আছেন, অমিত শাহ আছেন— এছাড়া রয়েছেন রাজ্য বিজেপির নেতৃবৃন্দ। কিন্তু মুকুল একটু অন্য ধরনের নেতা। না, ঠিক নেতা হয়তো নন। অসম্ভব দক্ষ একজন স্ট্রাটেজিস্ট। তৃণমূলের অন্দরমহলের নক্শা যিনি ভালো চেনেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ তৃণমূলের প্রত্যেক নেতার শক্তি ও দুর্বলতার খোঁজ যিনি সব থেকে ভালো রাখেন। মুকুলের এইসব রাজনৈতিক গুণাবলী বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহের নজর এড়ায়নি। এবারের। লোকসভা নির্বাচনে প্রথম থেকেই পশ্চিমবঙ্গের ওপর বিশেষ নজর । দিয়েছিল বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃত্ব। অমিত শাহ বিশেষ দায়িত্ব দিলেন মুকুল রায়কে। অন্তত ২৩টি আসন চাই। মুকুল তৈরি করলেন স্ট্র্যাটেজি। বাকিটা ইতিহাস।
যুদ্ধে নামার আগে মুকুল দুটো জিনিস জানতেন। তৃণমূল দলে দ্বিতীয় কোনও মুকুল রায় নেই। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যত বড়ো নেত্রীই হোন, সাংগঠনিক দক্ষতার পরীক্ষায় একশোয় শূন্য পাবেন। বস্তুত তৃণমূলের দলীয় সংগঠনে মুকুলই ছিলেন শেষ কথা। ব্লক স্তর থেকে জেলা স্তরের নেতা-কর্মীরা তাকে চিনতেন। যে কোনও সমস্যায় তার কাছে আসতেন। যে কারণেতৃণমূলের বিখ্যাত গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামলাতে পেরেছিলেন বলেই মমতা ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জিততে পেরেছিলেন।
তাই দায়িত্ব পেয়েই মুকুল তৃণমূলের ঘর ভাঙতে শুরু করেন। নিজের দলের ঘর গোছানো এবং প্রতিপক্ষের ঘর ভাঙা—রাজনীতিতে দুটোই জরুরি। আমরা দেখলাম তৃণমূলের সৌমিত্র খাঁ, নিশীথ প্রামাণিক, অনুপম হাজরা এবং অর্জুন সিংহ বিজেপিতে যোগ দিলেন। এরা সকলেই তৃণমূলি রাজনীতির সঙ্গে সম্যক পরিচিত। তাই তৃণমূলকে দুর্বল করতে এদের অসুবিধে হয়নি। আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ মুকুল করেছেন। তৃণমূলের পাশাপাশি সিপিএমের পায়ের নীচের জমিও ছিনিয়ে নিয়েছেন। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএম ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। এবার সেই ভোট নেমেছে ৮ শতাংশে। ২২ শতাংশ বাম ভোট গেছে বিজেপিতে। যে কারণে ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের পরাজয়ের সম্ভাবনা এখন অনেকটাই নিশ্চিত।
পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক চাঙ্গা করার দুরূহ কাজটি নরেন্দ্র মোদী আগেই করে দিয়েছিলেন। দরকার ছিল এমন একজনের যিনি এই চাঙ্গা ভোটব্যাঙ্ককে ইভিএম পর্যন্ত নিয়ে আসতে পারেন। মুকুল রায় সেই কাজটি করেছেন। অসমে কংগ্রেস থেকে আসা হিমন্তবিশ্ব শর্মা যে কাজটি করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে মুকুল রায় ঠিক তাই করেছেন। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সাফল্যের মুখ্য কারিগরের শিরোপামুকুল রায়কে দিতেই হবে।
অরুণাভ সেনগুপ্ত
2019-05-31