বাড়ির উঠোনে মোটা গদি পেতে, তার উপর বালিশে হেলান দিয়ে বসে কাদামাটির তাল পাকাচ্ছেন এক যুবক। দুর্গামূর্তি তৈরি হচ্ছে। নিজেই মূর্তি গড়ছেন। মাটির কাঠামো প্রায় শেষ। এ বার রঙের প্রলেপ পড়বে। তার পর চুমকি, অভ্র, রাংতার
কারুকাজ তো আছেই। সময় এগিয়ে এল বলে, কাঁপা কাঁপা হাতদুটো তাই বেশ দ্রুতই মাটি গুলছে। সোজা হয়ে বসতে পারেন না তা প্রায় ২৫ বছর হয়ে গেল। তাই এই গদি, বালিশের আয়োজন। তবে প্রতিবন্ধী কথাটা কিন্তু মোটেও পছন্দ নয় যুবকের।
শরীর তাঁর ইচ্ছা মানে না ঠিকই কিন্তু মনের জোর ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারে যে কোনও বাধা। অসম্ভবকে সম্ভব করার দুরন্ত ইচ্ছা যাঁর সঙ্গী, সে প্রতিবন্ধী হয় কী করে!
ধনঞ্জয় পাত্র। হাওড়া শ্যামপুরের অমরাবতী পূর্ব পাড়ার ছোট্ট একতলা বাড়িটা ধনঞ্জয়দের। গোটা তিন ঘর জৌলুসহীন। অভাবের ছাপ স্পষ্ট। বাড়ির উঠোনে পা দিলেই ভেজা মাটি আর খড়ের গন্ধ কুমোরটুলি পাড়ার কথা মনে করাবে। দিনরাত এই উঠোনে শুয়েই মূর্তি বানাচ্ছেন ধনঞ্জয়। চারদিকে মাটি, রঙের ছড়াছড়ি। নিজেও গায়ে মাটি লাগিয়ে বসে আছেন। বললেন, “যখন আট বছর বয়স, হঠাৎ জ্বর হয়। তার পর ধরা পড়ে পোলিও। দুটোপা-ই অকেজে হয়ে যায়। এখনও ভালো করে বসতে পারি না। যা কাজ করি শুয়ে শুয়েই।“
ধনঞ্জয় এখন ৩৩। বাড়ির দশ ফুট বাই ছ’ফুট ঘরটাই তার পৃথিবী। সেখানেও ছোট-বড় নানা মূর্তির ছড়াছড়ি। ধনঞ্জয় পেশাগত মৃৎশিল্পী নন। মূর্তি গড়েন নেশায়, ভালোবাসার টানে। দুর্বল, জবুথবু শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে বড়জোর উঠোন অবধি নিয়ে যেতে পারেন। তার বেশি নয়। তাই ধনঞ্জয়ের দুর্গাপুজো হয় বাড়িতেই। নিজেই মূর্তি গড়েন, নিজেই প্রতিমা সাজান। ষষ্ঠীর বোধনে আগমনীর সুরে শিশুর মতো হেসে ওঠেন। এই চার দেওয়ালেই তাঁর শারদীয়া। উমাকে ধরে রেখেছেন নিজের মনের মতো করে।
ধনঞ্জয়ের আপন বলতে তাঁর বৃদ্ধা মা, দুই দাদা, দুই বৌদি, তিন ভাইপো। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে অনেক দিন। এক দাদা চাকরি করেন, আর এক দাদার ব্যবসা। তবে সব মিলিয়ে মাসের রোজগার খুব একটা বেশি নয়। তাও ভাইয়ের আবদার মেনে বাড়িতে দুর্গাপুজো করেন দাদারা। অভাবের সংসারে মূর্তি কিনে পুজো করা বিলাসিতা। তাই নিজেই মূর্তি গড়ার কথা ভাবেন ধনঞ্জয়। মাটির কাজ জানতেন। তাই বিশেষ ভাবনা ছিল না। যেটা দরকার সেটা হল মনের জোর। কারণ দুটো পা-ই অকেজো, হাতও কাঁপে। তবে হার মানতে রাজি ছিলেন না ধনঞ্জয়। বলেছেন, “বসতে পারি না তো কী হয়েছে, শুয়ে কাজ করব। একবারে না পারি, একটু একটু করে করব। আমি বাড়ির বাইরে যেতে পারি না, তাই বলে দুর্গা পুজোর স্বাদ পাব না, এমনটা হয় নাকি!”
২০১৭ সাল থেকে মূর্তি গড়া শুরু করেছেন ধনঞ্জয়। প্রথম বছর ছোট প্রতিমাই বানিয়েছিলেন। নিখুঁত মূর্তি দেখে ধন্য ধন্য করেছিলেন পাড়া-প্রতিবেশারী। তার পর থেকে পরিশ্রম আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন ধনঞ্জয়। এ বছরের মূর্তির উচ্চতা প্রায় আট ফুট। এক চালের ঠাকুর নয়। আলাদা আলাদা করে প্রতিটা মূর্তি বানিয়েছেন যুবক। আট ফুটের দুর্গার মূর্তি তৈরি হয়েছে অনেকগুলো ধাপে। তারপর সেগুলো জুড়ে দিয়েছেন অসাধারণ দক্ষতায়।
ধনঞ্জয়ের প্রতিবেশী অনিমেষবাবু বলেছেন, “ছোট থেকে ওকে চিনি। ওর সাহস আর ইচ্ছা তারিফের যোগ্য। ধনঞ্জয়ের কোনও প্রতিবন্ধী কার্ড নেই। ভাতাও পায় না। আমরা প্রতিবেশীরা সাহায্য করব বলে এগিয়ে এসেছি।” পুজোর চারদিন সকলকে ভোগ খাওয়ানো হবে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হবে বলে জানিয়েছেন অনিমেষ বাবু।
প্রতিবেশীরা তো বটেই, ধনঞ্জয়ের বাড়ি পুজো দেখতে নাকি দূরদূরান্ত থেকেও লোকজন আসবেন। কারণ এই পুজোয় থিমের মাতামাতি নেই, চোখ ধাঁধাঁনো অহঙ্কার নেই। আছে শুধু একরাশ ভালোবাসা। নিজের মতো করে নিজের প্রাণের প্রতিমা গড়েছেন ধনঞ্জয়।
সপ্তমীর সকাল কিংবা অষ্টমীর সন্ধেয়, ওই একচিলতে উঠোনেই শারদীয়ার আনন্দে মাতবে গোটা শ্যামপুর।