পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ মারে না, মার খায়, লাথি খায় জোড়া পায়ের

কথায় বলে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। আর পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। না, এ প্রবাদ আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ো নয়। গত ৫/৬ বছর আগেও প্রবাদটাকে মানুষ বিশ্বাস করত।

কিন্তু ইদানীং বিশেষ করে গত ২/৩ বছরে পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন এতটাই রাজনৈতিক হয়ে উঠেছে যে পুলিশকে ভয় পাওয়াটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে আদ্যিকালের বদ্যিবুড়োর গল্পকথা। কারণ এখন পুলিশই ভয় পায় মানুষকে। তাই সে কখনও লুকোয় টেবিলের তলায়, কখনও আলমারির পেছনে, কখনও মানুষের তাড়ায় ম্যারাথন দৌড় লাগায়। কখনও-বা সাতেও নেই, পাঁচেও নেই এমন একটা মুখভঙ্গি করে সব দেখেও কিছুই দেখে না। কখনও-বা পাড়ার ‘দাদা’দের ‘স্যার…স্যার’বলে হাত কচলায়। ‘একটু দেখবেন স্যার’ বলে শাসকদলের আমচা-চামচাদের বাড়িতে কলাটা-মুলোটা পৌঁছে দেয়। আর তা না হলে কখনও লাঠির ঘা, কখনও পাথরের ঘা খেয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় গিয়ে শুয়ে পড়ে হাসপাতালের শয্যায়। আমরা বড় বড় চোখে দেখি। আহা.. বেচারা.. পুলিশ বলে কী আর মানুষ নয়’ বলে আপ্তবাক্যে নিজেদের সান্ত্বনা দিই। দিদির ভাইদের নৃত্যনাট্য দেখি।

২০১৮-য় পশ্চিমবঙ্গে দিদির ভোটব্যাঙ্কে বিজেপি-র হাত পড়ে যাওয়ার পর পুলিশের সেই রাগী প্রশাসকের ভূমিকাটা একেবারেই দেখা যাচ্ছে না। পুলিশ হয় দিদির আঁচল ধরে ল্যাং ল্যাং করে ঘুরে বেড়াচ্ছে নবান্ন থেকে নিউ টাউন। আর সপাটে জোড়া পায়ের লাথি খাচ্ছে হাওড়ায় বেলিলিয়াস রোডে, বেলগাছিয়ায়, রাজাবাজারে, তপসিয়ায়, ট্যাংরায়, পার্ক সার্কাসে, খিদিরপুরে, মেটিয়াবুরুজে।

আমরা যারা এতদিন বলতাম—আহা! পুলিশ বলে কী আর মানুষ নয়? তারাও ধরে নিয়েছে দিদির প্রশাসনে পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ হয়েছে ফুলিশ। আর দিদির প্রশ্রয়ে ভাই-বোনেরা পরিণত হয়েছে বাঘে। ওরাই এখন দণ্ডমুমেডের কর্তা। বিশেষ করে খালপাড়ের বস্তি এলাকায় আর মুসলমান মহল্লায়। এসব জায়গায় ‘তিনোমুল’ ভাই বোনেরাই—রাম কিংবা রহিম ছোট ছোট এলাকার মুখোমন্ত্রী। এতদিন অনুশাসন বজায় রাখতে পুলিশ পিটিয়েছে। এখন পালটা পিটুনি খাচ্ছে পুলিশ, এমনকী এই লকডাউনের বাজারেও।

পুলিশ নিরুপায়। কারণ এরাজ্যের অষ্টম মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর আমলে পুলিশের অবস্থা হলো সেই “আসতে কাটে, যেতে কাটে’-র মতো। জলে বাঘ, ডাঙায় কুমির। অনুশাসন বজায় রাখতে পুলিশ গুলি চালালে, লাঠি চালালে পুরস্কার জোটে হয় সাসপেন্ড অথবা ট্রান্সফার। আর না চালালেও জোটে পুরস্কার নয় তিরস্কার। তাই বেলিলিয়াস রোডে করোনার সংক্রমণ রুখতে ফেজ আর লুঙ্গি পরিহিত জনগণকে “রমজান পালনের চেয়ে লকডাউন পালন করা বেশি জরুরি’ বোঝাতে গিয়ে জোড়া পায়ের লাথি খেতে হয়েছে। র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্সের নিয়মিত জিম করা ৩২। প্যাকের আঁটোসাঁটো যুব-পুলিশ বাহিনীও লেজ খাড়া করে দৌড় দেয় উলটো পথে। আর নবান্নে বসে মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে শোনা যায়–একটা ঘটনা ঘটেছে। তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে নাকি?’সত্যিই তো! এমন ‘ছোট ঘটনা তো ঘটেই, ঘটেছেও। পার্কস্ট্রিটে ধর্ষণ হয়েছে মধ্যরাতে ৩/৪ জন মুসলমান যুবকের কামার্ত পিপাসায়। কামদুনিতে দিল্লির মতোই এক নির্ভয়াকে ছিড়ে খুঁড়ে খেয়ে ছিবড়েটা ছুঁড়ে ফেলেছে স্থানীয় মুখ্যমন্ত্রীরা। আর আমরা শুনেছি সেই অমোঘ বাণী, ‘ছোট ঘটনা। প্রতিবাদীদের গায়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছে। ‘মাওবাদী’ পোস্টার। মনে পড়ে, বানতলায় তিন মহিলা সরকারি কর্মচারীকে গাড়িসহ পুড়িয়ে মারার ঘটনায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুও বলেছিলেন—এসব তো কতই ঘটে’। তবু পুলিশি অ্যাকশনটা হতো। আঠারো ঘা না হোক ন’ ঘা তো পড়তই। এখন উলটে পুলিশের পা ভাঙছে। মাথা ফাটছে। প্রতিবাদ করা যাচ্ছে না। করলেই চাকরি যাবে। এই পট পরিবর্তন কেন?

পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে যাবে, এর পিছনে রয়েছে একাধিক কারণ। প্রথম কারণ, রাজ্যে পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ প্রশাসনেও পালাবদল ঘটেছে। পুলিশের যেসব কর্তাব্যক্তি দিদির আঁচল ধরে দায়িত্ব পালন করতে চাননি, তারা বেশিরভাগই পাড়া বদলেছেন। অর্থাৎ সেই সব আইপিএস অফিসাররা কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে বেঁচেছেন দিল্লির আশ্রয়ে। শুধু আইপিএস নয়, বহু আই এএস অফিসার ও বদলির সুযোগটা কাজে লাগিয়েছেন, কারণ তারা পদমর্যাদার ঐতিহ্যটাকে আদিগঙ্গার পচা পাঁকে বিসর্জন দিতে চাননি। যাঁরা রয়ে গেছেন তারা ধরে নিয়েছেন, মাথা গুঁজে এরাজ্যে পড়ে থাকলে মানসম্মান ভোগে যাবে ঠিকই কিন্তু ক্ষমতার বাতায়নে বসে পার্থিব আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যটা উপভোগ করা যাবে সহর্ষে।

দ্বিতীয়ত, দিদি কংগ্রেসি ঘরানার হলেও, সাজতে চান কমিউনিস্ট।তাইমানুষের গায়ে লাঠির ঘা দিদির না-পসন্দ। বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর মৌখিক কিংবা বাস্তবিক লাঠৌষধির ওপর দিদির নিষেধাজ্ঞা বহাল আছে ২৪ ঘণ্টা। পুলিশ করবেটা কী? করোনা ছড়ালে ছড়াবে। প্রশাসন নিজেই তো ছড়াচ্ছে। পুলিশের দোষ দিয়ে লাভ কী?

এও বাহ্য! মাননীয়া নিজ মুখেই ‘সততার প্রতীক হয়ে প্রকাশ্যে স্বীকার করে নিয়েছেন—যে গোরু দুধ দেয়, তার লাথি তো খেতেই হবে। বড়ো সত্যি কথা। ওনার এখন ভরসা ওইসব দুধেল গাই। বাকি ভোট ধরে রাখার ওষধি স্বয়ং প্রশান্ত কিশোরেরও নেই। তার ওপর আবার ভয়ংকর চাপ চাপিয়েছে মিম বা মজলিস-ই – মুসলিমিন-এর ভয়ংকর আগ্রাসী নেতা আসাদুদ্দিন ওয়াইসি ঘোষণা করে দিয়েছেন, ২০২১-এ রাজ্যের ১৮০ বিধানসভা কেন্দ্রে মিম প্রার্থী দেবে। এই ঘোষণাই তো রাজ্যের মুসলমানরা কেন্দ্রীয় নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে তছনছ করল গোটা রাজ্যে। দিনের পর দিন কড়কড়ে নগদ ৫০০/১০০০/ ১৫০০ টাকার নজরানা পেয়ে মুসলমান মা-বোনেরা দিনরাত ধরনা দিয়ে পড়ে রইল পার্ক সার্কাস ময়দানে। সঙ্গে বাড়তি গরমাগরম বিরিয়ানির প্যাকেট। বোঝাই যাচ্ছে কোটি কোটি বিদেশি মুদ্রার খেলা চলছে এরাজ্যে মিমের নেতৃত্বে। পাল্লা দেবার ক্ষমতা ‘তৃণমূল’-এর নেই। অগত্যা রসুল-রহিমদের খুশি রাখতে হলে কোনোভাবেই ওদের লকডাউন করা যাবে না। লাকআপ তো নয়ই। তার জন্য করোনা। ছড়ালে ছড়াক। পুলিশের মাথা ফাটুক। ঠ্যাং ভাঙুক। একশো লোক লাথি মারলে এলাকায় একশো পুলিশের গাড়ির সাইরেন বাজিয়ে লোক দেখানো ৮/১০টা লুঙ্গিধারীকে গ্রেপ্তার করে ছেড়ে দাও। গাছেরও খাওয়া হলো, তলারও কুড়োনো হলো। ভোট বড়ো বালাই। দিদির কী দোষ। জীবনভর ওটাই তো শিখেছেন, শিখিয়েছেন প্রশাসন মানে এটাই। পশ্চিমবঙ্গের মহল্লায় মহল্লায় আজ ছড়িয়ে আছে জ্যোতিপ্রিয়, অনুব্রত, ববিরা। নির্দেশ আছে—জেলায় জেলায় এরাই শেষ কথা। লকডাউন করতে গেলে এরাই করবেন। লক আপের চাবি থাকবে এদের হাতেই। কেন্দ্রের পাঠানো রেশনের চালের বস্তায় ‘বাংলার গর্ব মমতা ছাপা ফ্লেক্স এরাই সাঁটবে এফ সিআই ছাপের ওপর। আর তার বেশিটা অনুব্রতরা পাঠাবেন ক্যাডারদের ঘরে ঘরে। বাকিটা পার্টির ত্রাণ সেবায়। পুলিশ তুমি কিছু দেখবে না। আদালতে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলবে তুমি কিছু দেখনি।

পুলিশ তাই কিছু দেখছে না। দেখবেও না। এরাজ্যে সেই তিন বাঁদরশিশুর মতো ‘দেখব না, শুনব না, বলব না’-র প্রতীক হয়ে চুপচাপ বসে থাকাই ভালো। কী দরকার? এই মাগগিগণ্ডার বাজারে মাস গেলে মাইনেটা তো মিলছে। ডিএ না মিলুক। উপরিটা তো হাত পাতলেই কেল্লা ফতে। অতএব মাভৈঃ । অনুব্রতর মাথায় অক্সিজেন কম যায় কী বেশি যায় ভেবে আমি কী করব। ওর ক্ষমতা বাড়ুক। জ্যোতিপ্রিয় রেশনের চালের হিসেব গুলিয়ে দিক। ববি ঠাণ্ডা মাথায়, মাথায় তুলুক সংখ্যালঘুদের। দিদির ভোট বাক্স ফুলে ফেঁপে ঢোল হোক, আমি পুলিশ কানাকড়ির মালিক। সেই তো লোকে বলবেই—‘পুলিশ তুমি যতই মারো, মাইনে তোমার একশো বারো।

অগত্যা পুলিশ উর্দিটা পরে থাকে মর্যাদা দিতে নয়, নিতেও নয়। চাকরি রাখতে পরতে হয় তাই। ওই স্কুলের লাস্ট বেঞ্চের ছাত্রদের মতো। পাশ করুক বা না করুক। ইউনিফর্মটা পরতেই হবে।

পুলিশও পরে। সেই ইউনিফর্মেই জোড়া পায়ের ছাপ পড়ে। রক্তের দাগও জমাট বাঁধে। লকডাউন হয়ে থাকেই পুলিশের মুখ। রাজ্যটা তো দিদির।

সুজিত রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.