চল, তাড়াতাড়ি কর,
আর দেরি নয়, বেরিয়ে পড় বেরিয়ে পড় এখুনি।
ভোররাতের স্বপ্নভরা আদুরে ঘুমটুকু নিয়ে
আর পাশে ফিরতে হবে না।
উঠে পড় গা ঝাড়া দিয়ে,সময় নেই-
এমন সুযোগ আর আসবে না কোন দিন।
বাছবাছাই না ক’রে হাতের কাছে যা পাস
তাই দিয়ে পোঁটলাপুঁটলি বেঁধে নে হুট ক’রে।
বেড়িয়ে পড়,
দেরী করলেই পস্তাতে হবে
বেরিয়ে পড়-
ভূষণ পাল গোটা পরিবারটাকে ঝড়ের মতো নাড়া দিলে।
হ্যাঁ, তারা উদ্বাস্তু হয়েছিল। ১৯৪৭ , ১৯৫০ – ৫১ , ১৯৬১ -৬৪, ১৯৭০ – ৭১ এবং আজও তারা উদ্বাস্তু হয়ে আসছে। কত কাল, কত যুগ , কত ক্ষুধার জ্বালা কেটে গেছে তারা উদ্বাস্তু হয়ে আসছে। তারা জেনেছে ছিন্নমূল শব্দের অর্থ। তারা ফেলে এসেছে গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, ঝাঁকে ঝাঁকে পাখ পাখালি, অজস্র জলধারায় ঘেরা এক ভূখণ্ডকে। অখণ্ড দেশটা ভাগ হয়ে তার নাম পাল্টে গেল। মানুষ গুলোর আর নিজস্ব বলে কিছু থাকল না। কত রাজনৈতিক কৌশল, কত কুটিল ষড়যন্ত্র, কত মানুষ চাইল ক্ষমতায়ন। বাঙ্গালী হিন্দু কেবল বসে বসে অখন্ডকে খণ্ড হতে দেখল। কিছু মানুষ কেবল নিজ স্বার্থে একটা অদ্ভুত নামকে মেনে নিল। কেউ কেউ গলা তুলে গাইল নতুন দেশের গান। কিন্তু হায় বাঙ্গালী হিন্দু ,তার ঘরখানি যে যেতে বসল তার খবর কে রাখল ? যারা গাছ, বন, জঙ্গলের ভিতর নীলকন্ঠ পক্ষীর খোঁজ করত , তারা একদিন হারিয়ে গেল। কোথায় গেল কেউ জানে না ?
তবে কিনা স্বাধীনতার একবছর আগে থেকেই সেই কালবেলা সূচনা হয়। পূর্ববঙ্গ থেকে হিন্দুরা চলে আসতে শুরু করল স্বাধীনতার এক বছর আগে ছেচল্লিশের দাঙ্গা সময় থেকে। সম্পন্ন হিন্দু পরিবার মেয়েদের সম্মান রক্ষার কারণে তখন থেকেই চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। যাকিছু সম্পত্তি বিক্রি করে এই বঙ্গে এসে আশ্রয় করতে পেরেছিলেন কয়েকজন , আবার অনেকেই পারেননি । স্বাধীনতার পরেও অনেকে পূর্ববঙ্গে থেকে গিয়েছিলেন এই আশায় যে আবার সব আগের মত হয়ে যাবে….. কিন্তু দুঃখের বিষয় আবার সব আগের মত হয়নি!
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী প্রথমে প্রবল ভাবে ভারত ভাগের বিরুদ্ধে ছিলেন । কিন্তু গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং- এর বীভৎসতার পর বাংলার আইনসভায় তার বক্তৃতা ছিল স্মরণীয়। যেখানে তিনি “পাকিস্তান কে নির্বোধ এবং অসত্য ধারণা “বলেছেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে হিন্দু বাঙ্গালীর হোম ল্যান্ড বিষয়টি কতটা জরুরি । দাবি করলেন তিনি সেই হোম ল্যান্ড, ২০ শে জুন ১৯৪৭, তারিখে বঙ্গীয় আইনসভা বাংলা ভাগের স্বপক্ষে রায় দিল। জন্ম হল বাঙ্গালী হিন্দুর এক ও অন্যতম হোমল্যান্ড পশ্চিমবঙ্গের। সকল ক্ষত, অপমান, যন্ত্রনা নিয়ে সীমানা পেরিয়ে অজস্র হিন্দুর শেষ আশ্রয় স্থল হল সেই হোমল্যান্ড।
দেশান্তর আর ধর্মান্তর দুজনেই সমার্থক ।এই দুই হওয়া মানে নিজের হৃদপিণ্ডকে খুলে আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলে দেওয়া । পূর্ববঙ্গ থেকে হঠাৎ বাস্তুচ্যুত হয়ে অসংখ্য মানুষ বাঙালি হিন্দুর হোমল্যান্ড পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে পা রাখল। সকলে মানিয়ে নিতে বাধ্য হল নতুন আর্থ , সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা। তারসঙ্গে ,তাদের অবশ্যই শুরু হল এক কঠিন সংগ্রাম। ফেলে আসা সাত পুরুষের গড়া ভিটেমাটি, ভূসম্পত্তি, চেনা জীবন ,সুখ-দুঃখ ,আনন্দ উৎসব এমনকি তিল তিল করে রপ্ত করা সংস্কৃতি কৃষ্টিকে ছেড়ে আসার বেদনাভরা স্মৃতি । অন্যদিনে প্রতিদিনের রূঢ় বর্তমান বাস্তবের মুখোমুখি নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষের সঙ্গে। অনেক ক্ষেত্রেই “রিফিউজি”, “বাঙাল” বলে উপেক্ষা। অনাদর মুখ বুজে সহ্য করে অস্তিত্বরক্ষা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার জোরালো দাবি নিয়ে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত নারী-পুরুষ অনেক উঁচু-নিচু বন্ধুর পথ পেরিয়ে একটু একটু করে গড়ে তুলেছে নতুন সংস্কৃতি।
কত দূর দিগন্তের পথ-
এখান থেকে নৌকা ক’রে ষ্টিমার ঘাট
সেখান থেকে রেলষ্টেশন-কী মজা, আজ প্রথম ট্রেনে চাপাবি,
ট্রেন ক’রে চেকপোষ্ট,সেখান থেকে পায়ে হেঁটে-পায়ে হেঁটে-পায়ে হেঁটে-
ছোট ছোলেটা ঘুমমোছা চোখে জিঞ্জেস করলে,
সেখান থেকে কোথায় বাবা?
কোথায় আবার! আমাদের নিজের দেশে।
ছায়াঢাকা ডোবার ধারে হিজল গাছে
ঘুমভাঙা পাখিরা চেনা গলায় কিচিরমিচির করে উঠল।
যেসব মানুষরা ভেবেছিল দেশটা ভাগ হলেই , দেশের নাম পাকিস্তান হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে ,আবার আগের মত হয়ে যাবে, আবার সব মিলে মিশে যাবে তারা কিন্তু বাস্তবে অন্য চেহারা দেখে ছিল। তারা দেখেছিল সংখ্যালঘু হয়ে অকথ্য নির্যাতনকে, নিঃশ্বাস নিতে ভয় হবার মতো দুঃস্বপ্নকে, নারী নির্যাতন , জোর করে সম্পত্তি দখলকে….এসব কিছু ধীরে ধীরে গ্রাম জনপদকে অস্থির করে তুলেছিল । ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি হয়েছিল দাঙ্গা হাঙ্গামা , ভীতি প্রদর্শনের ছোট-বড় ঘটনা । ফলত, প্রাণ ও মান বাঁচানোর তাগিদে পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা চিরকালের মতো বাস্তু ত্যাগ করে আসবার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল ।
দেশভাগ হবার পর থেকেই শিয়ালদা স্টেশন , ক্যাম্প ,কলোনিতে বাস্তু ত্যাগী মানুষের ভিড় ক্রমেই প্রতিদিন বাড়তে লাগলো । শুরু হলো উদ্বাস্তু মানুষের দুর্বিষহ জীবন যাপন ও পূর্বতন সুখ স্মৃতি রোমন্থনের বেদনা । নতুন করে বেঁচে ওঠার জন্য নতুন করে লড়াই, নতুন করে অস্তিত্বের সন্ধান, জীবনের ইতিবাচক মূল্যবোধের নতুন করে অনুসন্ধান। এখানে বলা উচিত এ ব্যাপারে পূর্ববঙ্গের সর্বস্তরের মেয়েরা পুরুষের সঙ্গে সমানভাবে সেই লড়াই বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। পরিবারের সকলকে ভালোরাখার ক্ষেত্রে , অর্থনৈতিক- সামাজিক- পারিবারিক নির্ভরতায় তারা যে বড় অংশীদার সেটা প্রমাণিত হয়েছিল । ঠিক যেমন, “মেঘে ঢাকা তারা”- র নীতা , নরেন্দ্র মিত্রের “অবতরণিকা” গল্পের আরতি…. এছাড়াও নরেন্দ্রনাথ মিত্রের “কাঠগোলাপ”, সমরেশ বসুর “পসারিণী” গল্পের সব কিছু পিছুটান ফেলে মেয়েরা জীবন যুদ্ধে এগিয়ে গিয়েছে।
যাত্রাভিনেত্রী বীণা দাশগুপ্ত, জোৎস্না দত্ত, ক্যাবারে ডান্সার মিস শেফালি, চলচ্চিত্র অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় সব রক্ষনশীলতার ভেঙে কাজের জগতে অর্থ উপার্জন করে সেই কালবেলায় নতুন পথের দিশারী হয়েছিলেন । উদ্বাস্তু মেয়েরা কর্ম সম্পাদন করে করালরূপী অলক্ষ্মীকে তাড়িয়ে লক্ষ্মীকে জয় করেছিল। মেয়েরা নিজের নিজের কলোনিতে মহিলা সমিতি গঠন , বিদ্যালয় গঠন ও পরিচালনা , নিজে শিক্ষিত হয়ে অন্য মেয়েদের শিক্ষা সংস্কৃতি জগতের এগিয়ে নিয়ে যাবার পরিকল্পনায় বিদ্যালয় স্থাপন , সেলাই ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল। সেদিন তারা অপ্সমারকে পরাজিত করে বিদ্যাকে লাভ করতে সমর্থ হয়েছিল।
ছায়াঢাকা ডোবার ধারে হিজল গাছেঘুমভাঙা পাখিরা চেনা গলায় কিচিরমিচির করে উঠল।জানালা দিয়ে বাইরে একবার তাকাল সেই ছোট ছেলে,দেখলে তার কাটা ঘুড়িটা এখনো গাছের মগডালেলটকে আছে,হাওয়ায় ঠোক্কর খাচ্ছে তবুও কিছুতেই ছিঁড়ে পড়ছে না।ঘাটের শান চ’টে গিয়ে যেখানে শ্যাওলা জমেছেসেও করুণ চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করছে, কোথায় যাবে?হিজল গাছের ফুল টুপ টুপ ক’রে এখনো পড়ছে জলের উপর,বলছে, যাবে কোথায়?
বাস্তুত্যাগের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে মানুষের ক্ষুধা । নিঃস্ব অবস্থায় বুকের মধ্যে গৃহদেবতাকে লুকিয়ে নিয়ে রাতের অন্ধকারে নিজের ভিটে ফেলে , বনজঙ্গল , নদীনালা পেরিয়ে, কচুরী পানায় নিজেকে লুকিয়ে শিয়ালদা স্টেশনের প্লাটফর্মে কিংবা ট্রানজিট ক্যাম্প কলোনিতে হিন্দু বাঙ্গালী হাজারে হাজারে আসতে শুরু করেছিল ।তারা ক্ষুধার্ত, পথশ্রান্ত , ক্লান্ত , নিরাশ্রয়। সে এক নিদারুণ যন্ত্রণা । তাদের খাদ্য ছিল চিঁড়ে , গুড় আর দিনে দুটাকা ডোল। দড়ি দিয়ে ঘেরা সীমানায় গাদাগাদি করে থাকা ,পানীয় জল, অন্য ব্যবহার্য তুলনায় সামান্য। রাস্তায় যারা ত্রিপল খাটিয়ে থেকেছে বেলেঘাটা খালপুলের ধারে বা মৌলালির কোণে তারা রাস্তার কাঠ কুটো জোগাড় করে ইঁটের উনুনে আগুন জেলে সামান্য খাদ্য ( যাকে অখাদ্যই বলা উচিত) পরিবার সন্তান-সন্ততির মুখে তুলে দিয়েছে।
শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় পেয়েছে যারা তাদেরও একই দশা। কাশী বিশ্বনাথ সমিতির দেওয়া জল , স্বেচ্ছাসেবী দলের তৈরি খিচুড়ি তাদের ক্ষুধার খাদ্য , যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য । এরসঙ্গে ছিল চল্লিশের দশকের মন্বন্তরের সুদূরপ্রসারী প্রভাব। চালের দাম আকাশছোঁয়া। বস্ত্র ও নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের সংকট হাত ধরাধরি করে এসে উদ্বাস্তু মানুষ গুলোকে আরো বিপর্যস্ত করে তুলেছে। তবু পশুর মত জীবন যাপন করে তারা হার মানেনি । তারা বাঁচতে শিখেছে ।
শেষপর্যন্ত সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে উদ্বাস্তুরা পুনর্বাসন পেয়েছে । শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির চেষ্টায় বিজয়গড় , বাঁশদ্রোনী , বাঘাযতীন কলোনি গড়ে ওঠে। পাশাপাশি দমদম ,বেলঘড়িয়া , সোদপুর ইত্যাদি স্থানেও গড়ে উঠেছিল অজস্র কলোনি। আত্মনির্ভর হয়ে ওঠার একেকটি শক্তিপীঠ হয়ে উঠেছিল কলোনী গুলি। দম্পতি , নারী , পুরুষ ও তাদের ছেলে মেয়েরা সকলে হাতে হাত লাগিয়ে হোগলার বেড়া , বাঁশের খুঁটি দিয়ে এক কামরার মাথা গোঁজার ঘর তুলেছিল। বেড়া দিয়ে চৌহদ্দি সীমানা তৈরি করে মেয়েরা ঘরের মাচায় তুলেছিল লাউ কুমড়োর লতা । পুকুর থেকে কলমি শাক, হিংচে শাক জোগাড় করে বহুদিন পরে স্বাদ বদলের চেষ্টা করেছিলেন উদ্বাস্তু মা – ঝি – বউরা । সেদিন দুঃখের ভাত অমৃত হয়ে উঠেছিল বহুদিন অখাদ্য খাওয়া মানুষগুলোর নিকট। কলোনিতে অতিবাহিত কষ্টের জীবনে স্থানাভাবের চেয়ে খাদ্যাভাবের কষ্ট ছিল বড়ো প্রবল। তবু সবকিছুকে মানিয়ে মা-মেয়ে বউ সকলে মিলে দুঃখের ভাত হাসিমুখে পরিবেশন করতে দ্বিধা করত না।
তারপর একটু দূরেই মাঠে কালো মেঘের মত ধান হয়েছে-
লক্ষীবিলাস ধান-
সোনা রঙ ধরবে ব’লে। তারও এক প্রশ্ন- যাবে কোথায়?
আরো দূরে ছলছলাৎ পাগলী নদীর ঢেউ
তার উপর চলেছে ভেসে পালতোলা ডিঙি ময়ূরপঙ্খিবলছে,
আমাদের ফেলে কোথায় যাবে?
আমারা কি তোমার গত জন্মের বন্ধু?
এ জন্মের কেউ নই? স্বজন নই?
সেমন্তী ঘোষ সম্পাদিত “দেশভাগ : স্মৃতি ও স্তব্ধতা” গ্রন্থে অরবিন্দ নগর , বিজয়গড় কলোনির বাসিন্দা উজ্জ্বলা চক্রবর্তী সেই উদ্বাস্তু জীবনের যন্ত্রনা অকপটে স্বীকার করেছেন।
“আমার বিয়ে হয়েছিল পঞ্চাশ সালে । আমার তখন কত বয়স? ১৪ হবে । ওরা নোয়াখালির । একইভাবে দাঙ্গার পরে রিফিউজি হয়ে চলে এসেছিলেন। আমার বিয়েটা খুব ছোট করেই হয়। তখন বলত মেয়ে তুলে নিয়ে বিয়ে করা। আমার হয়েছিল তাই।…. এসে উঠলাম অরবিন্দ নগর কলোনিতে। বিরাট সংসার , সব মিলিয়ে ১৬-১৭ জন। জায়েদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে সব কাজই করতাম। জলখাবারে রুটি তরকারি হতো।…. তারপর রান্নাবান্না – ডাল তরকারি তিতা মাছ…। খেতে খেতে সাড়ে তিনটে তিনটে । তখন আর তরিতরকারি বেশি থাকত না । ওই জন্য করতাম কি , রান্না হওয়ার পরে সবজি যত খোসা টোসা থাকত সেগুলো দিয়ে চচ্চড়ি মত বানাতাম…. ওইটা আমার জায়েরা খেতাম । রাতে অনেক সময় বড় জা তেঁতুল – চিনি দিতেন। ওই মেখে খেতাম। সন্ধ্যেবেলার খাবার চা, মুড়ি… মাঝে মাঝে নারকোল কোরা। রেশনে চাল পেতে সমস্যা হচ্ছিল।”
তাড়াতাড়ি কর- তাড়াতাড়ি কর-
ঝিকিমিকি রোদ উঠে পড়ল যে।
আঙিনায় গোবরছড়া দিতে হবে না,
লেপতে হবে না পৈঁঠে-পিঁড়ে,
গরু দুইতে হবে না, খেতে দিতে হবে না,
মাঠে গিয়ে বেঁধে রাখতে হবে না।
দরজা খুলে দাও, যেখানে খুশি চলে যা’ক আমাদের মত।
আমাদের মত! কিন্তু আমরা যাচ্ছি কোথায়?
তা জানিনা। যেখানে যাচ্ছি সেখানে আছে কী?
সব আছে। অনেক আছে, অঢেল আছে-
কত আশা কত বাসা কত হাসি কত গান
কত জন কত জায়গা কত জেল্লা কত জমক।
যদিও আমার শ্বশুর ছিলেন উদ্বাস্তু পরিবারের এবং আমার পিসি শ্বাশুড়ি প্রমুখের নিকট শুনেছি যে , তাঁদের ওইটুকু বিলাসী খাদ্যও একটা সময় জুটতো না। একবেলা আধপেটা খেয়ে থেকেছে। বিয়ের সময় মালা কেনার ক্ষমতা ছিল না । তাই গাছের ফুল পেড়ে মালা গেঁথে পিসিমার বিয়ে হয়। আলুর খোসা ভাজা দিয়ে সকালে ভাত খেলে রাতে তার পাতে একটি কি দুটি রুটি পড়ত। একবেলা ফ্যান জুটলে অন্যবেলস্তু জল খেয়ে কাটানো হত। কপির পাতা থেকে কুমড়োর দানা কেউই ফেলা যেত না। বাস্তুহারা জীবনের ঘর গেরস্থালির ও অতি সাধারণ থেকে নিম্নমানের খাদ্য ব্যঞ্জনের বিবরণ থেকে স্পষ্ট হয় টানাটানির সংসারে মেয়েদের সহনশীল কর্মপটুতার পরিবার পরিজনকে আপ্রাণ ভালোরাখার চেষ্টা। এসব আলোচনা হয়ত অন্তরালে বেদনাও পাঠককে সচকিত করবে।
আসলে দুঃসময়ের খরতাপে বাস্তুহারা পরিবারের মেয়েরা অভাবকে অতিক্রম করে কঠিন অনায়াসে রপ্ত করে যতটা পেরেছে পরিবারকে স্বাচ্ছন্দ্য সুখ দিতে চেয়েছে। তারা জানে , তাদের পূর্ব প্রজন্মের বাবা ভাই আত্মীয়-স্বজনের ভিটেমাটিতে খাদ্যাভাব ছিলনা ।মধ্যাহ্নের আহার তালিকায় মা , মাসি, ঠাকুমা, দিদারা পাত সাজিয়ে দিতেন, ” পানকাইজ চালের ভাত, গাওয়া ঘি, আলু বেগুন আর পটল ভাজা, ঘন মুগের ডাল , পাবদা মাছ, বড় বড় কই , চিতল পেটির তিন পদ। সরওয়ালা ঘন দুধ আর মোহন ভোগ দিতেন শেষপাতে। সেসব চিরতরে হারিয়ে গেছে। নয়তো মনে হয় অলীক , অপার্থিব সব দিনগুলি। “
একটা সময় সারা বাজার ঘুরে বেড়িয়ে মাঝবেলায় বাজারের পড়তি ঝরতি জিনিস, একটু পেট ফোলা মাছ, মুরগী পাঁঠার নাড়িভুঁড়ি, গলা, মাথা , এমনকি পুকুর থেকে ধরা গেঁড়ি গুগলি কিনে এনে সন্তানদের মুখে ছদ্মখাবার তুলে দিতে হত। সেদিনও মা দিদিমারা পুরনো দিনের সুখের স্মৃতি বুকে চেপে ধরে সেই সব অখাদ্যগুলিকে তাঁদের হাতের অন্নপূর্ণা ছোঁয়ায় খাদ্যে পরিণত করেছেন।
২০১৯ সালের ৩ রা আগস্ট শনিবার একটি বিশেষ সংবাদপত্রের পাতায় সেলেব কিচেন কলমে বিখ্যাত সেলেব , যিনি সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি আলু পটলের চোকলা ভাজার রেসিপি দিতে গিয়ে নিজের অতীতের কথা জানিয়েছিলেন।
” ওপার বাংলার মানুষ এপার বাংলায় এসে আর্থিক অনটনের মুখোমুখি হয়। তাদের সহজাত অভ্যাস তৈরী হয়ে যায় সবজির সবটুকু দিয়ে রান্না করার । কিছু যাতে ফেলা যায়, সেদিকে নজর রাখা। আমার বাড়ি ও তার ব্যতিক্রম নয়। বাড়িতে ছোটবলায় লাউ আনা হলে তা দিয়ে লাউ ঘন্ট যেমন হতো ,আবার একই সঙ্গে হত লাউয়ের খোসা ভাজা । এই তরিতরকারি সাধারণত বাতিল দিয়ে নানা রকম রান্না আমায় ছোটবেলা থেকেই আকৃষ্ট করত । ছোটবেলায় দিদিমাকে দেখেছি একধরনের সান ড্রায়েড আলু ভাজা করতে । আলু কুচি কুচি করে কেটে জলে ভালো করে ধুয়ে নিয়ে জল ঝরিয়ে ভেজা খবরের কাগজের ওপর ফেলে রোদ রাখতেন দিনকয়েক । আলু শুকিয়ে গেলে তারপর সাদা তেলে ভেজে খাওয়া হতো। একরকম নয়, বাড়িতে আলুভাজা রকমফের হত পাঁচ সাত রকম। ……দিদিমার কাছ থেকেই শিখেছি মেঘ দেখে ডাল রান্না করা। যেমন – পরিষ্কার আকাশ থাকলে বিউলির ডাল। আবার ,বর্ষাদিনে হত চালডালের পাতলা খিচুড়ি। ….কত সামান্য তেল মশলা দিয়েও রান্নার স্বাদ বদল হয়, তাও শিখেছি।”
সেখানকার নদী কি এমনি মধুমতী?
মাটি কি এমনি মমতামাখানো?
ধান কি এমনি বৈকুন্ঠবিলাস?
সোনার মত ধান আর রুপোর মতো চাল?
বাতাস কি এমনি হিজলফুলের গন্ধভরা
বুনো-বুনো মৃদু মৃদু?
মানুষ কি সেখানে কম নিষ্ঠুর কম ফন্দিবাজ কম সুবিধাখোর?
তাড়াতাড়ি করো, তাড়াতাড়ি করো-
ভূষণ এবার স্ত্রী সুবালার উপর ধমকে উঠল:
কী কত বাছাবাছি বাঁধাবাঁধি করছ,
সব ফেলে ছড়িয়ে টুকরো-টুকরো ক’রে এপাশে-ওপাশে বিলিয়ে দিয়ে
জোর কদমে এগিয়ে চলো,
শেষ পর্যন্ত চলুক থামুক ট্রেনে গিয়ে সোয়ার হও,
সোয়ার হতে পারলেই নিশ্চিন্তি।
আসলে বাঙ্গালী ভোজন শিল্পী। আর বাঙ্গালী মা ঠাকুমা দিদিমারা পরম্পরাগত ভাবে সুগৃহিনী, রন্ধন পটিয়সী ।বাঙ্গালী মেয়েরা নিত্যকর্মটিকে আনন্দের সঙ্গে অভিনব প্রণালীর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। দুঃখ কষ্টের সময় , বাস্তুহারা জীবনেও হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে সেই পটুত্বে কষ্টের সংসারে আলোর ঝর্ণা বইয়ে দিয়েছিল। হতাশার মধ্যেও তারা আশায় বুকবেঁধে ছিল। “জীবনের জলছবি” গ্রন্থে আঠারো উনিশ অধ্যায় কথা সাহিত্যিক প্রতিভা বসু পিতা-মাতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে লিখেছেন ” সবচেয়ে বড় কথা এত কাণ্ডের পরও দাঙ্গার অবসান ঘটল না । কাতারে কাতারে সহস্র সহস্র হিন্দু পালিয়ে এসে এ পিঠে ভাঙা ভারতের পথে বসলো। তার মধ্যে কেউ বাঁচলো কেউ মরল। কলকাতা শহরে ছেয়ে গেল মানুষে মানুষের । ছোট-বড় ধনী-নির্ধন জাতি-নির্বিশেষে শ্মশানে যাবার পূর্বেই, এক হয়ে গেল বিপদের স্রোতে ভেসে ।তাদের নাম হলো উদ্বাস্তু, রিফিউজি।
আমার পিত্রালয় এই নামের অন্তর্গত হলেন । তারা প্রাণে কেউ মরলেন না বটে তবে ধনে এবং মানে তাদের অবস্থা মৃত্যুর অধিক হলো। …. তাঁরা আসার অব্যহতি পরেই সাংঘাতিক থেকে দাঙ্গা লেগে গেল ঢাকাতে…ওঁরা আর ফিরতে পারলেন না। বাবা পড়লেন বিপাকে। ঢাকা থাকতে বিলাসিতার অভাব ঘটলেও ঘটতে পারত, কিন্তু চাল আর ডালের অভাব ছিলনা। সে খাদ্যই তো জমিদারি থেকে আসত ।…. আমি বাবাকে বিশেষভাবে বলেছিলাম তুমি বাড়িটা বদলে নাও । বাবাকে বলতেন, ” দুৎ পাগল নাকি, এরকম মারামারি থাকবে নাকি চিরদিন ! থামলো বলে। থামলেই আমরা ঢাকায় চলে যাব । এখানে না হয় বাড়িটা বদল করলাম? খাবোটা কি? ওখানে গেলে তো আমাদের খাবার অভাব নেই । কি মস্ত বাড়ি, ধান ,চাল ,ডাল ,চিনি ,নারকেল নিজেদের ভেড়ি, মাছের অভাব কি?
তাঁরা আর ফিরতে পারলেন না। দেশভাগ তাঁকে ধনে প্রাণে নিঃস্ব করে দিল । শুধু অতীত সুখের স্মৃতি, সুখ খাদ্যের স্মৃতি , সম্পদের স্মৃতি তাঁদের মনের মধ্যে উথাল পাথাল করে তুলেছিল। “
বাঙ্গালী অন্নময় প্রাণ, অন্ন ব্যঞ্জনের স্বাদুতা তাদের হৃদয়ে মস্তিষ্কে । হৃদয়হরণকারিনী বঙ্গনারী যুগ যুগধরে সুস্বাদু ভোজন ব্যঞ্জনের স্বাদুতায় তাই সামান্য উপাদানকে অসামান্য শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করতে জানত। আশ্রয়চুত্য হলেও তাদের যুগ যুগ ধরে পরম্পরায় চর্চিত শিল্পশৈলীকে কেউ ধ্বংস করতে পারেনি ।
উক্ত কথা মনে রেখেই বুদ্ধদেব বসু একটি বই লিখেছিলেন , “ভোজন শিল্পী বাঙালি ।” তার কোথাও গিয়ে মনে হয়েছিল যে বাঙ্গালী রান্নার ধ্রুপদী ধারাটি ক্রমশ লুপ্ত হয়ে যেতে পারে। ঐতিহাসিক কারণে তার একটি বিবরণ লিপিবদ্ধ করা উচিত । যদি আজ কালগ্রস্ত হয়ে থাকে – আর লক্ষণ যদি দেখে তাই মনে হচ্ছে ― তাহলে তার বিবরণ লিপিবদ্ধ থাকার প্রয়োজন আছে। কেননা পরিবর্তন জীবনের একটি নিয়ম হলেও পরিবর্তনও পরিবর্তনের অধীন । ইতিহাস ও পূর্বপুরুষের স্মৃতির মধ্যেই ভবিৎব্য নিহিত থাকে।
” বিষাদ বৃক্ষ” – র মিহির সেনগুপ্ত দেশভাগ এবং দেশত্যাগের ওদের সূচনাপর্বে বয়সে ছোট এবং ওপার বাংলার বাসিন্দা । তিনি ও তার পরিবারের সকলে ছয়ের দশকের গোড়ায় এপার বাংলায় আসেন । তাঁরা ছিলেন পিছরাখালের বাসিন্দা। আইয়ুব খানের শাসনকালে সংখ্যালঘু হিন্দুরা দেশত্যাগ নিশ্চিত বলে মনে করে। তখন সেখানে চাল সংকট ,খাদ্যাভাব । আটান্ন সালে সাত টাকা কাঠিচাল বিক্রি হতে লাগলো চল্লিশ পঞ্চাশ টাকায়। তখন সম্পন্ন তাঁদের পরিবারের ভগ্নদশা । তালুকদারি নেই। বিষয় আশয় বিক্রি করে সংসার চলছে । দেশে দুর্ভিক্ষ। হাভাতে মানুষ ভাতের আশায় তাঁদের বাড়ির লঙ্গরখানায় ভিড় জমাচ্ছে। আমেরিকা রিলিফের টন টন চাল পাঠাচ্ছে। কিন্তু সবজি, তেল , মশলা কোথায়, লেখকের স্মৃতিতে জানা যায় , তাঁর মা পাকশালার হাল ধরে এত মানুষের জন্য ব্যঞ্জন তৈরি করছেন। মার্কিন চালের ভাতের সঙ্গে খারকোল বাটা, খেসারির বড়া, শাপলা চচ্চড়ি, শাপলা ঘন্ট, চাড্ককাডা শাক, আক্রা ডগার ঝোল, সজনে ফুলে পাতরি, মালঞ্চ শাক, গিমা বেগুন , তেলাকুচোর ডাঁটার সঙ্গে মুগ ডালের ছেঁচকি, লাউ বা ছাচি কুমড়োর খোলা ভাজা এবং আরও অনন্ত পদ যেন আদৌ খাপ খায়না ।এই কারনে ভোক্তারা এই সাহেবি চালকে চাল বলে যেন ভাবতেই পারেনা । ভোক্তারা সবাই বলে , ” ক্যামনতারা য্যন ঠেহি, রবাট , রবাট। চিবাই ঠিকই। ভাত বলইয়া মালুম অয় না। সোয়াদ কইতে যেন কিচ্ছু নাই। ” এখানের নানা সুস্বাদু চালের স্বাদ এবং ঘ্রাণ , এইসব বিভিন্ন অনুষঙ্গ যাদের জিভে, নাকে এবং মস্তিকে গ্রথিত আছে , তারা কি এই মার্কিনি রবাট চালের সোয়াদে তুষ্ট হতে পারে?
বুদ্ধদেব বসু বলে লিখেছিলেন , ” মৎস্যকুলরাজ মহান ইলিশ- সে এক দেহে এতটা প্রতিভা ধারণ করে যে, শুধু তাকে দিয়েই তৈরি হতে পারে পঞ্চপদী নানা স্বাদযুক্ত ভোজনের মত ভোজন – যদি অবশ্য ভাগ্যে জোটে যথাযোগ্য রন্ধনকারী বা কারিণী। আরম্ভে এলো মুড়োর সঙ্গে স্নিগ্ধ লাউ, তারপর ঝরতি পড়তি কাঁটা দিয়ে রাঁধা ঘন মুগডাল, সঙ্গে কালচে ব্রাউন কড়কড়ে করে ভাজা গল কাঁটা। তৃতীয় দফায় কাঁচা কুমড়ো কালোজিরে ছিটানো পাতলা ঝোল – কুমড়ো , মাছ দুটোই থাকবে অনতি পক্ক। আর বাঙাল ভাষায় যাকে বলে “লুকা” সেই বস্তুও যেন সমাদৃত হয় – কেননা ইলিশই একমাত্র মাছ যার যকৃৎটিও উপাদেয়। চার নম্বরে এলো সর্ষপমন্ডিত তপ্ত বাষ্পাকুল ভাতে অথবা কলাপাতায় মোড়া পাতুরি ।আর সবশেষে, জিভ জুড়োবার জন্য চিনি মেশানো পাতিলেবুর একটা ঠান্ডা অম্বল – যাতে বিন্দুবিন্দু কালোজিরা আর দু-একটা কাঁচালঙ্কার সঙ্গে ইলিশের ওঁচা অংশ ল্যাজার দিকটা ভাসমান – রান্নার গুনে সেই অধমও এখন উত্তম।”
কিন্তু সে সব অতীতের কথা । …সেই জগৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কায় কেটে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর অখন্ড ভারতকে দ্বিখন্ডিত করার পর, বাস্তু থেকে হিন্দুদের খেদিয়ে দেবার , বুদ্ধিজীবীদের কথায় ভূগোল বিপ্লবের পরে এতদূর বিধ্বস্ত হয়েছিল বৃদ্ধদের আয়ু ফোরালে তার বিলুপ্তি অবধারিত বলে ধরা হত, এবং এখনো হয়।
কথাটা সত্যি বাস্তুচ্যুত হবার ফলে সেইসব ফেলে আসা রন্ধন শৈলী এখন স্মৃতিকথা। সত্তা জুড়ে তার জন্য বেদনা। নির্গলিত বেদনাশ্রু নিয়ে কলোনির ঘরে মা দিদিমারা অসহায় ভাবে ভাত, ভাতে ভাত, যাহোক দুটো রেঁধে খাদ্যের যোগান দিয়েছিলেন।
চারধারে কী দেখছিস? ছেলেকে ঠেলা দিল ভূষণ-
জলা-জংলার দেশ, দেখবার আছে কী!
একটা কানা পুকুর
একটা ছেঁচা বাঁশের ভাঙা ঘর
একটা একফসলী মাঠ
একটা ঘাসী নৌকো-
আসল জিনিস দেখবি তো চল ওপারে,
আমাদের নিজের দেশে, নতুন দেশে,
নতুন দেশের নতুন জিনিষ-মানুষ নয়, জিনিস-
সে জিনিসের নাম কী?
নতুন জিনিসের নতুন নাম-উদ্বাস্তু।
©দুর্গেশনন্দিনী
(প্রবন্ধটি ঋতম বাংলায় প্রকাশিত)
তথ্যঃ ১. কবিতা – উদ্বাস্তু : অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
২. যা ছিল আমার দেশ
৩. দেশভাগ : স্মৃতি ও স্তব্ধতা
৪. দেশভাগ : বাঙালি খাবার – স্মৃতিসত্তা ও বাস্তব