সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে মোদী ঝড়ে বিরোধীরা উড়ে যাওয়ার পরই শুরু হয়ে গিয়েছে ঘর বদলের পালা। কাতারে কাতারে অন্য দলের নেতা-নেত্রী ও কর্মীরা বিজেপিতে যোগদান করছেন। এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠছে যে, বিজেপি কি বেনোজল আটকাতে পারবে? বাঙ্গলার আনাচে কানাচে– চায়ের ঠেকে, অফিসে, আড্ডার আসরে এই প্রশ্নটিই ঘুরে ফিরে আসছে। এরও সময়সীমা রয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন। তারা বলেন, বিজেপি একটি শৃঙ্খলাপরায়ণ দল। এই রাজনৈতিক দলটির উত্থান ও উন্নতির পিছনে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আর এস এস ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদদের ভূমিকা রয়েছে। এই দুটি সংগঠন অনেকাংশে বিজেপিকে সমৃদ্ধ করে থাকে। বিজেপির বেশিরভাগ নেতা-নেত্রী এই দুটি সংগঠনের ঘরানায় লালিত পালিত হয়েছেন। একটা শৃঙ্খলাবোধ এই দুটি সংগঠনে রয়েছে। একমাত্র সেই শৃঙ্খলার বাঁধনে বেঁধেই বিজেপিকে বেনোজল আটকাতে হবে।
কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম থেকে এসে দলে দলে নেতা-কর্মীরা বিজেপিতে যোগ । দিচ্ছেন শুধু কি দেশসেবা করার জন্য নাকি নিজের সেবা করার জন্য? তবে দল। পরিবর্তনের কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথম কারণটি হলো নিজের অস্তিত্ব রক্ষার। হেরো দলের দল পরিবর্তন করা নেতারা কথাটা ভালোই বোঝেন। তাই যারা ক্ষমতায় আসতে চলেছে তাদের সঙ্গে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। নতুন দলে গেলে নতুন পদ পাওয়া যাবে, পাশাপাশি নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা যেটা তিনি এতদিন ধরে ব্যবহার করে আসছেন তা অটুট থাকবে। রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগের ধারাবাহিকতা বজায় থাকতে রাজশক্তির মুখ হিসেবে রাজনৈতিক ক্ষমতার চাবিকাঠিটি দল পরিবর্তনকারীদের কাছে থাকবে।
দ্বিতীয়ত, বহু নেতা-কর্মীর দল পরিবর্তন করার কারণ নিরাপত্তাহীনতা। তারা যখন শাসকদলের নেতা ছিলেন তখন বিরোধীদের উপর হামলা করেছেন, আক্রমণ করেছেন। এবার মার খাওয়াদের দল যখন জিতে যায়। এবং ক্ষমতায় আসে তখন পাল্টা আক্রমণ ও হামলা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ ঋণ করে থাকলে তাকে তো তা শোধ নিতে হবে অর্থাৎ বদলা নেওয়ার একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়। তাই সুযোগ বুঝে দল পরিবর্তন করে নিতে পারলেই এই সমস্যা থেকে অনেকটাই রেহাই পাওয়া যাবে।
তৃতীয়ত, এক শ্রেণীর নেতা-নেত্রী ও কর্মী আছেন যারা ভীষণ স্বার্থপর ও ধান্দাবাজ। নিজেরটুকু ছাড়া কিছুই বোঝেন না। তারা কংগ্রেসের জমানায় কংগ্রেস, সিপিএমের জমানায় সিপিএম, তৃণমূল জমানায় তৃণমূল করে এখন বিজেপিতে যোগদান করছেন। এভাবে জার্সি বদলাতে তারা অভ্যস্ত। এটাই এদের সংস্কৃতি বা কালচার। এরা কোনও সংগঠনের নীতি-আদর্শ মূল্যবোধের ধার ধারেন না। এরা সিপিএমের সেই নীতির সঙ্গে অনেকটা যুক্ত তা হলো—‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ, আমরা খাবো তোমরা বাদ’।
সম্প্রতি বিজেপিতে এমন কিছু নেতা যোগ দিয়েছেন যারা দাগি দুষ্কৃতী, অত্যাচারী, জেহাদি বলে এলাকায় পরিচিত। দল জেতার পর নেতা হওয়া আর জেতার আগে নেতা থাকার মধ্যেকার তফাতটা বুঝতে হবে। জেতার পর নেতা হলে জয়ী দলের সুযোগ সুবিধা নিরাপত্তা পাওয়া যায়। কিন্তু যারা মার খেয়ে অত্যাচার সহ্য করে দলের শৃঙ্খলা মেনে, জীবনসংশয় উপেক্ষা করে দলের কাজ করেছেন, দলকে জিতিয়েছেন, তাদের গুরুত্ব কি নতুনের ভিড়ে হারিয়ে যাবে? নতুন দলে আসা ক্ষমতাবান অর্থবানরা কী দলটিকে পরিচালনা করবে? তারাই কি আরও অর্থবান ও ক্ষমতাবান হয়ে উঠবে। আর দলের দুর্দিনের যারা একনিষ্ঠ কর্মী নেতা তারা এক ঘরে হতে হতে দলে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে—এটা কিন্তু ভাববার বিষয়। এ নিয়ে বিজেপি দলের কার্যকর্তারা নিশ্চয়ই চিন্তাভাবনা করবেন এই আশা ও ভরসা আছে। কিন্তু যে বিষয়টি খুবই প্রয়োজন তা হলো দলের নবাগত নেতা- নেত্রী ও কর্মীদের দলীয় শৃঙ্খলা বোঝানো ও প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত।
বিজেপি দলে আজ যাঁরা প্রথম সারিতে রয়েছেন, যাঁরা মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন, তাঁরা সঙ্ঘ পরিবারের শৃঙ্খলায় বেড়ে উঠেছেন। তাই নবাগতদের আর এস এস ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রশিক্ষণ বর্গে অংশগ্রহণ করাটা বাধ্যতামূলক করা উচিত। আর এস এস ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আগে তারা সুশৃঙ্খল হতে শিখুক, তারপর বিজেপির রাজনৈতিক দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করুক।তা না হলে বিজেপি দলটার পতন অনিবার্য হয়ে উঠবে। কারণ শৃঙ্খলা উন্নতির একান্ত সহায়ক। শৃঙ্খলা জাতীয় জীবনের সর্বাঙ্গীণ বিকাশে সাহায্য করে। এজন্য জাতীয় জীবনে শৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্ব অপরিসীম।
নবাগতরা বিজেপিতে যোগদান করছেন। দেশ সেবা করার জন্য। তাই তাদের প্রথমে অন্তত তিন বছর স্বয়ংসেবক হিসেবে কাজ করা উচিত। তারপর বিশ্ব হিন্দু পরিষদে অন্তত দু বছর কাজ করার পর বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ পদে আসা উচিত। তবেই তারা দলের ভিতরে ও বাইরে নেতা-নেত্রীদের শ্রদ্ধা সম্মান করতে শিখবে। তাদের এটা বুঝতে হবে দেশসেবা করব বললেই করা যায় না। দেশের সেবক হতে গেলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়। যোগ্য না হলে সেই দায়িত্ব পাওয়া যায় না। আর অযোগ্য ব্যক্তিরা এই দায়িত্ব পেয়ে গেলে দল ও দেশ দুটোই শেষ হয়ে যাবে। দলের বদনাম হবে।
রাজনীতিতে এই দল বদল নতুন নয়, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে একটি দল ভেঙে সমস্ত অচল নেতা আরেকটি দলে আশ্রয় নিলে নেতাদের অতীতের খারাপ কাজের দায় ও দুর্নাম দুটোই নতুন দলকে নিতে হবে। এটা বিজেপির পক্ষে সুখের ও শুভকর কখনই হবে না। যারা বিজেপিতে যোগ দিতে চাইছেন, তাদের তাহলে কি দলে নেওয়া যাবে না? এই প্রশ্নের উত্তর হলো নতুনদের দলে নিতে হবে। তবে তাদের দলীয় নীতি, আর সাংস্কৃতি ও শৃঙ্খলা জানিয়ে, শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে। যাতে তারা বিজেপিতে এসে অশান্তি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে না পারে। অন্য দলের কালচার বিজেপিতে আনা যাবে না। বিজেপিতে থাকতে হলে বিজেপির সংবিধান ও শৃঙ্খলা মানতে হবে। এখানে ব্যক্তি নয় দলীয় সংগঠন বড়ো। আর সংগঠন ব্যক্তিস্বার্থে নয় সমষ্টির স্বার্থে কাজ করবে।
যারা বিজেপিতে যোগ দিতে চাইছেন তাদের নেওয়া হোক। এর জন্য যেমন স্বাগত জানানো হবে, তেমনি তাদের শৃঙ্খলাপরায়ণ করার জন্য আর এস এস ও ভি এইচ পি-র সংগঠনে অন্তত পাঁচ বছর রাখাটাও বাধ্যতামূলক করা হোক। তৃণমূল, সিপিএম, কংগ্রেস থেকে এলে বিজেপিতে তাদের নেতা করে দেওয়া হলো, এমনটা যেন না হয়। এমন হলে বিজেপি দলটা পচা ও জঞ্জালের আস্তাকুঁড়ে পরিণত হবে। নীতি, আদর্শ, শ্রদ্ধা ও ভক্তি বলে কিছুই থাকবে না। দলের মধ্যে শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। এটা বলে নয়, হাতে কলমে শিখিয়ে আর এস এসের প্রশিক্ষণের কষ্টিপাথরে বাজিয়ে পরীক্ষা করেই দেশরক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। এরজন্য শৃঙ্খলা প্রয়োজন। শৃঙ্খলা শব্দের উৎস শৃঙ্খল শব্দ থেকে। শৃঙ্খল থেকে সুনির্দিষ্ট একটি কঠিন বন্ধন, শৃঙ্খলাও তেমনি সমাজজীবনের রীতিনীতি। শিক্ষাদীক্ষা, আচার, আচরণ মেনে চলার মানসিক বন্ধন। মানবসমাজ হলো একটি বৃহত্তর মানব সংগঠন। শৃঙ্খলা ছাড়া এই মানব সংগঠন এক মুহূর্তও টিকে থাকতে পারে না। তাই মানবজীবনে শৃঙ্খলা রক্ষার গুরত্ব। অপরিসীম। আর এই শৃঙ্খলা ও দেশসেবা করার প্রশিক্ষণ দেয় আর এস এস ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। তাই বেনোজলকে শুদ্ধ করতে গেলে তাকে সংস্কার করা দরকার। তবেই ওইসব নেতা-কর্মীরা সংস্কৃতিবান হয়ে উঠবেন। তাদের এই সংস্কৃতি ও শৃঙ্খলা শেখানোর জন্য রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের কষ্টিপাথরে পরীক্ষা করে নিতে হবে। তার পর বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ধর্মীয় বাতাবরণে লালিত পালিত করে সুশিক্ষিত ও ধর্মপরায়ণ ও সৎসঙ্গী করে তুলে বিজেপির নেতৃত্বে নিয়ে আসা উচিত অন্যদল থেকে আসা নবাগত নেতা-নেত্রী ও কর্মীদের। তবেই বিজেপির অন্দরমহলে সংস্কৃতি বজায় থাকবে।
সরোজ চক্রবর্তী
2019-06-24