‘এখনও যারা বুঝছেন না, তারা ভুল করছেন না, অপরাধ করছেন’ এই শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকায়, লেখিকা সেমন্তী ঘোষ। যারা বুঝছেন না, বা বোঝেন না (পড়ুন বুঝতে পারেন না) তারা ভুলও করেন না, তাদেরকে লেখিকা একেবারে অপরাধী হিসেবে দেগে দিয়েছেন।
প্রবন্ধের শুরু মমতাজ (চমকে উঠেছিলাম, প্রথমেই নামটি পড়ে) নাম্নী পরিচারিকার আক্ষেপ নিয়ে, ‘এত বড় সাহস, বিদ্যাসাগরের গায়ে হাত দেয়, এরা কি মানুষ?’ তারপরই পড়াশুনোর সুযোগ না পাওয়া পরিচারিকার মুখে ‘জানে এরা বিদ্যাসাগর কে? কী করেছে আমাদের মত মেয়েদের জন্য?’ অবাক হন লেখিকা। তারপর ড্রাইভার রফিকুলের শিক্ষা নিয়ে আক্ষেপ পাঠকের সামনে উপস্থাপন করে ওনার মতামত প্রকাশিত হয় লেখনী দিয়ে, ‘অবাঙালি গুন্ডা ছাড়া এমন কাজ কেউ করতে পারে না!’ লেখিকা নীরব থাকেন যখন এই পশ্চিমবঙ্গে একাধিক স্থানে ভেঙে দেওয়া হয় দেব দেবীর প্রতিমা, দেবস্থান। ইদের চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় ইন্দ্রজিতকে পিটিয়ে মারা হয়। যখন একের পর এক বিজেপি কর্মীকে হত্যা করা হয়, তখন লেখিকা চুপ বা ব্যস্ত থাকেন, নিজে সুবিধাবাদী জীবনে আরো একটু সুবিধা গুছিয়ে নেওয়ার জন্য? সেমন্তী দেবী জানেন না বা জানলেও মানেন না ইসলামে মুর্তিপূজা শিরক, এবং মূর্তিভাঙা ইসলাম মানা লোকেদের কর্তব্য।
উনি ধরেই নিয়েছেন বিজেপির লোকেরাই বিদ্যাসাগরের মুর্তি ভেঙেছেন, যদিও বিদ্যাসাগর কলেজ জানিয়েছে সিসিটিভির হার্ডডিস্ক নাকি অনেক দিনই খারাপ, কিন্তু উনি ওনার সঞ্জয়সম দূরদৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন বিদ্যাসাগরের মূর্তি কলেজের ভেতরের ঘরে ঢুকে কে ভেঙেছে। অবাঙালি গুন্ডা খুঁজতে গিয়ে অমিত শাহ-এর রোডশোর জন্য আসা দিল্লীর তাজিন্দর সিং বাগ্গাকে ভোর তিনটের সময় ঘুমন্ত অবস্থায় গ্রেফতার করে কলকাতা পুলিশ, আদালতের ভর্ৎসনার পরে তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হয় সেই দিনই। সেমন্তী দেবী টিভির খবর দেখেই ট্রান্সপোর্ট সার্ভের জন্য ব্যবহৃত আধুনিকতম রোবটও যা করতে পারে না, তিনি বার করে ফেললেন মিছিলে অংশ নেওয়া মানুষের সংখ্যা ও তারা কোন ভাষায় কথা বলে, হাজার হাজার অবাঙালিকে নিয়ে আসা হয়েছিল মিছিল সফল করবার জন্য। এই প্রতিভা উনি লুকিয়ে রেখেছিলেন, তা দেশের জন্য এক মারাত্মক ক্ষতি।
বিদ্যাসাগরের অবদান নারীশিক্ষার প্রসার, বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তন ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধাচরণ, ‘পড়াশোনার সুযোগ না পাওয়া গরীব মুসলিম’ মমতাজ একবিংশ শতাব্দীতেও কেন পড়াশোনার সুযোগ পেলেন না, সে বিষয়ে সেমন্তী দেবী নীরব, কারণ অনুমান করতে কষ্ট হয় না, কারণ বিজেপি এখনও এরাজ্যে ক্ষমতায় আসেনি একদিনের জন্যও। কিন্তু উনি উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন মুসলিম নারীদের তিন তালাক প্রথার অবসান ঘটানোর জন্য নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বের বিজেপি সরকারের কথা। উনি জানতেন না, ‘মেয়েদের জন্য’, ‘আমাদের জন্য’ যা-ই করে থাকুন বিদ্যাসাগর, তার তো খুব অল্প আঁচই মমতাজদের মহলে পৌঁছনোর কথা!’, কারণ উনি মুসলিম মহিলাদের আলাদা করে দেখতেন, তাই ওনার তিন তালাক, নিকাহ হালালা জানবার প্রয়োজনীয়তা পরেনি কোনোদিনও, তাই উনি জানেনও না তিন তালাকের মত নারীবিদ্বেষী প্রথার অবলুপ্তি ঘটিয়েছেন নরেন্দ্র মোদীর ‘মুসলিমবিরোধী’ বিজেপি সরকার। উনি জানেন না, কারণ উনি মনে করতেন ‘মমতাজদের মহল’ মমতাজদের পুরুষদের একচেটিয়া সাম্রাজ্য, ওখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী স্বাধীনতার প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ।
‘হায়, ইসলাম খবর রাখে না বাঙালি গুন্ডারা ঠিক কী কী কাজ করে ইতিহাসে নাম তুলেছেন দূর ও নিকট অতীতে’। উনিও খবর রাখেন না, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীকে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল লালু আলম, আই পি এস অফিসার বিনোদ মেহতাকে কোন গুন্ডারা খুন করেছিল। এমনকি নিকট অতীতে কোন বাঙালি গুন্ডারা পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় হত্যা করেছিল শতাধিক মানুষকে। ওনার দরকার পড়ে না উর্দু শিক্ষক নিয়োগের প্রতিবাদ করতে যাওয়ায় খুন হওয়া রাজেশ ও তাপসের কথা। ওনার জানার দরকার পরে না সাট্টা ডন রশীদ ওনার অফিস থেকে হাঁটাপথের দূরত্বে বিস্ফোরক সঞ্চয় করছিল কি জন্য?
‘বিজেপি যেখানে হাজারে হাজারে লোক বাইরের থেকে এনে বজরংবলী মিছিলে কলকাতার রাজপথ কাঁপাচ্ছে, সেখানেঅন্য দল রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে উসকানি দেবে, এটাই তো প্রত্যাশিত। চিরকাল এমনই হয়ে এসেছে।‘ কি অদ্ভুত ওনার মানসিকতা, আবার উনিই লিখেছেন ‘কলকাতার আত্মনিয়ন্ত্রণের নমুনা আমরা আগেও দেখেছি, বিরানব্বইতে বা তসলিমা নাসরিনের সময়’। এই সেকুলার আত্মনিয়ন্ত্রণের ফলেই কি আজ তসলিমাকে আজ বাংলায় ঢুকতে দেওয়া তো দূরের কথা, তার লেখা নিয়ে তৈরী ধারাবাহিক সম্প্রসারণ করতে দেওয়া হয় না টিভিতে। এরপরই একরাশ মিথ্যের ঝুড়ি উজাড় করেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে মাছ মাংসের বিরোধিতা করতে গিয়ে ঠেকেছে বিজেপি’ (আবাপ ই খবর করেছিল পশ্চিমবঙ্গের কর্মীসভায় মাছভাতের ব্যবস্থা করেছে বিজেপি কার্যকর্তারা), বিজেপির সর্বভারতীয় সম্পাদক সুনীল দেওধর ত্রিপুরায় দায়িত্ব নেওয়ার পর নিরামিষাশী আহারের সাথে সাথে মাছ ভাতও খাচ্ছেন কর্মীদের সাথে, পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির কার্যকর্তাদের কথা তো ছেড়েই দিন। বিজেপি ভেঙেছে লেনিন ও আম্বেদকর মূর্তি, লেনিনের প্রাসঙ্গিকতা বাংলা ও বাঙালির ক্ষেত্র কি তার কোনো মাথামুন্ডু পাওয়া যায় নি। আম্বেদকর মূর্তি কে ভেঙেছে সে নিয়ে এখন ও তদন্ত চলছে। কিন্তু লেখিকা নিজে একাধারে তদন্তকারী ও আদালত হয়ে দায়ী করেছেন বিজেপিকে। হিংসা পরিকল্পিত না অপরিকল্পিত এই নিয়ে তত্ত্ব দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সসম্মানে ক্লিনচিট দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে আরো একবার দাগিয়ে দিয়েছেন ‘গণতন্ত্রবিরোধী অন্যায়কারী’ হিসেবে। উনি দেখতে পাননি ১৩ ই মে তারিখ থেকে তথাকথিত সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নির্বাচনী ক্ষেত্র সাতগাছিয়ার নাহাজারী এলাকার বগাখালিতে হিন্দুদের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণকে, কারণ উনিও এই পরিকল্পনার অংশীদার, ওনার কাজ সত্য ঘটনাকে চেপে দেওয়া যায়, আর উনি পরিচারিকা মমতাজের অশিক্ষার সুযোগ ও রফিকুলের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে নিজের সুবিধেবাদী জীবন অব্যাহত রাখতে পারেন। সবশেষে পাঠকদের হুমকি দিয়েছেন ওনার কথা যারা বুঝছেন না, তারা ভুল করছেন না অপরাধ করছেন। উনিই শেষ কথা। ওনার উদ্ধৃত করা বিদ্যাসাগরের কথা আরেকবার উদ্ধৃত করলাম এখানে, ‘যাহাদের অভিপ্রায় সৎ ও প্রশংসনীয় এরুপ লোক অতি বিরল এবং শুভ ও শ্রেয়স্কর বিষয়ে বাধা ও ব্যাঘাত জন্মাইবার লোক সহস্র সহস্র’…।
কেবল লেখবার সময় সুবিধা নিক্তিতে মেপে নিয়ে অপরাধ ও অপরাধীর শ্রেণীবিভাগ করবেন না, মুক্তকন্ঠে সমস্ত প্রকার অপরাধ ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন, এটুকুই নিবেদন রইল সেমন্তী দেবী।